মা সারদা।
মা সারদার বাৎসল্যে তাঁর বয়স্ক ছেলেদের আচরণও শিশুর মতো করে তুলত। তাঁরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি ভুলে শ্রীমার কাছে ছোট শিশুর মতোই ব্যবহার করতেন। শরৎ মহারাজকে শ্রীমায়ের বাড়িতে বালকের মতো আনন্দে রঙ্গ করতে দেখে তাই মনে হয়েছে যে, এই কি সেই উদ্বোধনের হিমালয়তুল্য গম্ভীর স্বামী সারদানন্দ, মঠ ও মিশনের কর্মাধ্যক্ষ। স্বামী জ্ঞানানন্দ তাঁর ডান হাতের আঙুল কেটে ফেলেছেন, তাই তাঁর খেতে কষ্ট হচ্ছে। বাঁহাতে চামচ ধরে অতি কষ্টে খাচ্ছেন। তাই দেখে শ্রীমার প্রাণ গলে গেল। তিনি কাছে বসে নিজে খাইয়ে দিলেন। যতদিন না তাঁর হাত ঠিক হল, সেই দুর্ধর্ষ, অশান্ত ছেলেও শিশুর মতো বসে মা সারদার হাতে পরম তৃপ্ত হয়ে খেতেন।
স্বামী সারদেশানন্দ ও জ্ঞানানন্দ বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল তা শ্রীমা জানতেন। তাঁরা দুজন শ্রীমার কাছে যখন আসতেন, তখন বাইরে বেশি লোকজন না থাকলে তিনি তাঁদের নিজের দুয়ারে বসিয়ে এক থালায় খেতে দিতেন। আনন্দে খুশি হয়ে নিজের হাতে তাঁদের খাবার পরিবেশন করতেন। তাঁরা দুজনও সহোদর শিশুর মতো পরম আনন্দে গল্পগুজব করতে করতে ধীরে ধীরে খেতেন। আর মা সারদা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন ও বলেন, ‘কি চাই, কোনটা ভাল হয়েছে, পেটভরে খাও, আর একটু দিই’। তাঁরাও সব ভুলে ছোট ছেলে হয়ে যেতেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৩: দেবেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন ‘কল্পতরু’
একদিন পায়েস হয়েছে, দুই বন্ধু ভাইয়ের মতো এক পাতে খাচ্ছেন। বেলা হয়েছে, শ্রীমা ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে তাড়াতাড়ি গরম পায়েস একটি বড় থালায় তাঁদের খেতে দিয়েছেন। তিনি তাঁদের খাওয়া দেখছেন, কথা বলছেন, গরম বলে অল্প অল্প করে বার বার এনে দিচ্ছেন। শ্রীমার মনে হল তাঁরা যেন সঙ্কোচ করে খাচ্ছেন, পেটভরে খাচ্ছেন না। শ্রীমা তাই ব্যস্ত হয়ে পাতের কাছে উপুড় হয়ে পায়েস দেখিয়ে বলছেন, ‘পায়েস খাও, খুব পেট ভরে খাও’। যেন তিনি হাতে তুলেই গরম পায়েস খাইয়ে দেবেন। অল্পবয়সী ছেলেরা খুব খেল আর তাই দেখে ভারি খুশি হয়ে তিনি বলছেন, ‘চেঁছে পুঁছে খাও’।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৬: ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী মেয়ে
ছেলেরা একপাতে শিশুর মতো খেলে শ্রীমায়ের ভারি আনন্দ হয়। বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষের কাজ থেকে অবসর পেয়ে মা সারদার কয়েকজন সন্তান জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে শ্রীমার বাড়ি এসেছেন। মা সারদার তাই খুব আনন্দ। ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ ভাল গান গাইতে পারে। তারা খুব উৎসাহে ভজন গান গাইতে লাগল। তারা প্রাণের আবেগে মাতৃসঙ্গীত গাইছে। শ্রীমা পুজোর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেদের ভজন শুনছেন। স্বামী তপানন্দ তাঁর সুকণ্ঠে গাইছেন, ‘মাকে দেখবো বলে ভাবনা কেউ করো না আর, সে যে তোমার আমার মা শুধু নয়, জগতের মা সবাকার…’। তাঁর গানটি বড়ই হৃদয়স্পর্শী, যার একটি চরণ হল, “ছেলের মুখে মা,মা বাণী, শুনবেন বলে ভবরানী, আড়াল থেকে শোনেন পাছে দেখিলে না ডাকে আর”। তাঁর সুমধুর কণ্ঠে গীত তাল, মান লয়ে সুরলহড়ী শ্রীমার মন স্পর্শ করেছে। স্বামী সারদেশানন্দ ভেতর থেকে এসে জানালেন যে, মা দরজার পিছনে বসে স্থিরচোখে গান শুনছেন। একথা শুনে সরল সন্তানের প্রাণমন মেতে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে বারবার এই পদটিই গাওয়া হল।
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে
পুজো শেষ হলে শ্রীমা অঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করলেন। ভক্তরাও প্রণাম করল। মধ্যপূজা আর ভোগারতির পর সকলে প্রসাদী সিঁদুর ও চন্দনের ফোঁটা কপালে ধারণ করে প্রসাদ পেতে বসল। আর শ্রীমা আড়ালে বসে ছেলেদের খাওয়া দেখলেন। বারবার তাদের এটা, ওটা নিতে বললেন। পুজোশেষে শ্রীমা জগদ্ধাত্রীকে অঞ্জলি দিয়ে গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে যখন জোড়হাতে দাঁড়াতেন, তখন তাঁর সেই উদ্ভাসিত মুখ প্রতিমার থেকেও ভক্তদের বেশি টানত। পুজোয় তন্ত্রধারক পিতৃবংশের কুলগুরুকে শ্রীমা ভক্তিভরে প্রণাম করলে তিনি সঙ্কুচিত হয়ে জোড়হাতে প্রতিপ্রণাম করে কাতরভাবে বলতেন,’মা, আপনার আবার এরূপ করা কেন?’ পুজোর পরদিন সকালে মা সারদা জলখাবারের জন্য অদ্ভুত ব্যবস্থা করেছেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
কামারপুকুর থেকে ফরমাস করে সেখানকার বিখ্যাত জিলিপি আনিয়েছেন। ঠাকুরকে প্রসাদ দিয়ে সেই প্রসাদ ও যথেষ্ট মুড়ি একই পাতে দিয়েছেন। সব ছেলেরা একসঙ্গে খাবে। শ্রীমার ইচ্ছা শুনে ছেলেদের প্রাণে আনন্দ আরও বেড়ে গেল। সকলে শিশুর মতো এক পাতে খাচ্ছে, শ্রীমা আড়ালে বসে তাই দেখছেন। সেই বছর কালীকুমারের বৈঠকখানায় পুজো হয়। প্রসন্নের পুরনো বৈঠকখানায় ভক্তদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।