বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

নদীতে খেয়া দেয় ঈশ্বরী, অন্নপূর্ণা তাঁর নৌকায় পার হবেন নদী। যিনি ভবনদীর তারিণী, তাঁকেই পার করাবে ওই মাঝি। স্বামীর পরিচয় দিতে গিয়ে দেবী বলেছিলেন, তাঁর মন্দ কপালে জোটা ওই স্বামীর কোনও গুণ নেই, গুণহীন সেই স্বামীর কপালে আগুন বটে। মাঝি বুঝেছিল কি যে দেবী পতিনিন্দা না করে ব্যাজস্তুতির আশ্রয় নিয়েছেন, আর যাঁর কথা বলছেন তিনি ত্রিগুণাতীত, তাঁর কপালে অগ্নিময় তৃতীয় নেত্র সদা প্রোজ্জ্বল! ভারতচন্দ্র তা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি।

তবে ওই গুণহীন, নির্গুণ আর ত্রিগুণাতীতের জায়গাটা ধরে ধরে গীতায় পৌঁছে দেখা যাবে, সাত্ত্বিক, রাজসিক আর তামসিক মানুষ এই ত্রিবিধ গুণকে মুখ্যতঃ বহন করে চলে। সাংখ্যদর্শনের সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, ত্রিগুণ সাম্যাবস্থায় থাকলে সৃষ্টিক্রিয়ার সূচনা ঘটে না। মন্দ্রমধুর বাদ্যে স্বরের উত্থানপতনে যেমন গভীর রবে আনন্দনাদের অভ্যুত্থান, তেমনই যেন গুণগুলির বিক্ষোভে সাম্যাবস্থার জাড্য ভেঙে তরুণ নির্ঝরের মতোই এক বিপুল চাঞ্চল্যের পথ বেয়ে জাগরণ ঘটে প্রাণের। এরপর কোথাও কোনওগুণের আধিক্য, কোথাও আবার কম পড়ে কিছু।
যে মানুষকে দুরাচারী মনে হচ্ছে, তার চরিত্রেও কোথাও শুভ সুপ্ত আছে। যে সদা-হাসিমুখে তোমাকে আশ্বাস দিচ্ছে, সেও তোমার অলক্ষ্যে নেহাত্ বাঁকা। যে বুঝি সকলকে করায়ত্ত করতে চায়, দমিয়ে নিজের বজ্রমুষ্টিতে পুরে রেখেই যার আনন্দ, তার অসহায়তা তুমি দেখেছো কখনও? দিনের শেষে যোদ্ধাও মানুষ, রাজাও তোমার মতোই শোণিত পেশীতে গড়া জীব বৈ কিছু নয়। যে ছুরি হাতে আজ রুদ্ররূপ, কাল সেই মঙ্গলময় শিব। আজ যে ভাবছে কিছুই হবে না বুঝি, কাল তার দিনবদলের পালা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’

আজ যে ক্ষুদ্র, কাল সে বৃহৎ। আজ যে দীন, কাল সে-ই দীনবন্ধু। যাকে যতটা ভালো ভাবো সে হয়তো ততো ভালো নয়। যাকে যতটা খারাপ ভেবেছো, সেও ততটা খারাপ নয়। দোষে-গুণে যে পূর্ণ হয়ে যে জীবদেহ আর প্রাণের খেলা তার গুণের ভাণ্ডারে ত্রিবিধ গুণের টানাপোড়েন চলছে অবিরত। যে সত্ত্বগুণে মহান, তার বুদ্ধি, মন নিষ্কলুষ। নির্মলতাই তার বৈশিষ্ট্য, সুখ তার মজ্জায়, জ্ঞান তার শোণিতে, বুদ্ধিতে পরম চৈতন্যের অমলিন প্রতিভাস। মুকুরে অনন্তগামী শুভ্র মেঘের বিমল বিম্ব যেমন স্বচ্ছ-সুন্দর, তেমনই সত্ত্বগুণে গুণী মানুষের প্রকাশ। কিন্তু এতেও তো অহংবোধ উপশান্ত হয় না, নিজেকে অপরাপর ভিন্নধর্মী জীবের থেকে পৃথক, মহত্তর, বৃহত্তর ভাবায় যে সুখ সেই সুখের বোধ আর যাই হোক, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া জাগানোর পথটিকে কণ্টকময় করেই রাখে। এই হল সত্ত্বগুণের সব পেয়েছির মাঝে দোষের স্থান।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে

রজোগুণে পার্থিব সুখের ভোগাকাঙ্ক্ষা ও ভোগ-ই প্রধান। তার মাঝেও কিছু ইতিবাচক দিক থাকে। রজোগুণ বাসনার রঙে রাজকীয়, মহার্ঘ্য। তবে ভোগসুখের এই বাসনা তাকে দেয় নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা। তা থেকে আসে উদ্যোগ, কর্মক্ষমতা। অপরিসীম কর্মোদ্যোগেই রজোগুণের ইতিবাচক দিকটির প্রকাশ।

আর তমোগুণ? তা যাবতীয় কলুষতার আকর, বড়ই দোষাবহ। তমোগুণের প্রাবল্য আনে আলস্য, কেড়ে নেয় কর্মোদ্যোগ। সেখানে কোনও সদর্থক বিষয় নেই, নিষ্কলুষ শুভ্রতার বিপরীতে এক অমানিশায় আচ্ছন্ন তমোগুণ অপ্রতিহত ও ভীষণ।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে

যে ব্যক্তি এই তিনগুণের কোনও একটির প্রাবল্যে পুষ্ট সে সেই গুণের অধিকারী। তার চরিত্রে সেই গুণটির আধিক্য প্রভাব রেখে যায়। তবে অন্য গুণগুলিও সেখানে ক্রিয়াশীল, সময়ে সময়ে তাদের রূপবৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে বৈকী!

পৃথিবীর মাটি মধুময়। পার্থিব জীবনে নানা গুণপরিমিত শরীর নিয়ে জীব নানা প্রতিক্রিয়া রেখে যায়। পৃথিবীতে মানুষ মহত্তর হতে পারে, হতে পারে নরচন্দ্রমা। কর্মের বিপুল প্রভাব জীবের পথ বেঁধে দেয়। সমাজে, ব্যক্তি ও বৃহত্তর জীবনে, হয়তো অন্য জীবনে, জগতেও। তত্ত্ব বলবে, ত্রিগুণাতীত জীব সীমা থেকে অসীমে মেশে। তিনটি গুণের কোনওটিও থাকলে আসে আসক্তি। আসক্তি থেকে বন্ধন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর

অর্জুনের মতো জীবাত্মারা যাদের কেউ সাত্ত্বিক, কেউ রাজসিক, কেউ তামসিক, যাদের নির্মল জ্ঞান, বিপুল কর্মোদ্যোগ কিংবা কর্মবিমুখ আলস্যের ভার তাদের পূর্ণ হতে দেয় না। আত্মশক্তির উদ্বোধন তাদের ঘটে না, থেকে যায় অপূর্ণ। কখনও তারা সংসার-সংগ্রামে উন্মুখ অথবা পরাঙ্মুখ। দ্রোহ, ভয়, সংশয়জর্জর দ্বন্দ্বদীর্ণ দুরাকাঙ্ক্ষার শেষে ভেঙে পড়া। সারথি কৃষ্ণের মতোই পরমসত্তা মোহপাশ কাটিয়ে সত্যস্বরূপকে উন্মোচিত করছেন মুহুর্মুহু। চারপাশে জমে ওঠা কুয়াশার স্তর দীনবন্ধুকে কখনও প্রকট, কখনও প্রচ্ছন্ন রাখে। তাকে ভেদ করেই পেতে হয় প্রাণসখা, পরমগুরুকে। গীতা এই আত্মবিস্মরণকে অতিক্রম করে আত্মসন্ধান, আত্মজাগরণ, আত্মমর্যাদা, আত্মসমর্পণের কথা বলে।
* গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে (A Special Write Up on Shrimad Bhagwat Gita): লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content