ছবি : প্রতীকী।
প্রণয় যে বাবলিকে খুব একটা সহ্য করতে পারতো না সেটা ন’কাকিমা ভিতরে ভিতরে উপভোগ করতেন। ইংরিজিতে ‘মাদার-ইন-ল’ সিন্ড্রোম বলে একটা কথা আছে, যার সঠিক বাংলা হতে পারে ‘শাশুড়িগিরি’। সুজাতা এমনিতেই অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ মহিলা। তিনি নিজে দেখে ছেলের বউ করেছিলেন বাবলিকে। অথচ প্রণয় বাবলির সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করছে এটা জেনেও প্রণয়কে কিছু বলতেন না। এটা কলেজের আদি অনন্তকাল ধরে চলে আসা র্যাগিং, নিজেদের র্যাগিং-এর শোধ তুলতে পরের ব্যাচকে র্যাগিং করা। সুজাতা নিজেকে বসুন্ধরা ভিলায় মানিয়ে নিতে পারেননি। সকলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন। ন’কাকার সঙ্গে কিছুতেই তার জীবনকে ছন্দে বাঁধতে পারেননি। ন’কাকা পক্ষাঘাতে যেবার পায়ের জোর চিরকালের মতো হারিয়ে ফেললেন তখন থেকে দু’জনের সম্পর্কের সুতো আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। সুজাতা কর্তৃত্ব চালাতেন। কিন্তু বাবলির সঙ্গে ক্লাবের ঘটনাটা ঘটবার পর ন’কাকা আচমকা কঠিন হয়ে উঠলেন। এককথায় সবকিছু বাবলির নামে করে দিলেন। এরপর ন’কাকা কোনওভাবেই ন’কাকিমাকে জায়গা দিতেন না। ন’কাকীমা বুঝতেন শান্তশিষ্ট মানুষ যখন বেপরোয়া হয়ে ওঠে তখন তাকে বেশী ঘাঁটানো উচিত নয়।
দিল্লিতে সামরিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েও ন’ কাকিমা তন্ত্রমন্ত্র বশীকরণ বাণমারা। এসব কালা জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকে বিশ্বাস করতেন। দিল্লি কালীবাড়িতে নাকি একজন তান্ত্রিক আসতেন। তাঁর কাছেই অবিবাহিতা সুজাতা এবং তাঁর মা ঘনঘন যেতেন। সেই তান্ত্রিকবাবাকে নিয়ে কি একটা সমস্যা হবার পর কালীবাড়ি কমিটি কালীবাড়ির মধ্যে তার বসার ওপর নিষেধ জারি করেন। এরপর থেকেই তিনি চিত্তরঞ্জন পার্কে এক বিশেষ ভক্তের বাড়িতে আসতেন। সেই তান্ত্রিক শঙ্করবাবাই সুজাতার কপাল পড়ে বলেছিলেন এ মেয়ে রাজরানি হবে। এই মেয়ের গর্ভের পুত্রসন্তান সেই বিপুল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশন হবে। এরই কিছুদিন পর ফুলকাকা ডাক্তার বিমলকান্তির সঙ্গে সুজাতার সম্বন্ধ করেছিলেন ডাক্তার বিমলকান্তির বম্বের শিবাজীপার্কের মেজমাসি সুলক্ষণা। সুজাতা এবং সুজাতার মা দেখলেন তন্ত্রসাধক শংকরবাবার ভবিষ্যতবাণী ফলে যাচ্ছে। তবে সুজাতা দাদা কর্নেল শুকদেব বসু রায়ের ধর্মবিশ্বাস-এর শুরু তাঁর বিয়ের পর থেকে। সুজাতার বৌদির গুরুদেবই দাদার গুরুদেব। বম্বের শিবাজীপার্কের মেজমাসি সুলক্ষণা ও মেসো চঞ্চল কুমার ঘোষেরও সেই একই গুরু, এরা সব পরস্পরের গুরুভাই গুরুবোন। তাঁদের গুরুদেব পাহাড়জঙ্গলে কাটান মাঝেমধ্যে বিদেশে পাড়ি দেন। সেবার এসেছিলেন দিল্লিতে এক ভক্তের কাছে। সেখানেই মেজোমাসি সুলক্ষণা ডাক্তার বোনপো বিমলেন্দুর জন্মতারিখসহ গুরুদেবকে সুজাতার জন্মছক দেখালেন। মিলিয়ে দেখেগুরুদেব বলেছিলেন, যদি এ বিয়ে হয় তাহলে রাজযোটক!
আরও পড়ুন:
বসুন্ধরা এবং…, ৩য় খণ্ড, পর্ব-৪৭: গোপনীয়তা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’
এখানে বোঝা যাচ্ছে পেশাদার গুরুদেব, তাই তাঁর মন্তব্যে একটি ডিসক্লেমার রেখেছিলেন, যদি এ বিয়ে হয়! সুজাতা এবং তাঁর মা দেখলেন শঙ্করবাবা এবং গুরুদেব দুজনের কথাই মিলে যাচ্ছে। পুরাণে বা ঐতিহাসিক যুগে এইসব ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিতে যুদ্ধবিগ্রহ কম হয়নি। কিন্তু মানুষ যখন চাঁদে পা দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে এল। তারপরও এই ভবিষ্যৎবাণীর এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণ নেই। জ্যোতিষশাস্ত্র একটা অন্য জিনিস। একটা সাবধানতা। বর্ষাকালে হাতে ছাতা নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর উপদেশ। বৃষ্টির জন্য তৈরি থাকা। বৃষ্টি এলে ছাতা বাঁচাবে। তবে যদি ভয়ংকর ঝড়তুফান হয় তখন কি আর ছাতা বাঁচাতে পারবে?
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে
কিন্তু সুজাতা ও তাঁর মা এই ভবিষ্যদ্বাণীকে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই যখন ফুলকাকা বিয়ে করতে রাজি না হয়ে বিদেশ চলে গেলেন। তখন গোটা পরিবারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তবু আগের ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েটা হবার প্রস্তাব আসায় দাদা-বৌদি নিমরাজি হলেও সুজাতা নিজে এবং তাঁর মা সোৎসাহে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন, কারণ তান্ত্রিকের কথা মিলছে। যে কোনও না কোনওভাবে রাজরানি তো হচ্ছে সুজাতা।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে
তবে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে খুব একটা যাতায়াত বা যোগাযোগ ন’কাকার ছিল না। একবার বা দুবার দিল্লি গিয়ে সুজাতার বন্ধু-বান্ধব মহল দেখে চিত্রকর তরুণকান্তির ভালো লাগেনি। মায়ের কথা ভেবে বসুন্ধরা ভিলার সম্মানের কথা ভেবে তার বিবাহিত জীবনের গরল পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন তরুণকান্তি। সেই তরুণকান্তি ক্রমশ বদলে গিয়েছেন। আর সেদিন মৃতপ্রায় শালক শুকদেব বসুরায়ের সঙ্গে একান্তে আলাপচারিতার পর তরুণকান্তিকে আর মেলানো যাচ্ছে না। এমনকি খুব চেনা সেজবৌদি সুরঙ্গমা বা সেজদাদা সাহিত্যক অমলকান্তিও এমন অস্থির তরুণকান্তিকে আগে কখনও দেখেননি।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
ছেলে প্রণয়কান্তিকে নিয়ে বাবলির বেড়িয়ে আসাটা সুজাতা এখনও মেনে নিতে পারেননি। খানিকটা সেই ক্ষোভেই সুজাতা স্বামী তরুণকান্তিকে বলে উঠলেন—
—এক্সাক্টলি ঠিক কী করতে চাইছো একটু বলতো! কোনও রহস্য সমাধান করবে আজ?
তরুণকান্তি তাঁর দিকে না থাকিয়ে পকেট থেকে দু-তিন পাতার একটা চিঠি বের করলেন! সুজাতাকে কাগজের লেখাটা দেখিয়ে অত্যন্ত ধীর স্থির শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন—
—হাতের লেখাটা চেনা লাগছে! তবে অসুস্থ মানুষ বিছানায় শুয়ে লিখেছেন। কিন্তু যা লিখেছেন সেটা পড়ে দেখো, অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে। যদি না পার দাদার কাছে দিল্লি গিয়ে খোঁজ নিও। তিনি এখনও বেঁচে আছেন, মনে করিয়ে দেবেন।
ঘরের আর কেউ চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা দেখতে পাননি। যিনি দেখতে পেয়েছেন তিনি আমার ন’কাকিমা সুজাতা। কাগজটা দেখে এমন দাপুটে সর্বক্ষণ অপরকে আক্রমণ করে কথাবলা মহিলার মুখটা রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তিনি কোনওক্রমে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন।—চলবে।
—এক্সাক্টলি ঠিক কী করতে চাইছো একটু বলতো! কোনও রহস্য সমাধান করবে আজ?
তরুণকান্তি তাঁর দিকে না থাকিয়ে পকেট থেকে দু-তিন পাতার একটা চিঠি বের করলেন! সুজাতাকে কাগজের লেখাটা দেখিয়ে অত্যন্ত ধীর স্থির শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন—
—হাতের লেখাটা চেনা লাগছে! তবে অসুস্থ মানুষ বিছানায় শুয়ে লিখেছেন। কিন্তু যা লিখেছেন সেটা পড়ে দেখো, অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে। যদি না পার দাদার কাছে দিল্লি গিয়ে খোঁজ নিও। তিনি এখনও বেঁচে আছেন, মনে করিয়ে দেবেন।
ঘরের আর কেউ চিঠিতে কি লেখা আছে সেটা দেখতে পাননি। যিনি দেখতে পেয়েছেন তিনি আমার ন’কাকিমা সুজাতা। কাগজটা দেখে এমন দাপুটে সর্বক্ষণ অপরকে আক্রমণ করে কথাবলা মহিলার মুখটা রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তিনি কোনওক্রমে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন।—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com