পত্নী প্রমীলাদেবীর সঙ্গে কবি৷ ছবি : সংগৃহীত
সুমন গুপ্ত তাঁর দীর্ঘ লেখক ও সাংবাদিক জীবনে সান্নিধ্যলাভ করেছেন বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের। এবার তাঁদের সঙ্গে কাটানো কিছু বিশেষ মুহূর্ত টুকরো স্মৃতিকথা হিসেবে তিনি তাঁর ধারাবাহিক ‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় সঙ্গ’-তে আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন।
প্রায় ৫০ বছর আগের কথা। ওই দিনটা আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৭২ সালের পয়লা বৈশাখ। সেদিনই সকালে কিংবদন্তি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ ঘটেছিল আমার জীবনে। বিদ্রোহী কবিকে সামনে থেকে দেখেছিলাম। তাঁর মতো জগদ্বিখ্যাত এক বরণীয় মানুষের এই স্মরণীয় সঙ্গ আমার স্মৃতিপটে আঁকা হয়ে আছে গত ৫০ বছর ধরে। বিদ্রোহী কবিকে কীভাবে দেখার সুযোগ পেলাম এবার সেই প্রসঙ্গে ধীরে ধীরে আসা যাক।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হয়েছিলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। নরেন্দ্রপুরের আপাত গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে কলকাতার মতো সদাব্যস্ত ঝাঁ-চকচকে এক শহরের নামী কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। থাকতাম ২১৯/১ আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডের ওপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ হস্টেলে। একে বলা হত ‘হিন্দু হস্টেল’। কলেজ চত্বরে আরেকটা হস্টেল ছিল। এর নাম ‘খ্রিশ্চান হস্টেল’। সাধারণত হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা হিন্দু হস্টেলের আবাসিক। খ্রিশ্চান ছাত্ররা থাকত খ্রিস্টান হস্টেলে। আরেকটা কথাও জানিয়ে রাখি, আমাদের সময়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কো-এডুকেশন কলেজ ছিল না। ছাত্রীদের নেওয়া শুরু হয় অনেক বছর পর থেকে।
আমাদের হস্টেল থেকে কলেজ মিনিট কুড়ির হাঁটাপথ। সেই সময় কলকাতার রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। হস্টেলের সামনে রাস্তার দুদিকে বড় বড় গাছ ছিল। পরে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে প্রায় সব গাছই কাটা পড়ে।
হস্টেলের উলটোদিকের ফুটপাতে একটা চালু খাবারের দোকান ছিল। দোকানটা চালাত সন্দীপ সাহা নামে আমারই সমবয়সি এক যুবক। কলেজে যাতায়াতের পথে সন্দীপের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এই দোকানেই কাজী সব্যসাচীকে প্রথম দেখলাম। ৬ ফুটের ওপর লম্বা, সুপুরুষ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। অদ্ভুত এক আকর্ষণী দৃষ্টি দু-চোখে। আর ওই মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বর! যাঁর আবৃত্তি আর রেডিও প্রোগ্রাম শুনে আমরা অনেকেই একসময় বড় হয়েছি। কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে সন্দীপই আমায় পরিচয় করিয়ে দেয়। এত নামী একজন মানুষ অথচ ভীষণ ডাউন টু আর্থ ছিলেন কাজীদা। ক্রমশ তাঁর স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়লাম।
পদ্মপুকুর সিআইটি রোডে এক সাধারণ ফ্ল্যাটবাড়িতে বাবা কাজী নজরুলকে নিয়ে থাকতেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী। কাজীদার স্নেহ আরেকটু বেশি পেয়েছিলাম যখন শুনলেন আমি নরেন্দ্রপুরের ছাত্র। কারণ, কাজীদার ভাই কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ তখন নরেন্দ্রপুরে পড়াশোনা করছে। বিদ্রোহী কবি কেমন আছেন জানার অদম্য কৌতূহল আমার। একদিন একটু দোনামনা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কাজীদাকে। ভেবেছিলাম, হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। না, অসন্তুষ্ট হননি। বরং খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা ভালো আছেন। তুমি যাবে দেখতে?’ এরকম কিছু শুনব কল্পনাও করিনি। জীবন্ত কিংবদন্তি কবিকে দেখব, তাঁকে প্রণাম করব এ তো আমার স্বপ্ন! কাজীদা বললেন, ‘তুমি আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। সামনেই পয়লা বৈশাখ। সেদিন বাবার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেব।’ আর এর পর থেকেই আমার দিন গোনা শুরু। কাজীদা আরেকটা কথাও আমাকে বলেছিলেন—’হস্টেলের কাউকে বোলো না কাজী নজরুলকে তুমি দেখতে যাবে। একাই এসো। বেশি ভিড়ভাট্টা দেখলে বাবা উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন।’
পয়লা বৈশাখের সকাল। স্নান সেরে, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার হস্টেল থেকে সিআইটি রোড বেশি দূরেও নয়। পার্ক সার্কাস বাজার থেকে খানিকটা ফুল কিনলাম। মিষ্টিও ছিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পদ্মপুকুরে। বলা যায় প্রায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম। এতদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের পথে তখন একরকম বিভোর আমি। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললেন কাজী সব্যসাচী। যে ঘরে কবি রয়েছেন, আমাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। টেপরেকর্ডারে হালকা করে নজরুলগীতি বাজছিল। উঁচু খাটের উপর বসে রয়েছেন নজরুল। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কাজীদা বললেন, ‘একটু আগেই বাবাকে চান করানো হয়েছে। বুঝতেই পারছ এপ্রিল মাসের গরম। কাঠফাটা রোদ্দুর। সারাদিনে দু-তিনবার চান না করালে বাবার মাথা গরম হয়ে যায়। চিৎকার-চেঁচামেচি করে উঠতে পারেন।’
লক্ষ করলাম, নজরুলের অসাধারণ দুটি চোখ চারপাশে অনবরত ঘোরাফেরা করছে। এত তাড়াতাড়ি ঘোরাফেরা করছে বলে বোঝাতে পারব না। সেই মুহূর্তে কাজী নজরুলকেই দেখছিলাম। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় সেই কিংবদন্তিকে এত কাছ থেকে দেখে প্রাণ-মন কেমন করে উঠতে পারে আশাকরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে তা উপলব্ধির চেষ্টা চলছিল অবিরত। সময় যেন থমকে ছিল চার দেওয়ালের মধ্যে।
কাজী সব্যসাচী আমাকে একটু ইশারা করতেই ফুলগুলো কবির পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে একটু দূর থেকেই খাটে মাথা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। ফ্যানের রেগুলেটারটা একটু বাড়িয়ে দিলেন কাজীদা। কবির মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক প্রশান্তির ছাপ লক্ষ করলাম। কাজীদা বললেন, ‘তোমার কপাল ভালো সুমন, বাবার এখনও মুড ভালো আছে।’ একটা চেয়ার টেনে বসলাম। ইতিমধ্যে আরও দু-চারজন এসে কবিকে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে প্রণাম করে গেলেন। ধূপকাঠির মিষ্টি সুবাসে ঘর ম ম করছে।
আরও একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, নজরুলের একপাশে অনেক ম্যাগাজিন ও খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা। কাজী সব্যসাচী এবার স্মিত হেসে আমাকে বললেন, ‘ওগুলো ওখানে রেখেছি বাবার জন্যেই। মাঝে মাঝে বাবার মেজাজ খারাপ হলে সমানে কাগজ ছেঁড়েন। ঠিক বুঝতে পারি না হয়তো সেই সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার স্বাভাবিক নিয়মেই কাগজপত্র ছেঁড়াছেঁড়ি করেন।’ কাজীদার কথা শুনে খুব কষ্ট হল। যিনি অসহায় ও দুর্বল মানুষের মনের কথা তাঁর অজস্র কবিতা আর গানে আমাদের শুনিয়েছেন, অত্যাচারী আর শোষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, অত্যাচারিত ও শোষিতকে উদাত্ত কণ্ঠে বারবার শুনিয়েছেন মাভৈঃ মন্ত্র, সেই মহাকবি কাজী নজরুল আজ অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে নির্বাক, কত অসহায়। তাঁকে দেখে আমার দু’চোখ জলে ভরে এসেছিল।
নজরুল-প্রণামে পয়লা বৈশাখের দিনটা আমার এত সুন্দর কেটেছিল! একবুক সুখ আর হৃদয়ের পবিত্রতা নিয়ে হস্টেলে ফিরে এসেছিলাম। বন্ধুদের সবটা জানাতেই ওরা আপশোস করতে লাগল। এরকম এক বিশেষ দিনে বিদ্রোহী কবিকে ওরা দেখতে পেল না বলে। আরও কয়েকবার কবির আকর্ষণে আমি পদ্মপুকুরের বাড়িতে ছুটে গিয়েছি। চুপ করে বসে থেকেছি তাঁর সামনে। নজরুল ভাষাহীন তাতে কী! কেন জানি না বারবার মনে হয়েছে অমর কবি অন্তহীন কথা বলে চলেছেন আমার সঙ্গে। চোখের ভাষা, তারও যে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা। নজরুল আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন আর একটার পর একটা কাগজ আপনমনে কুচিকুচি করে ছিঁড়ছেন। আরেক দিন কাজী সব্যসাচী ‘বল বীর বল উন্নত মম শির!’ আবৃত্তি করে শোনালেন কবিকে। সেই মুহূর্তে কবি অদ্ভুত এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন। কাজীদার অননুকরণীয় কণ্ঠসম্পদ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই ছোট্ট ঘরে। পিতা-পুত্রের চিরকালীন সম্পর্কের এক আশ্চর্য ছবি দেখার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, সেই বিষণ্ণ বিকেলে।
এরপর কলকাতা ছেড়ে কাজী নজরুল বাংলাদেশে চলে যান। তাঁকে জাতীয় কবির সম্মান দিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ৭৭ বছর বয়সে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কাজী সব্যসাচীও অনেকদিন হল মারা গিয়েছেন। বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে আমার এই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অপূর্ণ রয়ে যাবে, যদি না আরেকজন জীবন্ত কিংবদন্তির নজরুল-প্রণামের কথা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ না করি। তিনি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এক সন্ধ্যায় তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে নানান কথাবার্তার সময় কাজী নজরুল ইসলামের কথা ওঠে। সন্ধ্যাদি বললেন, ‘এতবড় একজন কবিকে দেখা আমার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কাজী সব্যসাচী আকাশবাণী কলকাতার অ্যানাউন্সার ছিল। সব্যসাচী আমাকে প্রায়ই বলত, দিদি, মা আপনার গান এত ভালোবাসেন একবার দেখতে চান আপনাকে। একবার আসুন না আমাদের বাড়িতে। কবি তখন পাইকপাড়ায় থাকতেন। অবশ্য ততদিনে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুঃখের ব্যাপার কবির বোধশক্তিও ছিল না। আমার বিয়ের কয়েক বছর আগের কথা। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়েই সন্ধ্যার সময় আমার বউদি, আমার দিদির ছোটছেলে আর আমি তিনজনে মিলে সোজা পাইকপাড়ায় চলে গেলাম। তখন বর্ষাকাল ছিল। বর্ষাকালে তো নানান ধরনের ফুল ফোটে। চাঁপা, জুঁই আর বেলফুল অনেকটা করে নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে। মিষ্টিও নিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, কবি মিষ্টি পছন্দ করেন।
নজরুলের স্ত্রী প্রমীলাদেবী বাড়িতেই ছিলেন। খুব খুশি হলেন আমাদের দেখে। দেখলাম, স্নান করিয়ে নজরুলকে ধরে ধরে ওঁর ঘরে খাটের ওপর বসিয়ে দেওয়া হল। প্রমীলাদেবীকে দেখে তো আমার চোখের পলক পড়ে না। এত সুন্দরী ছিলেন। আর উনি তো আমার মায়েরই মতো। আমি একভাবে কাজী নজরুলকেই দেখছিলাম। তারপর একটা নজরুলগীতি গেয়েও শোনালাম। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, কাজী নজরুল সমানে কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছেন। কুচিকুচি করে ছিঁড়ছেন। বাড়ির লোকেরা বললেন, প্রতিদিন তাঁর জন্যে যে কত খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন জোগাড় করে রাখতে হয়। এই ছেঁড়াটাই ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
নজরুলের পায়ের কাছে ফুলগুলো নামিয়ে রেখে প্রণাম করতেই উনি ‘আঃ’ করে একটু চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে একটু সরে এলাম৷ মা (প্রমীলাদেবী) বললেন, উনি তোমাদের দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। প্রমীলা মাকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ভাবতে আমার অবাক লাগে কাজী নজরুল অল্প সময়ের মধ্যে যা সৃষ্টি করেছেন তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। যদি সুস্থ থাকতেন আরও কত কিছু আমাদের দিয়ে যেতে পারতেন।
ভগবানের কী অদ্ভুত বিচার! মাকে পরে দেখলাম, নজরুলের খাটের চেয়ে বেশ খানিকটা নীচে আরেকটা তক্তপোষে তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত পক্ষাঘাতে অবশ। দীর্ঘ কুন্তলরাশি এলিয়ে আছে। সেই তক্তপোষের তলায় রান্নার সব মশলাপাতি ও সাজসরঞ্জাম রয়েছে। আমার যতদূর মনে পড়ছে প্রমীলা মা আমাকে বলেছিলেন নজরুল তাঁর হাতের রান্না ছাড়া খেতে চাইতেন না। এত অসহায় অবস্থায়ও মা সবকিছু করে যেতেন। আজকের দিনে ভাবা যায় না।’
জানিয়ে রাখি, প্রমীলাদেবী বহুদিন আগে মারা যান। তাঁর অকাল মৃত্যুতে গোটা পরিবার ভেঙে পড়ে। বিদ্রোহী কবি জানতেও পারলেন না তাঁর প্রমীলা তাঁকে ছেড়ে বহুদূরে চলে গিয়েছেন।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাশ করে ভর্তি হয়েছিলাম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। নরেন্দ্রপুরের আপাত গ্রাম্য পরিবেশ ছেড়ে কলকাতার মতো সদাব্যস্ত ঝাঁ-চকচকে এক শহরের নামী কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। থাকতাম ২১৯/১ আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডের ওপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ হস্টেলে। একে বলা হত ‘হিন্দু হস্টেল’। কলেজ চত্বরে আরেকটা হস্টেল ছিল। এর নাম ‘খ্রিশ্চান হস্টেল’। সাধারণত হিন্দু ও মুসলমান ছাত্ররা হিন্দু হস্টেলের আবাসিক। খ্রিশ্চান ছাত্ররা থাকত খ্রিস্টান হস্টেলে। আরেকটা কথাও জানিয়ে রাখি, আমাদের সময়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কো-এডুকেশন কলেজ ছিল না। ছাত্রীদের নেওয়া শুরু হয় অনেক বছর পর থেকে।
আমাদের হস্টেল থেকে কলেজ মিনিট কুড়ির হাঁটাপথ। সেই সময় কলকাতার রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। হস্টেলের সামনে রাস্তার দুদিকে বড় বড় গাছ ছিল। পরে রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে প্রায় সব গাছই কাটা পড়ে।
হস্টেলের উলটোদিকের ফুটপাতে একটা চালু খাবারের দোকান ছিল। দোকানটা চালাত সন্দীপ সাহা নামে আমারই সমবয়সি এক যুবক। কলেজে যাতায়াতের পথে সন্দীপের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এই দোকানেই কাজী সব্যসাচীকে প্রথম দেখলাম। ৬ ফুটের ওপর লম্বা, সুপুরুষ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। অদ্ভুত এক আকর্ষণী দৃষ্টি দু-চোখে। আর ওই মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বর! যাঁর আবৃত্তি আর রেডিও প্রোগ্রাম শুনে আমরা অনেকেই একসময় বড় হয়েছি। কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে সন্দীপই আমায় পরিচয় করিয়ে দেয়। এত নামী একজন মানুষ অথচ ভীষণ ডাউন টু আর্থ ছিলেন কাজীদা। ক্রমশ তাঁর স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়লাম।
পদ্মপুকুর সিআইটি রোডে এক সাধারণ ফ্ল্যাটবাড়িতে বাবা কাজী নজরুলকে নিয়ে থাকতেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী। কাজীদার স্নেহ আরেকটু বেশি পেয়েছিলাম যখন শুনলেন আমি নরেন্দ্রপুরের ছাত্র। কারণ, কাজীদার ভাই কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ তখন নরেন্দ্রপুরে পড়াশোনা করছে। বিদ্রোহী কবি কেমন আছেন জানার অদম্য কৌতূহল আমার। একদিন একটু দোনামনা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কাজীদাকে। ভেবেছিলাম, হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। না, অসন্তুষ্ট হননি। বরং খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা ভালো আছেন। তুমি যাবে দেখতে?’ এরকম কিছু শুনব কল্পনাও করিনি। জীবন্ত কিংবদন্তি কবিকে দেখব, তাঁকে প্রণাম করব এ তো আমার স্বপ্ন! কাজীদা বললেন, ‘তুমি আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। সামনেই পয়লা বৈশাখ। সেদিন বাবার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেব।’ আর এর পর থেকেই আমার দিন গোনা শুরু। কাজীদা আরেকটা কথাও আমাকে বলেছিলেন—’হস্টেলের কাউকে বোলো না কাজী নজরুলকে তুমি দেখতে যাবে। একাই এসো। বেশি ভিড়ভাট্টা দেখলে বাবা উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন।’
পয়লা বৈশাখের সকাল। স্নান সেরে, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার হস্টেল থেকে সিআইটি রোড বেশি দূরেও নয়। পার্ক সার্কাস বাজার থেকে খানিকটা ফুল কিনলাম। মিষ্টিও ছিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পদ্মপুকুরে। বলা যায় প্রায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম। এতদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের পথে তখন একরকম বিভোর আমি। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললেন কাজী সব্যসাচী। যে ঘরে কবি রয়েছেন, আমাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। টেপরেকর্ডারে হালকা করে নজরুলগীতি বাজছিল। উঁচু খাটের উপর বসে রয়েছেন নজরুল। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কাজীদা বললেন, ‘একটু আগেই বাবাকে চান করানো হয়েছে। বুঝতেই পারছ এপ্রিল মাসের গরম। কাঠফাটা রোদ্দুর। সারাদিনে দু-তিনবার চান না করালে বাবার মাথা গরম হয়ে যায়। চিৎকার-চেঁচামেচি করে উঠতে পারেন।’
লক্ষ করলাম, নজরুলের অসাধারণ দুটি চোখ চারপাশে অনবরত ঘোরাফেরা করছে। এত তাড়াতাড়ি ঘোরাফেরা করছে বলে বোঝাতে পারব না। সেই মুহূর্তে কাজী নজরুলকেই দেখছিলাম। বাংলাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় সেই কিংবদন্তিকে এত কাছ থেকে দেখে প্রাণ-মন কেমন করে উঠতে পারে আশাকরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে তা উপলব্ধির চেষ্টা চলছিল অবিরত। সময় যেন থমকে ছিল চার দেওয়ালের মধ্যে।
কাজী সব্যসাচী আমাকে একটু ইশারা করতেই ফুলগুলো কবির পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে একটু দূর থেকেই খাটে মাথা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। ফ্যানের রেগুলেটারটা একটু বাড়িয়ে দিলেন কাজীদা। কবির মুখমণ্ডলে আশ্চর্য এক প্রশান্তির ছাপ লক্ষ করলাম। কাজীদা বললেন, ‘তোমার কপাল ভালো সুমন, বাবার এখনও মুড ভালো আছে।’ একটা চেয়ার টেনে বসলাম। ইতিমধ্যে আরও দু-চারজন এসে কবিকে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করে প্রণাম করে গেলেন। ধূপকাঠির মিষ্টি সুবাসে ঘর ম ম করছে।
আরও একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, নজরুলের একপাশে অনেক ম্যাগাজিন ও খবরের কাগজ ডাঁই করে রাখা। কাজী সব্যসাচী এবার স্মিত হেসে আমাকে বললেন, ‘ওগুলো ওখানে রেখেছি বাবার জন্যেই। মাঝে মাঝে বাবার মেজাজ খারাপ হলে সমানে কাগজ ছেঁড়েন। ঠিক বুঝতে পারি না হয়তো সেই সময় তাঁর শারীরিক অবস্থার স্বাভাবিক নিয়মেই কাগজপত্র ছেঁড়াছেঁড়ি করেন।’ কাজীদার কথা শুনে খুব কষ্ট হল। যিনি অসহায় ও দুর্বল মানুষের মনের কথা তাঁর অজস্র কবিতা আর গানে আমাদের শুনিয়েছেন, অত্যাচারী আর শোষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, অত্যাচারিত ও শোষিতকে উদাত্ত কণ্ঠে বারবার শুনিয়েছেন মাভৈঃ মন্ত্র, সেই মহাকবি কাজী নজরুল আজ অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে নির্বাক, কত অসহায়। তাঁকে দেখে আমার দু’চোখ জলে ভরে এসেছিল।
নজরুল-প্রণামে পয়লা বৈশাখের দিনটা আমার এত সুন্দর কেটেছিল! একবুক সুখ আর হৃদয়ের পবিত্রতা নিয়ে হস্টেলে ফিরে এসেছিলাম। বন্ধুদের সবটা জানাতেই ওরা আপশোস করতে লাগল। এরকম এক বিশেষ দিনে বিদ্রোহী কবিকে ওরা দেখতে পেল না বলে। আরও কয়েকবার কবির আকর্ষণে আমি পদ্মপুকুরের বাড়িতে ছুটে গিয়েছি। চুপ করে বসে থেকেছি তাঁর সামনে। নজরুল ভাষাহীন তাতে কী! কেন জানি না বারবার মনে হয়েছে অমর কবি অন্তহীন কথা বলে চলেছেন আমার সঙ্গে। চোখের ভাষা, তারও যে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা। নজরুল আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন আর একটার পর একটা কাগজ আপনমনে কুচিকুচি করে ছিঁড়ছেন। আরেক দিন কাজী সব্যসাচী ‘বল বীর বল উন্নত মম শির!’ আবৃত্তি করে শোনালেন কবিকে। সেই মুহূর্তে কবি অদ্ভুত এক দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন। কাজীদার অননুকরণীয় কণ্ঠসম্পদ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই ছোট্ট ঘরে। পিতা-পুত্রের চিরকালীন সম্পর্কের এক আশ্চর্য ছবি দেখার বিরল অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার, সেই বিষণ্ণ বিকেলে।
এরপর কলকাতা ছেড়ে কাজী নজরুল বাংলাদেশে চলে যান। তাঁকে জাতীয় কবির সম্মান দিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ৭৭ বছর বয়সে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কাজী সব্যসাচীও অনেকদিন হল মারা গিয়েছেন। বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে আমার এই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অপূর্ণ রয়ে যাবে, যদি না আরেকজন জীবন্ত কিংবদন্তির নজরুল-প্রণামের কথা এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ না করি। তিনি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এক সন্ধ্যায় তাঁর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে নানান কথাবার্তার সময় কাজী নজরুল ইসলামের কথা ওঠে। সন্ধ্যাদি বললেন, ‘এতবড় একজন কবিকে দেখা আমার জীবনের স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কাজী সব্যসাচী আকাশবাণী কলকাতার অ্যানাউন্সার ছিল। সব্যসাচী আমাকে প্রায়ই বলত, দিদি, মা আপনার গান এত ভালোবাসেন একবার দেখতে চান আপনাকে। একবার আসুন না আমাদের বাড়িতে। কবি তখন পাইকপাড়ায় থাকতেন। অবশ্য ততদিনে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুঃখের ব্যাপার কবির বোধশক্তিও ছিল না। আমার বিয়ের কয়েক বছর আগের কথা। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়েই সন্ধ্যার সময় আমার বউদি, আমার দিদির ছোটছেলে আর আমি তিনজনে মিলে সোজা পাইকপাড়ায় চলে গেলাম। তখন বর্ষাকাল ছিল। বর্ষাকালে তো নানান ধরনের ফুল ফোটে। চাঁপা, জুঁই আর বেলফুল অনেকটা করে নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে। মিষ্টিও নিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, কবি মিষ্টি পছন্দ করেন।
নজরুলের স্ত্রী প্রমীলাদেবী বাড়িতেই ছিলেন। খুব খুশি হলেন আমাদের দেখে। দেখলাম, স্নান করিয়ে নজরুলকে ধরে ধরে ওঁর ঘরে খাটের ওপর বসিয়ে দেওয়া হল। প্রমীলাদেবীকে দেখে তো আমার চোখের পলক পড়ে না। এত সুন্দরী ছিলেন। আর উনি তো আমার মায়েরই মতো। আমি একভাবে কাজী নজরুলকেই দেখছিলাম। তারপর একটা নজরুলগীতি গেয়েও শোনালাম। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, কাজী নজরুল সমানে কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছেন। কুচিকুচি করে ছিঁড়ছেন। বাড়ির লোকেরা বললেন, প্রতিদিন তাঁর জন্যে যে কত খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন জোগাড় করে রাখতে হয়। এই ছেঁড়াটাই ওঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
নজরুলের পায়ের কাছে ফুলগুলো নামিয়ে রেখে প্রণাম করতেই উনি ‘আঃ’ করে একটু চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে একটু সরে এলাম৷ মা (প্রমীলাদেবী) বললেন, উনি তোমাদের দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। প্রমীলা মাকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ভাবতে আমার অবাক লাগে কাজী নজরুল অল্প সময়ের মধ্যে যা সৃষ্টি করেছেন তার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। যদি সুস্থ থাকতেন আরও কত কিছু আমাদের দিয়ে যেতে পারতেন।
ভগবানের কী অদ্ভুত বিচার! মাকে পরে দেখলাম, নজরুলের খাটের চেয়ে বেশ খানিকটা নীচে আরেকটা তক্তপোষে তিনি শুয়ে আছেন। তাঁর কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত পক্ষাঘাতে অবশ। দীর্ঘ কুন্তলরাশি এলিয়ে আছে। সেই তক্তপোষের তলায় রান্নার সব মশলাপাতি ও সাজসরঞ্জাম রয়েছে। আমার যতদূর মনে পড়ছে প্রমীলা মা আমাকে বলেছিলেন নজরুল তাঁর হাতের রান্না ছাড়া খেতে চাইতেন না। এত অসহায় অবস্থায়ও মা সবকিছু করে যেতেন। আজকের দিনে ভাবা যায় না।’
জানিয়ে রাখি, প্রমীলাদেবী বহুদিন আগে মারা যান। তাঁর অকাল মৃত্যুতে গোটা পরিবার ভেঙে পড়ে। বিদ্রোহী কবি জানতেও পারলেন না তাঁর প্রমীলা তাঁকে ছেড়ে বহুদূরে চলে গিয়েছেন।