বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


ধানের জমিতে শামুকখোল। ছবি: সংগৃহীত।

কালীপুজোর তিন দিন আগে থেকেই ছিল আকাশের মুখ ভার। টিভিতে শুনলাম, বঙ্গোপসাগরে আবার নিম্নচাপ। ধেয়ে আসতে পারে ঘুর্ণিঝড় ‘কায়ান্ত’। কালীপুজোর আগের দিন সকাল থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সকাল থেকে প্রায় গৃহবন্দি। বেলা বাড়তে কমে এল বৃষ্টির দাপট। বেলা বারোটা নাগাদ হঠাৎ উঠল ঝকঝকে রোদ। আমি ঠিক সেই সময় স্নান করে স্নানঘর থেকে বেরিয়েছি। দেখি, আমার বাড়ির পরিচারিকা ও আমার কন্যা করিডোরের খোলা জানালা দিয়ে পশ্চিমদিকে দূরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। আমি ব্যাপারটা জানতে চাইলাম। আমার পরিচারিকা আঙুল দিয়ে আমাকে পশ্চিমদিকে আমার বাড়ি থেকে চারটে বাড়ির পর একটা বড়ো শিরীষ গাছের আগা নির্দেশ করল। বলল, ওখানে কিছু একটা বড় পাখি বসে আছে। আমি প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। বৃষ্টির দাপটে এমনিতেই বাইরের সব দৃশ্য ঝাপসা হয়ে গেছে, তায় পাতার আড়াল।
আমার মাথায় নানা চিন্তা খেলা করতে লাগল। তাকিয়ে রয়েছি অপলক নয়নে শিরীষ গাছের মাথার দিকে। আমার পরিচারিকা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলেনি। আর তা হলে পাখিটা গাছে বসে আছেই। প্রবল বৃষ্টির জন্য সে বাধ্য হয়েছে সাময়িকভাবে গাছে আশ্রয় নিতে। বৃষ্টি থামলে নিশ্চয়ই সে আবার পাড়ি দেবে গন্তব্যের দিকে। আমাকে ততক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে।

নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছি। বৃষ্টির প্রাবল্য কমার লক্ষণ দেখছি না। এইভাবে গাছের দিকে তাকিয়ে কেটে গিয়েছে প্রায় আধ ঘন্টা। বৃষ্টির তীব্রতা একটু কমেছে। হঠাৎ ডালটা জোরে দুলে উঠল, আর দেখি মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সির রঙের মতো সাদা-কালো দুটো লম্বা ডানা প্রসারিত করে লম্বা গলাওয়ালা একটা পাখি সবুজ পাতার আড়াল থেকে আকাশে ডানা মেলল। তারপর আমার বাড়িকে বামদিকে রেখে ঝিরঝিরে বৃষ্টি গায়ে মাখতে মাখতে পাড়ি দিল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আমার অজানা কোনও গন্তব্যে। কয়েক সেকেন্ডের দেখা। তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম পাখিটা শামুকখোল।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

শামুকখোল আমি ছোটবেলা থেকে না দেখলেও বাবার মুখে গল্প শুনে মানসচক্ষে এর একটা ছবি আঁকাই ছিল। প্রথম চর্মচক্ষে দেখি অনেক বড়ো হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। বাসে কলকাতা যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে জল কমে যাওয়া নয়নজুলিতে মাঝে মাঝেই দেখতাম। পরে শিয়ালদা-নামখানা রেলপথে যাতায়াতের সময় নিশ্চিন্তপুর থেকে বারুইপুরের মাঝে রেললাইনের পাশে জল কমে আসা নয়নজুলিতে খাবার খেতে দেখেছি। ট্রেন কাছাকাছি এলে ওরা দল বেঁধে উড়ে যায়। ভারি সুন্দর সে দৃশ্য। এখনও দেখা যায়।

ভারতের নানা জায়গায় বেড়াতে গিয়েও শামুকখোল দেখেছি। কিন্তু কাকদ্বীপের আশেপাশে কখনও দেখিনি। আমাকে অবাক করল, একা একটা শামুকখোলকে দেখে। ওরা সাধারণত দলে থাকে। ও কি দলছুট হয়ে পড়েছিল? অসুস্থ? নাকি মন খারাপ? সকালে নিশ্চয়ই খাবারের খোঁজে গিয়েছিল। দুর্যোগের জন্য আস্তানার দিকে ফিরছে। তাহলে আস্তানা কি দক্ষিণ দিকে? ওদিকে মুড়িগঙ্গা নদী। নদীর তীরে কিছু প্রাকৃতিক জঙ্গল ও কিছু সামাজিক বনসৃজনে তৈরি হওয়া জঙ্গল আছে। হয়তো ওখানেই ওরা আস্তানা গেড়েছে। ওরা ফিরে আসছে আমাদের এলাকায়, এটা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। তবে গত আট-দশ বছর ধরে কাকদ্বীপ, নামখানা, সাগরদ্বীপ, ক্যানিং, মথুরাপুর, রায়দীঘি ও পাথরপ্রতিমার নানা জায়গায় নীচু জমিতে বা জলাভূমিতে মাঝে মাঝেই শামুকখোল দেখতে পাচ্ছি। ছুটির দিনে ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে এখন ওদের দল বেঁধে আকাশে চক্কর কাটতেও দেখি। দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়।

শামুকখোল। ছবি: সংগৃহীত।

ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এদের নাম ‘শামুকখোল’। নানা লেখাতেও দেখেছি ‘শামুকখোল’। তবে দু’এক জায়গায় ‘শামুকখোর’ কথাটাও দেখেছি। আমার মনে হয়, বাংলায় এই নামটাই একেবারে উপযুক্ত। কারণ এদের প্রধান খাবার হল শামুক। আপেল শামুক (Pila globosa) এদের বড়োই প্রিয় খাদ্য। সুতরাং শামুকখোরই উপযুক্ত নাম। মনে হয়, মানুষের মুখে মুখে ‘শামুকখোর’ কালক্রমে ‘শামুকখোল’-এ পর্যবসিত হয়েছে। ইংরেজিতে এদের নাম হল ‘Open billed stork’। একেবারে উপযুক্ত নাম, কারণ এদের ব্যতিক্রমী চঞ্চু। এদের লালচে-কালো রঙের লম্বা চঞ্চুটির মাঝে আছে অদ্ভুত একটা ফাঁক। নীচের ঠোঁটটি ধনুকের মতো বাঁকা হওয়ায় উপরের ঠোঁটের গোড়ায় ও আগায় নীচের ঠোঁট ছুঁয়ে থাকলেও মাঝে ফাঁকা হয়। হিন্দিতে এদের নাম ‘গুংগলা’। বিজ্ঞানসম্মত নাম Anastomus oscitans। এই নামের অর্থ ‘হাই-তোলা মুখের পাখি’ (গ্রিক Anastomoo = মুখ, Oscitans = হাই তোলা)! উপর ও নীচের ঠোঁটের মাঝে ওই ফাঁকের জন্যই যে এই নাম তা বলাবাহুল্য। অপ্রাপ্তবয়স্কদের চঞ্চুতে ওই ফাঁক অনেক কম। আর বাচ্চাদের চঞ্চুতে তো ফাঁক থাকেই না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা

শামুকখোলের স্বাভাবিক বাসস্থান হল ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস ও কম্বোডিয়া। যেখানে জলাভূমি আছে তার আশেপাশেই এদের বাস। এজন্য নদী, হ্রদ, ঝিল ইত্যাদির পাশে এরা বসবাস করে। বট, অশ্বত্থ, পাকুড়, শিরীষ, শিমুল ইত্যদি বড় বড়ো গাছে এরা বক, পানকৌড়ি ইত্যদি জলচর পাখিদের সঙ্গে একত্রে দল বেঁধে থাকে। এতে শিকারি পাখিদের খপ্পর থেকে বাচ্চাদের বাঁচাতে সুবিধে হয়। যেসব জলা জায়গায় অল্প জল জমে রয়েছে সেখানেই এদের দলবদ্ধভাবে খাবার সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

এক একটা দলে তিন-চারটে থেকে চল্লিশটা থাকতে পারে। বন্যার পর ধানের মাঠে জমে থাকা জলে শামুকখোলদের খুব দেখা যায়। শামুকখোল সাধারণত স্থানীয় পাখি। নিজের এলাকা ছেড়ে দূরে গেলেও সন্ধ্যের আগে ফিরে আসে। তবে রাজস্থানের ভরতপুর পাখিরালয়ে একবার একটা শামুকখোলের পায়ে রেডিয়ো কলার রিং পরিয়ে ছেড়ে দিয়ে দেখা গিয়েছে সে ৮০০ কিমি পুবে পাড়ি দিয়েছিল। আবার রিং পরানো তাইল্যান্ডের একটা শামুকখোলকে ১৫০০ কিমি পশ্চিমে বাংলাদেশে আসতেও দেখা গেছে। এ রহস্যের মীমাংসা আজও হয়নি। তবে কমবয়সী শামুকখোলদের অত্যুৎসাহের জন্য ও আবাসস্থলে প্রতিকূল পরিস্থিতি উপস্থিত হলে দূরে পাড়ি জমাতে দেখা গিয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানে শামুকখোলের সংখ্যা অনেক কমেছে এবং শ্রীলঙ্কাও ওদের আর প্রজননভূমি নয়।

গাছের ডালে শামুকখোল পরিবার। ছবি: সংগৃহীত।

শামুকখোল বেশ বড় আকারের পাখি। লম্বায় ৮১ সেমি। ডানার দৈর্ঘ্য ৪০ সেমি। লেজ রং ফ্যাকাশে সাদা বা ধূসর। চঞ্চু ও পায়ের রঙ লালচে। লেজ ও ডানার শেষ প্রান্ত কালো। লেজের আগা দ্বিখণ্ডিত। প্রজনন ঋতুতে অবশ্য এদের রং অনেকটা সাদা হয়ে যায়। এদের স্ত্রী ও পুরুষ একইরকম দেখতে। কেবল প্রজনন ঋতুতে আচরণ দেখেই পার্থক্য করা সম্ভব। কমবয়সীদের পালকে সামান্য বাদামি আভা থাকে। শামুকখোলের ওজন হয় ১.৩ কেজি থেকে ১.৫ কেজি।

এদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ যে চঞ্চু তা আগেই বলেছি। কিন্তু এমন চঞ্চুর যে কী কাজ তা নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছনো যায়নি। স্যার জুলিয়ান হাক্সলের মতে শামুকখোলের এই জাঁতিকলের মতো চঞ্চু শামুকের খোলা ভেঙে খেতে সাহায্য করে। কিন্তু এই ধারণা পরবর্তীকালে পক্ষিবিদেরা নস্যাৎ করেছেন। অপ্রাপ্তবয়স্করা যাদের চঞ্চুতে ফাঁক নেই তারাও তো শামুক খায়। তাঁদের মতে, চঞ্চুর ভেতরের কিনারার অমসৃণ প্রান্ত পিচ্ছিল শামুককে দৃঢ়ভাবে ধরতে সাহায্য করে। আর ওই ফাঁক থাকায় চঞ্চুর সূচালো আগা দিয়ে শামুকের খোলে বেশি বলপ্রয়োগ করে সহজে ভাঙা যায়। জলের ভেতর মাথা-গলা ডুবিয়ে শামুক, গুগলি, ঝিনুক ইত্যদি ধরার সময় চঞ্চুর দুটো আগাকে ডাইনে-বামে সামান্য সরিয়ে ধরে যাতে খাবার পিছলে না যায়। তারপর উপরের ও নীচের চঞ্চুর অংশ দিয়ে উল্লম্বভাবে খাবারের উপর বলপ্রয়োগ করে খোলক ভেঙে ফেলে। তারপর মুখটাকে ওপরের দিকে তুলে মাংসল খাবারটাকে গিলে নেয়। তবে শামুকখোলেরা সাপ, ব্যাঙ, চিংড়ি, কাঁকড়া, জলজ পোকা, মাছ ইত্যদিও খায়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

শামুকখোল খুবই সামাজিক পাখি। দল বেঁধে থাকে ও দল বেঁধে খাবার সংগ্রহে যায়। আকাশে অনেক উঁচুতে উঠে চিল, বাজ, শকুনদের মতো এদেরও গ্লাইডিং করতে অর্থাৎ প্রসারিত ডানা স্থির রেখে বাতাসে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। এরা মূলত নির্বাক পাখি। পাখিদের শব্দ সৃষ্টিকারী অঙ্গ হল সিরিংস। শামুকখোলের সিরিংস পেশি না থাকায় শব্দ সৃষ্টি করতে পারে না। প্রয়োজনে কেবল খুব মৃদু স্বরে একরকম যন্ত্রণাদায়ক শব্দ ‘হো-হো’ করে। তবে প্রজনন ঋতুতে এরা নিজের চঞ্চুর দুটো অংশে ঠোকাঠুকি করে শব্দ সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে বার্তা বিনিময় করে।

জুন থেকে ডিসেম্বর মাস হল শামুকখোলের প্রজনন ঋতু। এই সময় একটা স্ত্রী ও পুরুষ শামুকখোল জোড় বাঁধে। এরকম অনেক জোড় কোনও বড় গাছের উপরের দিকে বাসা বানানোর জন্য জায়গা নির্বাচন করে নেয়। জোড় বাঁধার আগে স্ত্রী পাখির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পুরুষ পাখিরা নানা চেষ্টা করে, যেমন মানবসমাজে মেয়েদের মন পেতে পুরুষরাও করে। সে স্ত্রী পাখিকে বাসা বানানোর উপযুক্ত স্থান দেখাতে চায় এবং বাসা বানানোর উপকরণ নিয়ে এসে নিজের যোগ্যতা ও ইচ্ছে প্রদর্শন করে। এসব দেখে স্ত্রী শামুকখোল উপযুক্ত পুরুষ সঙ্গীকে বেছে নেয়। বাসা বানানোর গাছে যেসব পুরুষ শামুকখোল দেরিতে এসে পৌঁছোয় তারা অন্য পুরুষদের লড়াইয়ে আহ্বান করে। লড়াইতে নবাগত জিতে গেলে পরাজিত পুরুষকে সরিয়ে সে স্ত্রী শামুকখোলের দখল নেয়। কখনও কখনও দেখা গেছে একটি পুরুষ দুটো স্ত্রীর সঙ্গে জোড় বাঁধছে।

বাসায় শামুকখোল দম্পতি। ছবি: সংগৃহীত।

মানবসমাজে পুরুষের বহুবিবাহ আইনসম্মত না হলেও শামুকখোলের সমাজে দিব্যি বহাল! এক্ষেত্রে দুটো স্ত্রী পাখি একটাই বাসা বানায় ও একই বাসায় ডিম পাড়ে। এক বাড়িতে দু’জায়ের মধ্যে, এমনকি দু’বোনের মধ্যে মিল হয় না, কিন্তু দুটো প্রেমিকা নিয়ে একটা প্রেমিক শামুকখোলের কোনও ঝামেলা হয় না! প্রেমপর্বের সময় ওদের পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে দেখা যায়। সে নির্বাক প্রেমালাপের ভাষা বোঝার সাধ্য মানুষের নেই, তবে পরষ্পরের গলায় চঞ্চু ছুঁইয়ে ভালোবাসার পরশ দেওয়ার দৃশ্য আমাদের নজর এড়ায় না।

যে বছর খরা হয় সেই বছর শামুকখোলের প্রজনন বন্ধ থাকে। বর্ষাকাল হল এদের প্রজননের আদর্শ সময়। এই সময় স্ত্রী-পুরুষের জোড় গাছের ১৫ থেকে ৬০ ফুট উচ্চতার মধ্যে বাসা বানানোর জন্য স্থান নির্বাচন করে। এক-একটা গাছে বিশ-তিরিশ থেকে ১৫০টা পর্যন্ত বাসা দেখা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে বাসা বানায়। তবে প্রধাণত পুরুষ উপকরণ সংগ্রহ করে ও স্ত্রী বাসা বানায়। ঘাস, পাতা, কাঠি ও শুকনো ডাল দিয়ে তৈরি হয় বাসা। বাসার দৈর্ঘ্য হয় প্রায় সাড়ে তিন ফুট, আর ব্যাস প্রায় এক ফুট। ১০-১২ দিন লাগে বাসা বানাতে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

এ সময় শামুকখোলরা সাধারণত বাসা থেকে এক-দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। স্ত্রী পাখি ২-৫টি ডিম পাড়ে। ডিমের সাইজ মুরগির ডিমের মতো। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ে মিলে ডিমে তা দেয়, আর তা দিতে দিতে বাসার আয়তন বাড়ায়। ২৭-৩০ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চারা জন্মানোর পর বাবা-মা বাচ্চাদের পাহারা দেয় যতদিন না তারা কিছুটা বড়ো হচ্ছে। বাবা-মা উভয়ে মিলেই বাচ্চাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনে। ৩৫-৩৬ দিন বয়স হলে তারা উড়তে সক্ষম হয়। তখন তারা বাবা-মায়ের সাথে খাবারের সন্ধানে কাছাকাছি জলাশয়ে উড়ে যায়। সেখানে বাবা-মার সাথে তারা খাবার সংগ্রহ করা শেখে। প্রায় ৬০ দিন বয়সে ওরা সম্পূর্ণ প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে। তখন তারা বাবা-মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করে একই গোষ্ঠীর মধ্যে সঙ্গিনী খুঁজে নেয় এবং নিজেদের গোষ্ঠীতেই থেকে যায়। একটা শামুকখোল সাধারণতঃ ১৮ বছর বাঁচে।

ভারতে শামুকখোলের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি বলে IUCN-এর লাল তালিকায় এদের ন্যূণতম বিপদগ্রস্ত বলে বলা হয়েছে। তবে এরা সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। এ বছর (২০১৬) ১৩ অক্টোবর দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানা গেল দুর্গা পুজোর মধ্যে বর্ধমানের লাউদোহা ব্লকে বাবুরবাগ জলাভূমিতে শিকারিরা প্রায় ৫০০ শামুকখোলকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করেছে। প্রতিটি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর সেই শামুকখোলের মাংস রান্না করে সুরা সহযোগে উদরস্থ করে পুজো ‘এনজয়’ করেছে যুবক সম্প্রদায়ের একাংশ।

দল বেঁধে শামুকখোলের শিকার। ছবি: সংগৃহীত।

এছাড়া কৃষিজমিতে দিনে দিনে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে তাতে শামুক, গুগলি, ঝিনুক, মাছ, ব্যাঙ ইত্যদি মরে গিয়ে শামুকখোলের খাদ্যাভাব ঘটছে। এরা খোলা জলাশয় থেকে খাবার সংগ্রহ করে। কিন্তু দিন দিন যেভাবে জলাভূমি বুজিয়ে ঘর-বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে এবং জলাশয়গুলো কচুরিপানায় ভরে যাচ্ছে তাতে শামুকখোলের খাবারে টান পড়তে বাধ্য। শামুকখোল বাসা বানায় বড় বড় গাছে। বৃক্ষচ্ছেদন ও বনভূমি সংকোচন কেড়ে নিচ্ছে ওদের প্রজননের স্থান। আমি নিশ্চিত, সুন্দরবনের বসতি এলাকা থেকে একসময় শামুকখোল প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পিছনে কীটনাশকের ব্যবহার, জলাভূমি হ্রাস ও বৃক্ষচ্ছেদন, এই তিনটি কারণই ছিল মুখ্য।

শামুকখোল জলাভূমির খাদ্যশৃঙ্খলের সর্বোচ্চ খাদকদের অন্যতম। আর যে কোনও খাদ্যশৃঙ্খলে সর্বোচ্চ শ্রেণির খাদকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শামুকখোল কমে যাওয়ার অর্থ জলাভূমির খাদ্যশৃঙ্খলের বিপর্যয়। এরা জলাশয়ে খাবার সংগ্রহের সময় প্রচুর মল ত্যাগ করে, যা নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সমৃদ্ধ। মল জলে মিশে জলজ উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বাড়ায়। জলের প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ বাড়লে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যদির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এতে মৎসভুক বাঙালির লাভ। আবার যে আপেল শামুক ধান চাষের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর তা খেয়ে চাষিরও উপকার করে। সুতরাং শামুকখোল পরোক্ষভাবে মানুষের অনেক উপকার করে। ওরা যাতে নিরুপদ্রবে বাঁচতে পারে ও প্রজনন করতে পারে সেদিকে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নতুবা শামুকখোল কোথাও কোথাও দুর্লভ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্লভ পাখিতে পরিণত হবে। —চলবে।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।

Skip to content