ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
চাপারমুখ আর জাগিরোড থেকে মামারা যেতেন গ্রামের বাড়িতে। তাঁদের হাত দিয়ে যেত ‘শুকতারা’, ‘নবকল্লোল’, দেব সাহিত্য কুটিরের নানারকম বই। মধ্য অসমের ওইরকম একটি দূর দরিদ্র গাঁয়ে বসে সেই অতি শৈশবে বাঁটুল দ্য গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরে দাদারা কলেজে পড়ার সময় হোজাই লংকা থেকে স্বপ্নের পত্রিকাগুলো নিয়ে আসত। এর পরের সিরিজটি ছিল নন্টে-ফন্টে আর বাহাদুর বেড়াল।
২০১৩-তে কলকাতা বইমেলায় অসম প্রকাশন পরিষদের স্টল দিই আমরা। বিরাট অনুষ্ঠান হয়। সঞ্চালক কালিকাপ্রসাদ। মুখ্য অতিথি সাহিত্যিক শংকর আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শেষে ধুম আড্ডা। কালিকা মধ্যমণি। সন্ধ্যা নেমেছে। হঠাৎ দেখি হুইল চেয়ারে বসা এক দীপ্যমান অশীতিপর মানুষ। তাঁকে ঘিরে জটলা। কালিকা ফিসফিস করে বলেছিল, চিনছ নি? আমি বলি, না। ও বলেছিল, ‘তাইন নারায়ণ দেবনাথ, হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুলের জনক।’ আমি হা। মাই গড….! আমাদের শৈশবকে রঙিন করেছিলেন যিনি, সেই নারায়ণ দেবনাথ!
তখনও সেলফির জমানা আসেনি। ছবি তোলার অমন ধুমও ছিল না। আমার হাতে একটি সোনি ক্যামেরা ছিল। তাও কেন জানি না, মহা সংকোচ হল। তাছাড়া, কতিপয় বডিগার্ড গোছের লোক ওঁর চারপাশের লোকজনকে তাড়াচ্ছে। ভীষণ রুক্ষ ব্যবহার। তাই আর ঘেঁষিনি। আজ খুব আক্ষেপ হচ্ছে। কেন একটি ছবি তুলে রাখলাম না। কেন একটিবার প্রণাম করলাম না তাঁর শিল্পীসত্তাকে।
দেব সাহিত্য কুটির থেকে একবার পরিকল্পনা করা হয়, ‘শুকতারা’-র অসমিয়া সংস্করণ করা হবে। আমার সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেন। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, অন্তত হাঁদা-ভোঁদা আর বাঁটুলের অসমিয়া ভার্সন হোক। কয়েক দফা আলোচনাও হয়। কোনও কারণে সেটা বাস্তবায়িত করা যায়নি।
হাঁদাটা পাক্কা সেয়ানা, ভোঁদা মাথামোটা, থলথলে চেহারার মতোই ওর কাণ্ডকারখানা। মহা দুষ্টু দুই ফিচেল ছোকরা। বিচিত্র তাদের কাণ্ড। সঙ্গে আছেন এক পিসেমশাই, এক পিসি, গঞ্জের কিছু বখাটে ছোকরা। হাঁদাটার বাঁদরামো বেশি। সে অতি বুদ্ধি দেখাতে যায়। পরে নিজেই নিজের ফাঁদে পা দেয়। এবং নাকানিচোবানি খায়। পড়ার বেলায় লবডংকা। সারাদিন, সারাক্ষণ এদের উৎপাত।
এই প্রজন্মটি এখন গ্রামেগঞ্জেও লুপ্তপ্রায়। সেই যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক আর মাখন, আমার কেন জানি হঠাৎ মনে হয়, নারায়ণ দেবনাথ সেই দুটি গ্রাম্য বালক-কিশোরকেই হাঁদা-ভোঁদা নন্টেফন্টের আকার দিয়েছেন। তখন মোবাইল ছিল না, টিভি ছিল না। এন্টারটেইনমেন্ট বলতে খেলাধুলা। হাডুডু-কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট, দড়ি টানাটানি ঘুড়ি ওড়ানো, এবাড়ি-ওবাড়ি ফলপাকড় চুরিচামারি করা। অভিযোগ। শাসন। শাসন মানে ধুম মার। কি, একটু কৃষ্ণের বাল্যলীলা মনে পড়ে যাচ্ছে কি? হ্যাঁ, এটাই চিরন্তন ভারতীয় বালককাল। নির্মল আনন্দই যার ভিত। অত উৎপাতের পরও কেষ্টঠাকুরকে কেউ কি অপছন্দ করে? করা সম্ভব? হাঁদা-ভোঁদা, নন্টেফন্টেও চিরন্তন বালকচরিত্র।
এদিকে, বাঁটুল সে তো ‘গ্রেট’। ভীষণ অনেস্ট। পরোপকারী। দেশপ্রেমী। এমনকী কার্গিল যুদ্ধে গিয়ে একাই জিহাদিদের সাফ করে এসেছে। খালি পা, হাফ প্যান্ট। গেঞ্জি। পাগুলো কাঠি-কাঠি হলে কী হবে, বুকের ছাতি ইয়া। বাহুও ফোলানো। অত যে খুনখারাপি হয়, মারদাঙ্গা, তাও মৃত্যুর লীলা নেই নারায়ণবাবুর কার্টুনে। মঙ্গল তথা ইষ্টের প্রতিষ্ঠাই যেন বাঁটুল চরিত্রে ফুটে উঠেছে।
বাঁটুলের মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে কি একটু ছোট হনুমান বা ছোট ভীমসেনের ছাপ নেই? দৈহিক অপরিসীম বলের অধিকারী অথচ ধর্মপথে আছে, এই ছাপটি অন্তত রয়েছে। বাঁটুল চরিত্রের মধ্যে হনুমানের সারল্য যেন কিছুটা অনুভব করা যায়। দুই পুঁচকে গুন্ডা বাঁটুলকে জব্দ করতে চায়, কিন্তু ল্যাজেগোবরে হয় বারবার। বাঁটুল সব জেনেও এদের পোষে, প্রশ্রয় দেয়। এই উদারতাও ভারতীয় দর্শনজাত।
নন্টে ফন্টে হাঁদা-ভোঁদার পরিপূরক। আর বাহাদুর বেড়াল মূলত শিশুমনকে আনন্দ দেবার সাথী। বাংলা শিশুসাহিত্য কেবল ছবিকাহিনিতে অমন সমৃদ্ধ হতে পারে, সেটা আগে কেউ কল্পনাও করেননি হয়তো।
তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। প্রকৃতির নিয়মে। দিনভর কেমন যেন ডুবে আছি শৈশবে। এরকম নাড়াকাটা দিন, ধানের বোঝা সারসার আসত উঠানে, খড়ের গাদায় মিঠে রোদে ঠাম্মার নকশি কাঁথায় পড়ে থাকতাম গোটা দুপুর, নরম বিকেলে, বুকে হাঁদা-ভোঁদা বা বাঁটুল…। সাদাকালো ছিল সেই ছবিগুলো। এবং সেটাই ভালো লাগত। বাঁটুল পরে হালকা লালে কালোয় আঁকতেন। কিন্তু আমার এখনও সাদাকালোর সেই অবিস্মরণীয় সংকলনগুলো প্রিয়।
অন্তরের ছোটবেলাটা পুরোটাই শহরে। অন্তরকে আমি আমার শৈশবটা দিতে চেয়েছি বাঁটুল হাঁদা-ভোঁদা দিয়ে। আস্ত আস্ত সংকলন ওর হাতে তুলে দিয়েছি। একটু বড় হয়ে সে ওগুলোর মধ্যে কচি হাতে রংটং করেছিল। আজ সেই বহু ব্যবহারে জীর্ণ পিতাপুত্রের শৈশবের সঙ্গী অসাধারণ কার্টুনগুলো বের করে আনলাম। আবারও ডুব দিলাম। শৈশবে।
নারায়ণ দেবনাথ চিরদিন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
লেখক গুয়াহাটির কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান
২০১৩-তে কলকাতা বইমেলায় অসম প্রকাশন পরিষদের স্টল দিই আমরা। বিরাট অনুষ্ঠান হয়। সঞ্চালক কালিকাপ্রসাদ। মুখ্য অতিথি সাহিত্যিক শংকর আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শেষে ধুম আড্ডা। কালিকা মধ্যমণি। সন্ধ্যা নেমেছে। হঠাৎ দেখি হুইল চেয়ারে বসা এক দীপ্যমান অশীতিপর মানুষ। তাঁকে ঘিরে জটলা। কালিকা ফিসফিস করে বলেছিল, চিনছ নি? আমি বলি, না। ও বলেছিল, ‘তাইন নারায়ণ দেবনাথ, হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুলের জনক।’ আমি হা। মাই গড….! আমাদের শৈশবকে রঙিন করেছিলেন যিনি, সেই নারায়ণ দেবনাথ!
তখনও সেলফির জমানা আসেনি। ছবি তোলার অমন ধুমও ছিল না। আমার হাতে একটি সোনি ক্যামেরা ছিল। তাও কেন জানি না, মহা সংকোচ হল। তাছাড়া, কতিপয় বডিগার্ড গোছের লোক ওঁর চারপাশের লোকজনকে তাড়াচ্ছে। ভীষণ রুক্ষ ব্যবহার। তাই আর ঘেঁষিনি। আজ খুব আক্ষেপ হচ্ছে। কেন একটি ছবি তুলে রাখলাম না। কেন একটিবার প্রণাম করলাম না তাঁর শিল্পীসত্তাকে।
দেব সাহিত্য কুটির থেকে একবার পরিকল্পনা করা হয়, ‘শুকতারা’-র অসমিয়া সংস্করণ করা হবে। আমার সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেন। আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, অন্তত হাঁদা-ভোঁদা আর বাঁটুলের অসমিয়া ভার্সন হোক। কয়েক দফা আলোচনাও হয়। কোনও কারণে সেটা বাস্তবায়িত করা যায়নি।
হাঁদাটা পাক্কা সেয়ানা, ভোঁদা মাথামোটা, থলথলে চেহারার মতোই ওর কাণ্ডকারখানা। মহা দুষ্টু দুই ফিচেল ছোকরা। বিচিত্র তাদের কাণ্ড। সঙ্গে আছেন এক পিসেমশাই, এক পিসি, গঞ্জের কিছু বখাটে ছোকরা। হাঁদাটার বাঁদরামো বেশি। সে অতি বুদ্ধি দেখাতে যায়। পরে নিজেই নিজের ফাঁদে পা দেয়। এবং নাকানিচোবানি খায়। পড়ার বেলায় লবডংকা। সারাদিন, সারাক্ষণ এদের উৎপাত।
এই প্রজন্মটি এখন গ্রামেগঞ্জেও লুপ্তপ্রায়। সেই যে রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক আর মাখন, আমার কেন জানি হঠাৎ মনে হয়, নারায়ণ দেবনাথ সেই দুটি গ্রাম্য বালক-কিশোরকেই হাঁদা-ভোঁদা নন্টেফন্টের আকার দিয়েছেন। তখন মোবাইল ছিল না, টিভি ছিল না। এন্টারটেইনমেন্ট বলতে খেলাধুলা। হাডুডু-কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট, দড়ি টানাটানি ঘুড়ি ওড়ানো, এবাড়ি-ওবাড়ি ফলপাকড় চুরিচামারি করা। অভিযোগ। শাসন। শাসন মানে ধুম মার। কি, একটু কৃষ্ণের বাল্যলীলা মনে পড়ে যাচ্ছে কি? হ্যাঁ, এটাই চিরন্তন ভারতীয় বালককাল। নির্মল আনন্দই যার ভিত। অত উৎপাতের পরও কেষ্টঠাকুরকে কেউ কি অপছন্দ করে? করা সম্ভব? হাঁদা-ভোঁদা, নন্টেফন্টেও চিরন্তন বালকচরিত্র।
এদিকে, বাঁটুল সে তো ‘গ্রেট’। ভীষণ অনেস্ট। পরোপকারী। দেশপ্রেমী। এমনকী কার্গিল যুদ্ধে গিয়ে একাই জিহাদিদের সাফ করে এসেছে। খালি পা, হাফ প্যান্ট। গেঞ্জি। পাগুলো কাঠি-কাঠি হলে কী হবে, বুকের ছাতি ইয়া। বাহুও ফোলানো। অত যে খুনখারাপি হয়, মারদাঙ্গা, তাও মৃত্যুর লীলা নেই নারায়ণবাবুর কার্টুনে। মঙ্গল তথা ইষ্টের প্রতিষ্ঠাই যেন বাঁটুল চরিত্রে ফুটে উঠেছে।
বাঁটুলের মধ্যে খুব সূক্ষ্মভাবে কি একটু ছোট হনুমান বা ছোট ভীমসেনের ছাপ নেই? দৈহিক অপরিসীম বলের অধিকারী অথচ ধর্মপথে আছে, এই ছাপটি অন্তত রয়েছে। বাঁটুল চরিত্রের মধ্যে হনুমানের সারল্য যেন কিছুটা অনুভব করা যায়। দুই পুঁচকে গুন্ডা বাঁটুলকে জব্দ করতে চায়, কিন্তু ল্যাজেগোবরে হয় বারবার। বাঁটুল সব জেনেও এদের পোষে, প্রশ্রয় দেয়। এই উদারতাও ভারতীয় দর্শনজাত।
নন্টে ফন্টে হাঁদা-ভোঁদার পরিপূরক। আর বাহাদুর বেড়াল মূলত শিশুমনকে আনন্দ দেবার সাথী। বাংলা শিশুসাহিত্য কেবল ছবিকাহিনিতে অমন সমৃদ্ধ হতে পারে, সেটা আগে কেউ কল্পনাও করেননি হয়তো।
তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটেছে। প্রকৃতির নিয়মে। দিনভর কেমন যেন ডুবে আছি শৈশবে। এরকম নাড়াকাটা দিন, ধানের বোঝা সারসার আসত উঠানে, খড়ের গাদায় মিঠে রোদে ঠাম্মার নকশি কাঁথায় পড়ে থাকতাম গোটা দুপুর, নরম বিকেলে, বুকে হাঁদা-ভোঁদা বা বাঁটুল…। সাদাকালো ছিল সেই ছবিগুলো। এবং সেটাই ভালো লাগত। বাঁটুল পরে হালকা লালে কালোয় আঁকতেন। কিন্তু আমার এখনও সাদাকালোর সেই অবিস্মরণীয় সংকলনগুলো প্রিয়।
অন্তরের ছোটবেলাটা পুরোটাই শহরে। অন্তরকে আমি আমার শৈশবটা দিতে চেয়েছি বাঁটুল হাঁদা-ভোঁদা দিয়ে। আস্ত আস্ত সংকলন ওর হাতে তুলে দিয়েছি। একটু বড় হয়ে সে ওগুলোর মধ্যে কচি হাতে রংটং করেছিল। আজ সেই বহু ব্যবহারে জীর্ণ পিতাপুত্রের শৈশবের সঙ্গী অসাধারণ কার্টুনগুলো বের করে আনলাম। আবারও ডুব দিলাম। শৈশবে।
নারায়ণ দেবনাথ চিরদিন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
লেখক গুয়াহাটির কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান