মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


শাঁওলি মিত্র।

আরও এক নক্ষত্রপতন বাংলার নাট্যজগতে৷ গত রবিবার অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি চলে গেলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র। মঞ্চ আর ব্যক্তিত্বের ছটায় কেটে তো গেল জীবনের এক পরিক্রমা। এর মাঝে ব্যক্তি মানুষরটির একলাযাপনের খবর কেউ কি রাখল? এই পরিক্রমায় তার নিভৃতযাপনের নিশ্চুপ সাক্ষী হয়ে রইলেন তার দর্শকরা। এবার অন্তত একটু ‘আত্ম’র উদযাপনে রত হোন ব্যক্তি ‘শিল্পী’। তার এই উদযাপনে আমাদের তরফ থেকে রইল বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য।

আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই—মনে হয় যেন আমি অনেকবার দেখেছি—সে অনেকদিন আগে—কতদিন তা মনে পড়ে না। বলব? আমি দেখতে পাচ্ছি, রাজার ডাক-হরকরা পাহাড়ের উপর থেকে একলা কেবলই নেমে আসছে—বাঁ হাতে তার লণ্ঠন, কাঁধে তার চিঠির থলি। কত দিন কত রাত ধরে সে কেবলই নেমে আসছে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনার পথ যেখানে ফুরিয়েছে সেখানে বাঁকা নদীর পথ ধরে সে কেবলই চলে আসছে—নদীর ধারে জোয়ারির খেত, তারই সরু গলির ভেতর দিয়ে দিয়ে সে কেবল আসছে তার পরে আখের খেত—সেই আখের খেতের পাশ দিয়ে উঁচু আল চলে গিয়েছে, সেই আলের উপর দিয়ে সে কেবলই চলে আসছে—রাতদিন একলাটি চলে আসছে; খেতের মধ্যে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে—নদীর ধারে একটিও মানুষ নেই, কেবল কাদাখোঁচা লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে বেড়াচ্ছে—আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি। যতই সে আসছে দেখছি, আমার বুকের ভিতরে ভারি খুশি হয়ে হয়ে উঠছে।’

আমার এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে একবার ক্লাসে খুব আক্ষেপের সঙ্গে বলতে শুনেছিলাম যে—’রবীন্দ্রনাথকে আমরা এই প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে পারিনি, সে না পারা, সে অক্ষমতা একান্তই আমাদের নিজস্ব, প্রত্যেক ইনডিভিজুয়াল ‘আমি’র অক্ষমতা জুড়ে জুড়ে এক বৃহৎ, বিরাট, অসীম অক্ষমতায় পর্যবসিত হয়েছে এই দুর্ভাগ্যজনক অক্ষমতা।’

এই বলার পরে বেশ অনকগুলো বছর কেটে গিয়েছে, তখনকার ছেলেমানুষির চৌকাঠ পার করেছি অনেকটা। এখন, এইসময়ে, এইমুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই আমরা রবীন্দ্রনাথকে কিচ্ছু বুঝিনি, এক বিন্দুও বুঝিনি, কিস্যু না। আমাদের সিলেবাসের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথের চৌহদ্দিকে আমরা আটকে দিয়েছি মৃত্যুর রূপক-সাংকেতিক বিশ্লেষণে, আর ‘জীবনদেবতা’র একরৈখিক চলনের মধ্যে, কেবল সিলেবাসের ওইটুকুই দরকার। ওইটুকুও রবীন্দ্রনাথ বটে, নিশ্চিতভাবেই রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু ওইটুকুর বাইরেও এক বিস্তৃত বিশ্বজুড়ে যে রবীন্দ্রনাথ একলা রয়ে যান, কেবলমাত্র সিলেবাসের অপ্রয়োজনে তার দিকে আমরা চেয়েও দেখি না। আর দেখি না বলেই ‘ডাকঘর’ নাটকে মৃত্যু কতটা রূপক-সাংকেতিক ধারণাবাহী হয়ে উঠছে এ নিয়ে যত বেশি মাথা ফাটাই তার বিন্দুমাত্র চিন্তাও ব্যয় করি না অমলের চলতে চাওয়ার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, অমলের একলা চলনের বহুবিধ যে দিক সেই দিকগুলির প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য। হতেও তো পারত যে অমলের আজীবন যে একলা চলন সেই একলা চলনের সম্পূর্ণতা, সেই চলনের সীমাহীনতাটুকুই নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এমন এক চলা যে চলাকে মৃত্যু স্তব্ধ করে না, করতে পারে না বরং জীবন-মৃত্যুর পারস্পরিক সাপেক্ষতার দ্বৈরথ তাকে এক পরিপূর্ণতার সিম্ফনি প্রদান করে, সুধার উপহারে সাজানো জীবন থেকে চয়ন করে নেওয়া একটুকরো সিম্ফনি যা ঋদ্ধ করে অপরিসীম চলতে থাকা। মনে হয় না কি ‘সিস্টেম’এর কাঁটাতারে আটকে থাকা এক অনির্বচনীয় উৎকণ্ঠার ব্যঞ্জনা মূক বেদনায় পর্যবসিত হয়ে কেবলই বলে চলেছ ‘আমাকে চলতে হবে’ বা ‘আমাদের চলতে দাও’ সিস্টেমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই অনির্দেশ্য পথে যাত্রা করার আরেক নামই যদি ডাকঘর হত তাহলে কি আমরা রবীন্দ্রনাথের পাশে দুদণ্ড বসতে পারতাম? তাঁর একাকিত্বের পাশে বসতে পারতাম? জানি না। তবে এই দীর্ঘ অবতারণা যে বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য সেই বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো আসলে বাক্যহীনতারই নামান্তর, তাই শেষমেশ আবার রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি একলা হয়ে বসা ছাড়া উপায় নেই, কারণ যার কথা বলব তিনিও তার একলা চলনের অনির্দেশ্যতার পথে বেরিয়েছেন, চুপটি করে সমস্ত সিস্টেমের বাইরে দাঁড়িয়ে ব্যক্তি ‘আমি’র যাত্রারম্ভের পথে তিনি শরিক হয়েছেন। অমলের মতো তিনিও যেন তার অবিরত চলতে চাওয়ার পাথেয়কে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে বলে উঠছেন—’আমি সমস্ত দেখতে পাচ্ছি। যতই সে আসছে দেখছি, আমার বুকের ভিতরে ভারি খুশি হয়ে হয়ে উঠছে।’

কোনও শোকবিহ্বল আবহ নয়, শোকের ঘনঘটা নয়, রবিবারের এক ঝকঝকে শীতের দুপুরে রোদ পোহানোর আলস্যকে সম্বল করেই তিনি যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেলেন—
‘মাঠের কিনার ঘিরে কেঁপে ওঠা বনবাসী হাওয়া যাই,
পিতৃপুরুষের প্রদীপ বসানো দুঃখ আর
ঠাকুমা যেমন ঠিক দশমীর চোখে দেখে জল
পাকা সুপুরির রঙে ধরা গোধূলীর দেশ
আমি যাই।’
বিশ্ব তাকে চিনেছিল শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে। মঞ্চ তার ‘নাথবতী অনাথবৎ’এর রানি সুদর্শনা, তিস্তা, বুলু কিংবা দ্রৌপদীকে মনে রেখেছে। কিন্তু আমাদের রানিকে যত বেশি মনে পড়ে তত বেশি তো মনে পড়ে না আরম্ভকালে কথক ঠাকুরের সেই অমোঘ বাক্যকে-‘রানি কিন্তু রানি নয়!’

বাংলা নাট্যজগতের সেরা ছয়ের মধ্যেকার আরও এক নক্ষত্রপতন। মেঘনাদ ভট্টাচার্য, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, রমাপ্রসাদ বণিক, দেবাশিস মজুমদার এবং শাঁওলি মিত্র৷

বন্ধুত্বের সেরা ছয়ের জুটি থেকে চিরবিদায় নিলেন এবার শাঁওলি মিত্র। গত রবিবার অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারি নিভে গেছে শাঁওলি মিত্র নামক পঞ্চম বৈদিকের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রটি। সমাপতন ঘটেছে এক যুগের। স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর আরও একবার ভিত নড়ে উঠল বাংলা নাট্যজগতের, দ্বিতীয়বার মাতৃবিয়োগের শোক অনুভব করলেন অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্ত। কিন্তু দেশ-কাল-সময়ের ঐতিহ্যবাহী কন্ঠস্বরের প্রতিভূস্বরূপ যে ‘বঙ্গবালা’ ৪৭’এর ভারতীয় মানচিত্রের বিকৃতিকে সাদাত হাসান মান্টোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার শৈল্পিক পরাকাষ্ঠার গুণে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক পরিসরকে অতিক্রম করে এক থেকে বহু-র মধ্যে অনায়াসে বিচরণশীল হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বা বেতার মাধ্যমে ‘নন্দিনী’র আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সঙ্গে নিয়ে যত না বেশি শ্রোতৃবর্গের মধ্যে অন্যতর এক শাঁওলি মিত্র হিসাবে, তার আত্ম এবং অপর উভয়কেই কাঠামোবন্দি করতে পেরেছিলেন তত বেশি করে ব্যক্তি শাঁওলি মিত্র আবরণহীন হয়ে ‘নিজ’র আয়নায় বসার সুযোগ কি তেমন করে কখনও পেলেন? বিদ্বজ্জনেরা বলবেন শিল্পই শিল্পীর এক এবং একমাত্র আত্মপরিচয়ের নিদান। এক থেকে বহুর মধ্যে ‘নিজ’ ব্যতিরেকে জলের আকারে নিজের শিল্প নিদর্শনকে ছড়িয়ে দিতে পারাটাই তার যথার্থ ব্যক্তি হয়ে ওঠা। যথার্থ কথা। কিন্তু এ তো কেবল শিল্পীর আখ্যান নয়। এ তো তারকার আখ্যানও বটে। আর আমাদের মতো অন্তর্মুখী, ভীরু মানুষরা, যাদের কথায় বড় ভয় কোলাহলে বড় ভয় তারা সবসময়ই বলবে যে ‘সমস্ত ভিড়ভাট্টা পার করে কেবল নিজের সঙ্গে হাঁটতে চাও শিল্পী’ অন্তত কিছু সময়ে একক ব্যক্তির ভাঙাগড়ার শামিল হতে পারার অবসরটুকুও যে শিল্পীর জীবনে বড় দরকার। তারকাদের জীবনে এ এক বড় অসহায়তা যে তাদের একান্ত নিজস্ব যাপনটুকুও তারা মানুষের মধ্যে বিলি করে দিতে বাধ্য হন। শাঁওলি মিত্র তার শেষ একান্ত যাপনটিকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন পরম যত্নে। বেহালার সিরিটি শ্মশানে তার অন্তিম কাজ সারা হয়েছে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে যেমনটা ঠিক শম্ভু মিত্র নিজের বেলায় চেয়েছিলেন এবং বাস্তবায়নের সমস্ত পথ প্রশস্ত করে গিয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই আত্মজার পথও অনুসরণ করল পিতার আদর্শকে। নিভৃত বিদায়ের ইচ্ছাপত্রে শাঁওলি মিত্র সই করে গিয়েছিলেন আগে থেকেই, সেই অনুযায়ীই সম্পন্ন হল অন্তিম কাজ। ‘দিদৃক্ষা’তে লিখেছিলেন, ‘রেডিয়োতে যখন অমল করতে হল, তখন আমি খুব অসুস্থ থাকতাম। প্রায় সময়ই বিছানায় শুয়ে বসে কাটত। তখন মা একদিন রেডিয়োতে অমল করতে হবে বলে আবার পড়বার জন্য ‘ডাকঘর’ বইটা আমার বিছানায় দিয়ে গেল। সে দিন ‘ডাকঘর’ পড়ে আমি কাঁদতে লাগলাম, গোড়া থেকেই।’ ওই কান্নাটুকু জুড়েই পড়ে আছে নিভৃত পরিসরের অমল, যেমন ‘রবীন্দ্রনাথ একলা থাকেন অশ্রুনদীর সুদূর পারে’। যাত্রারম্ভের শুরুতে সুধার পথ চেয়ে বসে থাকা অমলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি শাঁওলি মিত্রও নিজের নিভৃতবাসরকে আগলে রাখলেন নিজের মতো করে।

যাকে সবাই চেনে, যিনি সবার জন্যে থাকেন কখনও কখনও তাকে একেবারেই না চেনাটা খুব প্রয়োজনীয়, সেই মানুষটির নিজের কাছে ভীষণ প্রয়োজনীয়। এই প্রয়োজনীয়তাই হয়তো আমাদের আরও বেশি করে অনুধাবন করতে শিখিয়ে গেলেন সেই মানুষটি, যিনি সত্যিই রানি, কিন্তু ঠিক রানি নয় যেন! সুদর্শনার মতোই তিনি যেন নিঃশব্দে বলে গেলেন—
‘তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়
তুমি যারে জান, তুমি যারে জান সে যে
কেহ নয় কেহ নয়।’

 


Skip to content