ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
পঞ্চপাণ্ডব এখন বিবাহিত। বৈবাহিক সম্পর্কে তাঁরা দ্রুপদরাজের জামাতা। এ খবর অপরাপর রাজবৃন্দের কানে গেল, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুর্যোধন, তাঁর ভায়েরা, বন্ধু কর্ণ এবং তাঁর সমর্থকরা সকলে শুনলেন। শৈশব থেকেই যাঁরা পাণ্ডবদের প্রতি ঈর্ষাকাতর তাঁরা পাণ্ডবদের এই সৌভাগ্যের বৃত্তান্ত জেনে, যথারীতি বিষণ্ণ হলেন। কুরুরাজ, পুত্রস্নেহান্ধ, পিতা ধৃতরাষ্ট্র, দ্রুপদরাজ্যে দ্রুপদকন্যার স্বয়ংবর সভায়, নিজপুত্রদের পরাজয় ও বিজয়ী পাণ্ডবদের সাফল্য সম্বন্ধে অবহিত হলেন। বলাইবাহুল্য, এ খবর ছিল তাঁর কাছে হৃদয়বিদারক। পাণ্ডবরা কৌরবদের পরিকল্পিত জতুগৃহদহন থেকে মুক্ত হয়ে জীবিত আছেন,পরাক্রমশালী দ্রুপদরাজের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, এ সংবাদ শ্রুতিসুখকর নয় মোটেই। পাণ্ডবদের ঐক্যে চিড় ধরানোর জন্যে, দুর্যোধনের উদ্ভাবিত চক্রান্তের পরিকল্পনায় সায় দিলেন পিতা ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধনের সাথী তাঁর উপদেষ্টা ও বন্ধু কর্ণ।
ধৃতরাষ্ট্রপুত্র পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে আগ্রহী। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ, পাণ্ডবদের দ্রুপদরাজ্যে আশ্রয়চ্যুত করতে হবে। এ বিষয়ে, দুর্যোধনের প্রস্তাব হল—দ্রুপদরাজকে ধনসামগ্রী উপহার দিয়ে নিজদলভুক্ত করে, দ্রুপদরাজের সাহায্যে, পাণ্ডবদের দ্রুপদরাজ্য থেকে বিতারণ। এ ছাড়াও বিভেদ সৃষ্টির আরও দুটি উপায়—পাণ্ডবদের সৌভ্রাতৃত্ববোধে ভাঙনসৃষ্টি কিংবা স্বামীস্ত্রীর দাম্পত্যপ্রেমে অবিশ্বাস সৃষ্টি করা। বিপরীতভাবে স্ত্রীর প্রতি পঞ্চ পাণ্ডবের বিরাগজন্মানো। আরও একটি উপায়—পাণ্ডবদের শক্তির উৎস ভীমসেনের নিধন। ফল হল, পাণ্ডবদের শক্তিহ্রাস ও তাঁদের নিষ্ক্রিয়তা। কুরুরাজ্যে দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবদের এনে, তাঁদের হেনস্থা করা। আরও একটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল, দ্রৌপদীর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিনী পাঠিয়ে, স্ত্রীর প্রতি, পাণ্ডবদের অনাস্থাসৃষ্টি। এগুলি অবলম্বন করে কুরুরাজ্যে উপস্থিত পাণ্ডবদের একে একে হত্যাই ছিল দুর্যোধনকৃত পরিকল্পনার লক্ষ্য।
ধৃতরাষ্ট্রপুত্র পাণ্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে আগ্রহী। তাঁর প্রথম পদক্ষেপ, পাণ্ডবদের দ্রুপদরাজ্যে আশ্রয়চ্যুত করতে হবে। এ বিষয়ে, দুর্যোধনের প্রস্তাব হল—দ্রুপদরাজকে ধনসামগ্রী উপহার দিয়ে নিজদলভুক্ত করে, দ্রুপদরাজের সাহায্যে, পাণ্ডবদের দ্রুপদরাজ্য থেকে বিতারণ। এ ছাড়াও বিভেদ সৃষ্টির আরও দুটি উপায়—পাণ্ডবদের সৌভ্রাতৃত্ববোধে ভাঙনসৃষ্টি কিংবা স্বামীস্ত্রীর দাম্পত্যপ্রেমে অবিশ্বাস সৃষ্টি করা। বিপরীতভাবে স্ত্রীর প্রতি পঞ্চ পাণ্ডবের বিরাগজন্মানো। আরও একটি উপায়—পাণ্ডবদের শক্তির উৎস ভীমসেনের নিধন। ফল হল, পাণ্ডবদের শক্তিহ্রাস ও তাঁদের নিষ্ক্রিয়তা। কুরুরাজ্যে দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবদের এনে, তাঁদের হেনস্থা করা। আরও একটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল, দ্রৌপদীর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিনী পাঠিয়ে, স্ত্রীর প্রতি, পাণ্ডবদের অনাস্থাসৃষ্টি। এগুলি অবলম্বন করে কুরুরাজ্যে উপস্থিত পাণ্ডবদের একে একে হত্যাই ছিল দুর্যোধনকৃত পরিকল্পনার লক্ষ্য।
দুর্যোধন, এই প্রস্তাবগুলি ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্য সহচরদের সামনে উপস্থাপিত করে, বন্ধুবর কর্ণের অভিমত জানতে চাইলেন। এ বার কর্ণের, এ বিষয়ে মত প্রকাশের পালা। কর্ণ এককথায় দুর্যোধনের সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করলেন। দুর্যোধনের বুদ্ধি অনুসারে, কূটকৌশলগুলি যথাযথ নয়, এগুলির সাহায্যে পাণ্ডবদের অত্যাচার করা সম্ভব নয়।
এর আগেও বহু সূক্ষ্ম গুপ্ত উপায়ে (যেমন, শৈশবে বিষপ্রয়োগ করে ভীমসেনকে হত্যার চেষ্টা, জতুগৃহে পাণ্ডবদের দগ্ধ করে হত্যার পরিকল্পনা প্রভৃতি) তাঁদেরকে অত্যাচারের চেষ্টা সফল হয়নি। কর্ণের যুক্তি, শৈশবে সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবরা নিকটেই ছিলেন, তখন তাঁদের নির্যাতন করা সম্ভব হয়নি। কর্ণের মত হল, এখন পাণ্ডবদের সাহায্যকারী রয়েছেন, তাঁরা নিজেরা বিদেশে বসবাস করছেন, বয়স এবং অবস্থান, সবদিকেই তাঁদের বাড়বৃদ্ধি হয়েছে। কূটকৌশলরূপ উপায়ের সাহায্যে তাঁদের দমন করা যাবে না। জাতপক্ষা বিদেশস্থা বিবৃদ্ধাঃ সর্ব্বশোঽদ্য তে।নোপায়সাধ্যাঃ কৌন্তেয়া মমৈষা মতিরচ্যুত।। এ ছাড়াও পাণ্ডবরা দৈবানুগ্রহে বলবান ও বুদ্ধিমান। তাই কোনও অপবাদ আরোপ করে, তাঁদের বিপদাপন্ন করা, অসম্ভব। তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদসৃষ্টিও হবে না, কারণ যাঁরা এক পত্নীতে আসক্ত, তাঁদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হতেই পারে না। একস্যাং যে রতাঃ পত্ন্যাং ন ভিদ্যন্তে পরস্পরম্। অন্য কোনও স্ত্রীর প্ররোচনা না থাকায়, এক স্ত্রীতে আসক্ত ভাইদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অপরের মাধ্যমে দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কারণ, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার্থী, কান্তিহীন পাণ্ডবদের দ্রৌপদী বরণ করেছিলেন। তাহলে এখন সমৃদ্ধিকালে পাণ্ডবদের তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন কেন? পরিদ্যূনান্ বৃতবতী কিমুতাদ্য মৃজাবতঃ।
একজন নারী এক পতির মধ্যেই বহুপতির গুণ প্রত্যাশা করেন, কৃষ্ণা বহু পতির মধ্যে সেটিই পেয়েছেন, তাই তাঁকে স্বামীদের থেকে বিচ্ছিন্না করা অসম্ভবপ্রায়। পাঞ্চালরাজ বহু ধনে ধনী। তিনি অর্থলিপ্সু নন। কুন্তীপুত্রদের রাজ্য দান করেও তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করবেন না। দ্রুপদরাজের গুণী পুত্রও পাণ্ডবদের অনুরাগী। তাই কর্ণ মনে করেন, কোনও কূটকৌশলের সাহায্যেই পাণ্ডবদের বশে আনা যাবে না। তাই যতদিন পাণ্ডবরা দৃঢ় শিকড় বিস্তার করে অধিষ্ঠিত না হয়, ততদিনে তাঁদের আঘাত করাই শ্রেয়। এই প্রস্তাবটি কি গ্রহণযোগ্য?কর্ণ মনে করেন, আমাদের পক্ষ যত প্রবল, পাঞ্চালরা ততটাই দুর্বল। তাই কোন বিচার বিবেচনা না করে তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কর। অস্মৎপক্ষো মহান্ যাবদ্ যাবৎ পাঞ্চালকো লঘুঃ। তাবৎ প্রহরণং তেষাং ক্রিয়তাং মা বিচারয়।।
এর আগেও বহু সূক্ষ্ম গুপ্ত উপায়ে (যেমন, শৈশবে বিষপ্রয়োগ করে ভীমসেনকে হত্যার চেষ্টা, জতুগৃহে পাণ্ডবদের দগ্ধ করে হত্যার পরিকল্পনা প্রভৃতি) তাঁদেরকে অত্যাচারের চেষ্টা সফল হয়নি। কর্ণের যুক্তি, শৈশবে সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবরা নিকটেই ছিলেন, তখন তাঁদের নির্যাতন করা সম্ভব হয়নি। কর্ণের মত হল, এখন পাণ্ডবদের সাহায্যকারী রয়েছেন, তাঁরা নিজেরা বিদেশে বসবাস করছেন, বয়স এবং অবস্থান, সবদিকেই তাঁদের বাড়বৃদ্ধি হয়েছে। কূটকৌশলরূপ উপায়ের সাহায্যে তাঁদের দমন করা যাবে না। জাতপক্ষা বিদেশস্থা বিবৃদ্ধাঃ সর্ব্বশোঽদ্য তে।নোপায়সাধ্যাঃ কৌন্তেয়া মমৈষা মতিরচ্যুত।। এ ছাড়াও পাণ্ডবরা দৈবানুগ্রহে বলবান ও বুদ্ধিমান। তাই কোনও অপবাদ আরোপ করে, তাঁদের বিপদাপন্ন করা, অসম্ভব। তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদসৃষ্টিও হবে না, কারণ যাঁরা এক পত্নীতে আসক্ত, তাঁদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হতেই পারে না। একস্যাং যে রতাঃ পত্ন্যাং ন ভিদ্যন্তে পরস্পরম্। অন্য কোনও স্ত্রীর প্ররোচনা না থাকায়, এক স্ত্রীতে আসক্ত ভাইদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অপরের মাধ্যমে দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কারণ, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষার্থী, কান্তিহীন পাণ্ডবদের দ্রৌপদী বরণ করেছিলেন। তাহলে এখন সমৃদ্ধিকালে পাণ্ডবদের তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন কেন? পরিদ্যূনান্ বৃতবতী কিমুতাদ্য মৃজাবতঃ।
একজন নারী এক পতির মধ্যেই বহুপতির গুণ প্রত্যাশা করেন, কৃষ্ণা বহু পতির মধ্যে সেটিই পেয়েছেন, তাই তাঁকে স্বামীদের থেকে বিচ্ছিন্না করা অসম্ভবপ্রায়। পাঞ্চালরাজ বহু ধনে ধনী। তিনি অর্থলিপ্সু নন। কুন্তীপুত্রদের রাজ্য দান করেও তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করবেন না। দ্রুপদরাজের গুণী পুত্রও পাণ্ডবদের অনুরাগী। তাই কর্ণ মনে করেন, কোনও কূটকৌশলের সাহায্যেই পাণ্ডবদের বশে আনা যাবে না। তাই যতদিন পাণ্ডবরা দৃঢ় শিকড় বিস্তার করে অধিষ্ঠিত না হয়, ততদিনে তাঁদের আঘাত করাই শ্রেয়। এই প্রস্তাবটি কি গ্রহণযোগ্য?কর্ণ মনে করেন, আমাদের পক্ষ যত প্রবল, পাঞ্চালরা ততটাই দুর্বল। তাই কোন বিচার বিবেচনা না করে তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ কর। অস্মৎপক্ষো মহান্ যাবদ্ যাবৎ পাঞ্চালকো লঘুঃ। তাবৎ প্রহরণং তেষাং ক্রিয়তাং মা বিচারয়।।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯২: মানসিক আঘাতজনিত মৃত্যু ও তার পরবর্তী প্রতিহিংসার যৌক্তিকতা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’
গান্ধারীপুত্রের প্রতি কর্ণের অনুরোধ, যতদিন পাণ্ডবদের প্রভূত মিত্র ও বাহন জোগাড় না হয় ততদিন তাঁদের ওপরে পরাক্রম প্রকাশ করা যেতে পারে। যতক্ষণ পাঞ্চালরাজ সপুত্র (পাণ্ডবদের রাজ্যোদ্ধার বিষয়ে) উদ্যোগী না হন ততক্ষণ দুর্যোধন, শৌর্য প্রকাশ করতে পারেন। কৃষ্ণ, তাঁর যাদব বাহিনী নিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য উদ্ধারের জন্যে এখনও উপস্থিত হননি, পাণ্ডবদের জন্য, তিনি ঐশ্বর্য, ভোগ্যদ্রব্য, রাজ্য, এগুলির কোনটি ত্যাগ করতে পারেন না?তাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে, শক্তি প্রদর্শনের এই তো আদর্শ সময়। মহাত্মা ভরত পরাক্রমের দ্বারা পৃথিবী জয় করেছিলেন, ইন্দ্র শৌর্য বলে ত্রিলোকবিজয়ী হয়েছিলেন। কর্ণের উপদেশ, হে রাজা, ক্ষত্রিয়দের পরাক্রম সর্বদাই প্রশংসিত হয়ে থাকে। পরাক্রম প্রকাশ হল বীরদের নিজ ধর্ম। বিক্রমঞ্চ প্রশংসন্তি ক্ষত্রিয়ঞ্চ বিশাংপতে!। স্বকো হি ধর্মঃ শূরাণাং বিক্রমঃ পার্থিবর্ষভ!।। চতুরঙ্গসেনার সাহায্যে দ্রুপদ রাজ্য তোলপাড় করে, পাণ্ডবদের দ্রুত এখানে আনা হোক। প্রমথ্য দ্রুপদং শীঘ্রমানয়ামেহ পাণ্ডবান্। সাম, দান ও ভেদ নীতির মাধ্যমে পাণ্ডবদের বশে আনা যাবে না, তাই পরাক্রমপ্রকাশ করেই শুধু সেটি সম্ভব। ন হি সাম্না ন দানেন ন ভেদেন চ পাণ্ডবাঃ। শক্যাঃ সাধয়িতুং তস্মাদ্বিক্রমেণৈব তান্ জহি।। কর্ণের অভীপ্সিত লক্ষ্যপূর্ণ তখনই সম্ভব হবে। দুর্যোধন মহাবিক্রমে পাণ্ডবদের জয় করে এই অখিল ভুবন ভোগ করুন। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় তাঁর জানা নেই। ধৃতরাষ্ট্র রাধেয় কর্ণের প্রস্তাব শুনে, সেটিকে মান্যতা দিলেন। প্রকাশ্যে বললেন, মহা প্রাজ্ঞ, শস্ত্রবিশারদ সুতপুত্র কর্ণের পক্ষে এমন শৌর্যোদ্দীপক বচন, যথোপযুক্তই বটে। ধৃতরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত — তবে আবারও ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও বিদুরের সঙ্গে তোমরা সম্মিলিতভাবে মন্ত্রণা করে, সুখকর বুদ্ধি উদ্ভাবন কর। ভূয় এব তু ভীষ্মশ্চ দ্রোণো বিদুর এবং চ। যুবাঞ্চ কুরুতাং বুদ্ধিং ভবেদ্ যা নঃ সুখোদয়া।। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র,যশস্বী মন্ত্রীদের আহ্বান জানালেন, শুরু হল মন্ত্রণা।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে
প্রথম বক্তা, প্রবীণ হিতৈষী ভীষ্ম। পাণ্ডু পুত্রদের সঙ্গে বিরোধ,তাঁর অভিপ্রেত নয়। কারণ ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু, দুজনের প্রতি তিনি নিঃসন্দেহে সমদৃষ্টিসম্পন্ন। ভীষ্মের মতে, যেমন গান্ধারীপুত্ররা তেমনই কুন্তীপুত্ররা, তাঁর কাছে উভয়েই সমান। পাণ্ডবদের এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সমানভাবে রক্ষা করাই তাঁর কর্তব্য। পক্ষপাতিত্বহীন, ভীষ্ম বললেন, তাঁর নিজের এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রের, দুর্যোধনের এবং কুরুবংশীয়দের সকলের কর্তব্য, পাণ্ডবদের সুরক্ষাদান। এমন হলে, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধাচরণ ভীষ্মের পছন্দ নয়, বরং সন্ধি করে সেই বীরদের অর্দ্ধ রাজত্ব দান করা হোক। যেমন পাণ্ডবদের প্রপিতামহদের এই রাজ্য, কুরুশ্রেষ্ঠদের ও সেই সঙ্গে তাঁদের পিতারও। এবং গতে বিগ্রহং তৈর্ন রোচে সন্ধ্যায় বীরৈর্দীয়তামর্দ্ধভূমিঃ। তেষামপীহ প্রপিতামহানাং রাজ্যং পিতুশ্চৈব কুরূত্তমানাম্।। দুর্যোধনের প্রতি ভীষ্মের উপদেশ, দুর্যোধন যেমন রাজ্যটিকে নিজের পৈতৃক বলে মনে করেন, তেমনটাই মনে করেন পাণ্ডবরাও। যদি পাণ্ডবরা রাজ্যাধিকার লাভ না করেন তবে, এই রাজ্য কীভাবে অন্য কোন ভরতবংশীয়ের আয়ত্তাধীন হবে? দুর্যোধন অধর্মের আশ্রয় নিয়ে রাজ্যাধিকার লাভ করেছেন, পাণ্ডবরা আগেই রাজ্য লাভ করেছিলেন। এটিই ভীষ্মের অভিমত। বিবাদ নয়, মধুরভাবে অর্থাৎ প্রীতিভরে রাজ্যার্দ্ধ দান করাই শ্রেয়। এতেই সকলের কল্যাণ হবে। দুর্যোধনের প্রতি ভীষ্মের পরামর্শানুসারে, এর অন্যথা হলে,আমাদের কোন মঙ্গল হবে না, তোমারও অপবাদ হবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অতোঽন্যথা চেৎ ক্রিয়তে ন হিতং নো ভবিষ্যতি। তবাপ্যকীর্ত্তিঃ সকলা ভবিষ্যতি না সংশয়ঃ।। কীর্তি রক্ষা করা কর্তব্য। কীর্ত্তিই প্রধান বল,কীর্ত্তি বিনষ্ট হলে বেঁচে থাকাই বিফল। কীর্ত্তিরক্ষণমাতিষ্ঠ কীর্ত্তির্হি পরমং বলম্। নষ্টেকীর্ত্তের্মনুষ্যস্য জীবিতং হ্যফলং স্মৃতম্।। যতক্ষণ মানুষের কীর্তিনাশ না হয়, ততক্ষণ সে জীবিত থাকে, নষ্টকীর্ত্তি মানুষ বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাই ভীষ্মের উপদেশ, কুরুকুলের আচরিত ধর্মানুসরণ কর্তব্য। পিতৃপুরুষদের অনুরূপ ধর্ম নিজে পালন কর। তমিমং সমুপাতিষ্ঠ ধর্ম্ম কুরুকুলোচিতম্। অনুরূপং মহাবাহো!পূর্ব্বেষামাত্মনঃ কুরু।। সৌভাগ্যক্রমে পৃথা কুন্তীর পুত্ররা জীবিত আছেন, বেঁচে আছেন স্বয়ং কুন্তী। ভাগ্য সহায়, তাই পুরোচন সফল হয়নি, সে আজ মৃত। ভীষ্ম অকপটে নিজের অন্তরের অনুশোচনার দহনজ্বালা ব্যক্ত করলেন, তিনি, যখন থেকে জেনেছেন, সপুত্রা কুন্তীভোজকন্যা দগ্ধা হয়েছেন, তখন থেকে তিনি চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারেননি। ইহলোকে মানুষ, (বারণাবতে) সেই দহনকাণ্ডে পুত্রসহ কুন্তীর প্রাণহরণকারীরূপে পুরোচনকেও তেমন দোষের ভাগীদার মনে করে না, হে নরশ্রেষ্ঠ, যেমন মনে করে আপনাকে। লোকে প্রাণভৃতং কঞ্চিচ্ছ্রুত্বা কুন্তীং তথাগতাম্।ন চাপি দোষেণ তথা লোকো২বৈতি পুরোচনম্।যথা ত্বাং পুরুষব্যাঘ্র!লোকো দোষেণ গচ্ছতি।।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে
পাণ্ডবরা জীবিত, তাঁরা এখন দৃশ্যমান। তাই দুর্যোধন দোষজনিত পাপ হতে মুক্ত হয়েছেন, এটি মনে রাখা উচিত। সেই বীর পাণ্ডুপুত্রদের জীবদ্দশায়, তাঁদের পৈতৃক অংশ কেড়ে নেওয়া, স্বয়ং বজ্রধারী ইন্দ্রেরও অসাধ্য কাজ। (রাজ্যাধিকার বিষয়ে) তাঁরা ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সমান হলেও, তাঁদের বিশেষত্ব হল — তাঁদের ধর্মে অধিষ্ঠান, তাঁরা সকলে একপ্রাণ এবং অধর্মসম্পর্করহিত। ভীষ্মের অনুরোধ, যদি ধর্মসঙ্গত কাজ তোমার অভিপ্রেত হয়,যদি আমার প্রিয় কাজ করতে সচেষ্ট হও এবং ক্ষেম অর্থাৎ লব্ধ রাজ্যের রক্ষণে যদি ইচ্ছুক হও, তবে পাণ্ডবদের রাজ্যের অর্দ্ধাংশ দাও। যদি ধর্ম্মস্ত্বয়া কার্য্যো যদি কার্য্যং প্রিয়ঞ্চ মে। ক্ষেমঞ্চ যদি কর্ত্তব্যং তেষামর্দ্ধং প্রদীয়তাম্।।
রাষ্ট্রের উন্নতিকামী রাজার রাষ্ট্রসংক্রান্ত নীতির চারটি স্তম্ভ হল—সাম, দান,ভেদ ও দণ্ড। ‘সাম’ — সন্ধিস্থাপন, ‘দান’ —দান করে আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি, ‘দণ্ড’ দমননীতি, বিভেদসৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হল ‘ভেদ’। দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরোধিতায়, বিভেদের আশ্রয় নিয়েছেন। পাণ্ডবদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের দুর্বল করে, নিধন করতে চেয়েছেন দুর্যোধন। এছাড়া পাণ্ডবদের প্রধান সহায় দ্রুপদরাজশক্তিকে হাত করে পাণ্ডবদের আশ্রয়চ্যুত করাও ছিল তাঁর লক্ষ্য। দুর্যোধনের উদ্দেশ্য ছিল, পঞ্চপাণ্ডবের শক্তির উৎস ভীমসেনকে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের বলহীনতার সুযোগের সদ্ব্যবহার। স্ত্রীর প্রতি অনাস্থা, তাঁর প্রতি আনুগত্যের অভাবোদ্ভাবন ছিল দুর্যোধনের বিভেদনীতির একটি চাল। বিপরীতভাবে দ্রৌপদীর মনেও পাঁচজন স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসসৃষ্টি ও তার ফলে পাণ্ডবদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধে চিড় ধরানো, এ সবই দুর্যোধনের বিভেদনীতিপ্রয়োগের এক একটি বিকল্প উপায়। সবগুলির উদ্দেশ্যই ছিল বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি বা ভেদবুদ্ধিজন্মানো। এগুলি প্রয়োগের ফল হল, শত্রুদের শক্তিহ্রাস এবং তাঁদের নিধন।
রাষ্ট্রের উন্নতিকামী রাজার রাষ্ট্রসংক্রান্ত নীতির চারটি স্তম্ভ হল—সাম, দান,ভেদ ও দণ্ড। ‘সাম’ — সন্ধিস্থাপন, ‘দান’ —দান করে আর্থিক সমঝোতার মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি, ‘দণ্ড’ দমননীতি, বিভেদসৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত হল ‘ভেদ’। দুর্যোধন পাণ্ডবদের বিরোধিতায়, বিভেদের আশ্রয় নিয়েছেন। পাণ্ডবদের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের দুর্বল করে, নিধন করতে চেয়েছেন দুর্যোধন। এছাড়া পাণ্ডবদের প্রধান সহায় দ্রুপদরাজশক্তিকে হাত করে পাণ্ডবদের আশ্রয়চ্যুত করাও ছিল তাঁর লক্ষ্য। দুর্যোধনের উদ্দেশ্য ছিল, পঞ্চপাণ্ডবের শক্তির উৎস ভীমসেনকে সরিয়ে দিয়ে তাঁদের বলহীনতার সুযোগের সদ্ব্যবহার। স্ত্রীর প্রতি অনাস্থা, তাঁর প্রতি আনুগত্যের অভাবোদ্ভাবন ছিল দুর্যোধনের বিভেদনীতির একটি চাল। বিপরীতভাবে দ্রৌপদীর মনেও পাঁচজন স্বামীর প্রতি অবিশ্বাসসৃষ্টি ও তার ফলে পাণ্ডবদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধে চিড় ধরানো, এ সবই দুর্যোধনের বিভেদনীতিপ্রয়োগের এক একটি বিকল্প উপায়। সবগুলির উদ্দেশ্যই ছিল বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি বা ভেদবুদ্ধিজন্মানো। এগুলি প্রয়োগের ফল হল, শত্রুদের শক্তিহ্রাস এবং তাঁদের নিধন।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১০: মোহমুদ্গর
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
সাম, দান, ভেদ ও দণ্ড এই চারটির মধ্যে সর্বশেষ আশ্রয়নীয় হল ‘দণ্ড’। প্রথম তিনটি কার্যকর না হলে সর্বশেষ দণ্ড প্রয়োগ করে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাণ্ডবদের অবস্থানগত সুবিধা হল, তাঁরা প্রভাবশালী দ্রুপদরাজের জামাতা। অশেষ গুণবতী, পঞ্চপাণ্ডবের প্রিয় পত্নী, দ্রৌপদী, তাঁদের ঐক্যের বাঁধনে বেঁধে রেখেছেন। পাণ্ডবরা সকলেই দ্রৌপদীতে গভীরভাবে আসক্ত। দ্রৌপদী পঞ্চ পাণ্ডবদের গুণের প্রতি অনুগত। তিনি সহায়সম্বলহীন দীনহীন পাণ্ডবদের গুণের অনুরাগিনী। তিনি নির্দ্বিধায় তাঁদের স্বামীরূপে মেনে নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে দ্রৌপদী, তাঁদের স্বামীত্ব, অস্বীকার করতে পারেন না। উপহার দিয়ে অর্থাৎ দানের মাধ্যমে অর্থসমৃদ্ধ দ্রুপদরাজকে বশে আনা যাবে না। তাই অর্থের বিনিময়ে দ্রুপদরাজকে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী চালনা করা সম্ভব নয়। অঙ্গরাজ কর্ণ, দুর্যোধনের একান্ত শুভাকাঙ্খী ও মন্ত্রণাদাতা।তিনি দমননীতি অর্থাৎ শত্রুদের আঘাত করে দমন করতে ইচ্ছুক। দমনের পক্ষপাতী কর্ণ। তাঁর নির্দেশিত পথ হল দমন বা দণ্ড।
ধর্মশাস্ত্রে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিবিধায়ক উপায় চারটির মধ্যে সামনীতি ও দণ্ডনীতিকে পণ্ডিতরা প্রশংসা করেছেন। শৌর্যশালী কর্ণ যৌবনে উপনীত, তিনি অস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ও ধৈর্যের হয়তো অভাব ছিল। তিনি দমননীতি বা দণ্ডনীতি প্রয়োগ করে পাণ্ডবদের ওপরে আধিপত্য বিস্তারে ইচ্ছুক। তাই কর্ণ সাম, দান, ভেদ, দণ্ড এই চারটি উপায়ের মধ্যে দণ্ডকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন।
প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ ভীষ্মের বিবেচনায়, শত্রুকে বশে আনার শ্রেষ্ঠ উপায় হল ‘সাম’। তিনি হৃদয়বান, উদারমনা, পক্ষপাতিত্বহীন, সমদর্শী। পিতামহ ভীষ্মের কাছে পাণ্ডুপুত্র ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্র উভয়েই সমান স্নেহের পাত্র। সন্ধির মাধ্যমে রাজ্যার্দ্ধদানের এই প্রস্তাবটি রাজনীতির কূটকৌশলমাত্র নয়, এর মধ্যে আছে হৃদয়বৃত্তির উষ্ণতা। রাজ্যের উত্তরাধিকারের দাবিতেও পাণ্ডবরা অগ্রগণ্য, কারণ পৈতৃকসূত্রে তাঁরা রাজা পাণ্ডুর পুত্র। রাজোচিত গুণেও ঐশ্বর্যবান পঞ্চ পাণ্ডব। অধার্মিক দুর্যোধনের সঙ্গে তুল্যমূল্যবিচারে তাঁরা দ্বিগুণ এগিয়ে রয়েছেন। ভীষ্মের মতে, দুর্যোধনের তুলনায় পাণ্ডবরা কেমন? তে সর্ব্বেঽবস্থিতা ধর্মে সর্ব্বে চৈবৈকচেতসঃ। অধর্মণ নিরস্তাশ্চ তুল্যে রাজ্যে বিশেষতঃ।। পাণ্ডুপুত্ররা ধার্মিক, তাঁরা সর্বদাই একমতাবলম্বী, অধর্মের বিরোধী। নিঃসন্দেহে রাজ্যলাভের যোগ্যতা তাঁদের আছে। রাজ্যের উন্নতির স্বার্থে ধার্মিক ব্যক্তি, রাজপদের যোগ্য প্রার্থী। ধার্মিক ভীষ্মের লক্ষ্য, রাজ্যের সকলের মঙ্গল হোক। যেটা পাণ্ডবদের রাজ্যপ্রাপ্তিতেই সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
ধর্মশাস্ত্রে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিবিধায়ক উপায় চারটির মধ্যে সামনীতি ও দণ্ডনীতিকে পণ্ডিতরা প্রশংসা করেছেন। শৌর্যশালী কর্ণ যৌবনে উপনীত, তিনি অস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ, কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতা ও ধৈর্যের হয়তো অভাব ছিল। তিনি দমননীতি বা দণ্ডনীতি প্রয়োগ করে পাণ্ডবদের ওপরে আধিপত্য বিস্তারে ইচ্ছুক। তাই কর্ণ সাম, দান, ভেদ, দণ্ড এই চারটি উপায়ের মধ্যে দণ্ডকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন।
প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ অভিজ্ঞ ভীষ্মের বিবেচনায়, শত্রুকে বশে আনার শ্রেষ্ঠ উপায় হল ‘সাম’। তিনি হৃদয়বান, উদারমনা, পক্ষপাতিত্বহীন, সমদর্শী। পিতামহ ভীষ্মের কাছে পাণ্ডুপুত্র ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্র উভয়েই সমান স্নেহের পাত্র। সন্ধির মাধ্যমে রাজ্যার্দ্ধদানের এই প্রস্তাবটি রাজনীতির কূটকৌশলমাত্র নয়, এর মধ্যে আছে হৃদয়বৃত্তির উষ্ণতা। রাজ্যের উত্তরাধিকারের দাবিতেও পাণ্ডবরা অগ্রগণ্য, কারণ পৈতৃকসূত্রে তাঁরা রাজা পাণ্ডুর পুত্র। রাজোচিত গুণেও ঐশ্বর্যবান পঞ্চ পাণ্ডব। অধার্মিক দুর্যোধনের সঙ্গে তুল্যমূল্যবিচারে তাঁরা দ্বিগুণ এগিয়ে রয়েছেন। ভীষ্মের মতে, দুর্যোধনের তুলনায় পাণ্ডবরা কেমন? তে সর্ব্বেঽবস্থিতা ধর্মে সর্ব্বে চৈবৈকচেতসঃ। অধর্মণ নিরস্তাশ্চ তুল্যে রাজ্যে বিশেষতঃ।। পাণ্ডুপুত্ররা ধার্মিক, তাঁরা সর্বদাই একমতাবলম্বী, অধর্মের বিরোধী। নিঃসন্দেহে রাজ্যলাভের যোগ্যতা তাঁদের আছে। রাজ্যের উন্নতির স্বার্থে ধার্মিক ব্যক্তি, রাজপদের যোগ্য প্রার্থী। ধার্মিক ভীষ্মের লক্ষ্য, রাজ্যের সকলের মঙ্গল হোক। যেটা পাণ্ডবদের রাজ্যপ্রাপ্তিতেই সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে আধিপত্যবিস্তার বিষয়টিতে, দুর্যোধন, কর্ণ ও ভীষ্মের অভিমত পরস্পরবিরোধী। শত্রুদের বশে আনবার বা শত্রুদের ওপরে আধিপত্য বিস্তারের জন্যে রাজার আশ্রিত উপায়সমূহের মধ্যে দুর্যোধন ভেদ নামক উপায়ের সমর্থক। কর্ণ, দমনরূপ উপায় অবলম্বন করতে ইচ্ছুক। পিতামহ ভীষ্ম, সাম অর্থাৎ সন্ধিতে বিশ্বাসী। ধর্মশাস্ত্রানুসারে, যে কোনও শত্রুকে দমন করবার চরম দুটি উপায় হল সাম এবং দণ্ড। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্যে এই দুটির যে কোন একটি প্রয়োগ, প্রয়োজন। কর্ণ চরমপন্থী। তাঁর কোন মধ্যপন্থা নেই।ভীষ্মের পরামর্শ, আবেগ প্রসূত হলেও তাতে রয়েছে বিবেকবোধের ঔজ্জ্বল্য ও ধর্মবোধের প্রকাশ, উভয়পক্ষের প্রাণহানির সম্ভাবনাহীন এই প্রস্তাব। দণ্ডে জীবনহানির সম্ভাবনা প্রবল।
মহাকাব্যের চতুর্বিধ ফল হল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মহাভারতের আছেন ধার্মিক ভীষ্ম এবং তাঁর স্নেহধন্য ধার্মিক পৌত্ররা, কামনার বশবর্তী দুর্যোধন ও তাঁর সহযোগীবৃন্দ, মধ্যে রয়েছে অর্থরূপ বৈষয়িক রাজ্যাধিকার প্রতিষ্ঠা ঘিরে বিবাদবিসংবাদ।মহাকাব্যিক ফলপ্রকাশের বিপুল আয়োজনের সমাহার এই মহাভারত। মহাভারতের প্রেক্ষাপটে এমন অনেক রাজনৈতিক,সূক্ষ্মতত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে, যার প্রলম্বিত ছায়ার বিস্তার,ভরতবংশীয়দের উত্তর প্রজন্মের রাষ্ট্রনীতি,সমাজনীতিতে লক্ষিত হয়।বিভেদকামী দুর্যোধনরা এখনও আছেন, আছেন কর্ণের মতোই চরমপন্থীরা নাশকতায় যারা বিশ্বাসী, আবার আছেন ভীষ্মের মতো হৃদয়বান, উদার,অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদও। হয়তো মহাভারতের কাহিনির আলোকে আধুনিক ভরতবংশীয়দের উত্তরাধীকারীদের মধ্যেও, এঁদের চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। —চলবে।
মহাকাব্যের চতুর্বিধ ফল হল ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মহাভারতের আছেন ধার্মিক ভীষ্ম এবং তাঁর স্নেহধন্য ধার্মিক পৌত্ররা, কামনার বশবর্তী দুর্যোধন ও তাঁর সহযোগীবৃন্দ, মধ্যে রয়েছে অর্থরূপ বৈষয়িক রাজ্যাধিকার প্রতিষ্ঠা ঘিরে বিবাদবিসংবাদ।মহাকাব্যিক ফলপ্রকাশের বিপুল আয়োজনের সমাহার এই মহাভারত। মহাভারতের প্রেক্ষাপটে এমন অনেক রাজনৈতিক,সূক্ষ্মতত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে, যার প্রলম্বিত ছায়ার বিস্তার,ভরতবংশীয়দের উত্তর প্রজন্মের রাষ্ট্রনীতি,সমাজনীতিতে লক্ষিত হয়।বিভেদকামী দুর্যোধনরা এখনও আছেন, আছেন কর্ণের মতোই চরমপন্থীরা নাশকতায় যারা বিশ্বাসী, আবার আছেন ভীষ্মের মতো হৃদয়বান, উদার,অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদও। হয়তো মহাভারতের কাহিনির আলোকে আধুনিক ভরতবংশীয়দের উত্তরাধীকারীদের মধ্যেও, এঁদের চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। —চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।