(বাঁদিক থেকে) প্রজনন ঋতুতে বিশেষ প্রজনন পালকসহ বড় বক। উড়ন্ত বড় বক। গাছে বিশ্রামরত বড় বক। খাবারের খোঁজে বড় বক। ছবি: সংগৃহীত।
সুন্দরবন অঞ্চলে যেখানে অরণ্য রয়েছে সেখানে বড় গাছের ওপরে নানা ধরনের বক, পানকৌড়ি ও সারসকে বাসা বাঁধতে দেখা যায়। আর সেখানে তাদের মধ্যে বেশ বড় আকারের দুধ-সাদা এক জাতের বককেও দেখা যায়। বড় মানে উচ্চতায় একজন মানুষের কোমর প্রমাণ উচ্চতার থেকেও কিছুটা বেশি উঁচু। যখন ডানা মেলে উড়ে যায় তখন দুই ডানার বিস্তার হয় ৪ থেকে ৫ ফুট। আর ওজন হয় ৭০০ গ্রাম থেকে ১২০০ গ্রাম। এই বিরাটাকার বক ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে মূলতঃ জঙ্গল এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যায়। এই বকের নাম বড় বক, ইংরেজিতে ‘Great egret’, বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Ardea alba’। সুন্দরবন অঞ্চলে যে বড় বক দেখা যায় তা ভারতসহ শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, চীন, কোরিয়া, জাপান, উত্তর-পূর্ব রাশিয়া, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে দেখা যায়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রাপ্ত বড় বকের চারটি উপপ্রজাতির মধ্যে এই উপপ্রজাতিটির নাম হল ‘modesta’।
অন্যান্য বকদের মতো বড় বকের ক্ষেত্রেও প্রজনন ঋতুতে ভিন্ন ধরনের কিছু পালক তৈরি হয়। তবে এই পালকের রঙও হয় সাদা। পালকগুলো বেশ বড় এবং ঘাড়, গলা ও দেহের পিছন দিকে তৈরি হয়ে ঝুলে যায়। প্রজননকালে এদের চঞ্চুর রঙ হয় কালো, যদিও অন্যসময় রঙ থাকে হলুদ। টিঙ-টিঙে লম্বা লম্বা পায়ের রঙ সাধারণত কালো। তবে প্রজননের ঋতুতে এদের চঞ্চুর পেছনে এবং চোখের আশপাশে যেখানে কোনও পালক থাকে না সেই অংশ সবুজ রঙ ধারণ করে। এদের গলা সমস্ত জাতের বকের থেকে বেশি লম্বা। দেখা গেছে এদের দেহের থেকে দেড় গুণ বেশি লম্বা হয় গলা। আর এরা যখন ওড়ে তখন এই লম্বা গলা ইংরেজি এস এর মত বেঁকে গুটিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৪: সুন্দরবনের পাখি— গোবক
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
বড় বক উপকূলীয় অঞ্চলে নদী, খাঁড়ি বা জলাভূমিতে খাবার সংগ্রহ করে এবং এগুলির পাশে উঁচু গাছে বাসা বাঁধে। এদের প্রধান খাবার হল মাছ। তবে শামুক জাতীয় প্রাণী, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ, সরীসৃপ, পোকামাকড় এবং ইঁদুর বা ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীও সুযোগ পেলে শিকার করে। এরা জলের মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কখন শিকার সাঁতার কেটে সামনে দিয়ে যাবে বা ভেসে উঠবে তার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর শিকার দেখতে পেলেই বিদ্যুৎ গতিতে বর্শার ফলার মতো অসম্ভব তীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে শিকারকে আঘাত করে।
সাধারণত ভোর ও গোধূলি বেলায় এরা খাদ্য সংগ্রহ করে। তবে মেঘলা দিনে বা ছায়াচ্ছন্ন এলাকায় দিনের বেলাতেও খাদ্য শিকার করতে দেখা যায়। এদের কখনও কখনও মনুষ্য বসতিযুক্ত অঞ্চলে মাছের ভেড়ি বা জলমগ্ন চাষের জমিতে খাদ্য সংগ্রহ করতেও দেখা যায়। এরা যেখানে খাদ্য সংগ্রহ করে তার আশেপাশে অন্য কোনও পাখির উপস্থিতি পছন্দ করে না। দেখতে পেলে ভয় দেখাতে তেড়ে যায়। এরা খুব জোরে উড়তে পারে না। ওড়ার গতিবেগ ঘন্টায় ২৫ কিমি থেকে ৩৫ কিমি। এরা যখন হাঁটে তখন গলাটাকে সামনের দিকে লম্বা করে প্রসারিত করে রাখে, আর ডানা দুটোকে দেহের সঙ্গে সংলগ্ন রাখে। এরা খুব একটা ডাকাডাকি করে না। তবে প্রজনন ঋতুতে বাসায় কুক্ কুক্ করে শব্দ করে। বড় বক সাধারণত গড়ে পনেরো বছর বাঁচে।
সাধারণত ভোর ও গোধূলি বেলায় এরা খাদ্য সংগ্রহ করে। তবে মেঘলা দিনে বা ছায়াচ্ছন্ন এলাকায় দিনের বেলাতেও খাদ্য শিকার করতে দেখা যায়। এদের কখনও কখনও মনুষ্য বসতিযুক্ত অঞ্চলে মাছের ভেড়ি বা জলমগ্ন চাষের জমিতে খাদ্য সংগ্রহ করতেও দেখা যায়। এরা যেখানে খাদ্য সংগ্রহ করে তার আশেপাশে অন্য কোনও পাখির উপস্থিতি পছন্দ করে না। দেখতে পেলে ভয় দেখাতে তেড়ে যায়। এরা খুব জোরে উড়তে পারে না। ওড়ার গতিবেগ ঘন্টায় ২৫ কিমি থেকে ৩৫ কিমি। এরা যখন হাঁটে তখন গলাটাকে সামনের দিকে লম্বা করে প্রসারিত করে রাখে, আর ডানা দুটোকে দেহের সঙ্গে সংলগ্ন রাখে। এরা খুব একটা ডাকাডাকি করে না। তবে প্রজনন ঋতুতে বাসায় কুক্ কুক্ করে শব্দ করে। বড় বক সাধারণত গড়ে পনেরো বছর বাঁচে।
আরও পড়ুন:
অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
বড় বক কোনও উঁচু গাছে মাটি থেকে ৬৬ ফুট বা তারও ওপরে বাসা বাঁধে। অন্যান্য পাখিদের সঙ্গে একই গাছে বাসা বাঁধলেও সাধারণত এরাই প্রথম বাসা বাঁধে। পরে পরে আসে অন্যরা। চ্যাটালো ধরনের বাসা শুকনো কাঠকুটো দিয়ে তৈরি করে। সাধারণত পুরুষ বড় বক কাঠকুটো সংগ্রহ করে এনে বাসা বাঁধার কাজ শুরু করে স্ত্রী বকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা শুরু করে। এমন ভাব দেখায় যেন বলতে চায়—এই দেখো আমি তোমার জন্য কী সুন্দর বাসা তৈরি করছি, এসো এবার বাসায় এসো। এরপর বাসা বাঁধার বাকি কাজ উভয় মিলে করে। পুরুষ বক কাঠকুটো বয়ে আনে ও স্ত্রী বক বাসা বাঁধে। এদের স্ত্রী ও পুরুষ একটি ঋতুর জন্য জোড় বাঁধে। দুই থেকে তিন বছর বয়স হলে বড় বক প্রজননে সক্ষম হয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই দেখতে একই রকম হলেও স্ত্রী বকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পুরুষ বক নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি করে। এদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল এরা একই প্রজননস্থলে বারবার বাসা বাঁধতে ফিরে আসে। বাসার ব্যাস হয় প্রায় তিন ফুট ও গভীরতা হয় প্রায় এক ফুট। অগোছালোভাবে তৈরি বাসায় স্ত্রী বড় বক হালকা নীলচে-সবুজ রঙের ২ থেকে ৬টি ডিম পাড়ে। বেশিরভাগ সময় ৩ বা ৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো বেশ বড়। লম্বায় প্রায় দুই ইঞ্চি এবং চওড়া প্রায় দেড় ইঞ্চি, অর্থাৎ প্রায় মুরগির ডিমের সাইজ। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই ডিমে তা দেয়।
২৩ থেকে ২৬ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরোলে তাদের পরিচর্যার ভার বাবা-মা উভয়ের উপর বর্তায়। বাচ্চারা জন্মের ৪০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে যায়। বড় বকের বাচ্চাদের মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশি। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আহত হয়ে বেশি মারা যায়। খাদ্যাভাব বা অন্য কোনও প্রতিকূলতায় পড়লে বাবা ও মা বক তাদের পছন্দমতো দুটি বা তিনটি বাচ্চাকে খাবার খাইয়ে বড় করে। বাকি বাচ্চাগুলি অনাহারে মারা যায়। তবে এদের বাচ্চারা খুব আক্রমণাত্মক হয়। অন্য কোনও খাদক প্রাণী বাচ্চাদের কাছে ঘেঁসলে ওরা চঞ্চু বাগিয়ে ভীষণ ভয় দেখায়।
২৩ থেকে ২৬ দিন তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে বাচ্চারা বেরোলে তাদের পরিচর্যার ভার বাবা-মা উভয়ের উপর বর্তায়। বাচ্চারা জন্মের ৪০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে উড়তে শিখে যায়। বড় বকের বাচ্চাদের মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশি। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আহত হয়ে বেশি মারা যায়। খাদ্যাভাব বা অন্য কোনও প্রতিকূলতায় পড়লে বাবা ও মা বক তাদের পছন্দমতো দুটি বা তিনটি বাচ্চাকে খাবার খাইয়ে বড় করে। বাকি বাচ্চাগুলি অনাহারে মারা যায়। তবে এদের বাচ্চারা খুব আক্রমণাত্মক হয়। অন্য কোনও খাদক প্রাণী বাচ্চাদের কাছে ঘেঁসলে ওরা চঞ্চু বাগিয়ে ভীষণ ভয় দেখায়।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন
সুন্দরবন অঞ্চলে বড় বকদের থেকে কিছুটা ছোট কিন্তু প্রায় একই রকম দেখতে আরেকটি জাতের বক দেখা যায়। এরা হলো মাঝারি বক, ইংরেজিতে ‘Medium egret’, বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘Ardea intermedia’। এরা লম্বায় হয় প্রায় ২২ থেকে ২৮ ইঞ্চি এবং ওড়ার সময় ডানার বিস্তার হয় ৪১ থেকে ৪৫ ইঞ্চি, আর ওজন হয় প্রায় ৪০০ গ্রাম। এদেরও চঞ্চুর রং হলুদ, পায়ের রং কালো এবং পালকের রঙ ধবধবে সাদা। তবে প্রজনন ঋতুতে এদের চঞ্চুর রঙ হয় কালো। প্রজনন ঋতুতে এদেরও স্ত্রী ও পুরুষ নির্বিশেষে লম্বা প্রজনন পালক তৈরি হয় গলায় ও পেছন দিকে। আর একটি বড় পার্থক্য হল চঞ্চুর পিছন দিক থেকে চোখ পর্যন্ত পালকবিহীন অংশ প্রজনন ঋতুতে হলুদ রঙ ধারণ করে। আর এই রং চোখ ছাড়িয়ে কখনওই পেছনদিকে যায় না। কিন্তু বড় বকের ক্ষেত্রে এই অংশের রং হয় সবুজ এবং তা চোখ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা পেছন পর্যন্ত প্রসারিত হয়। এটি একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। মাঝারি বকদের বাকি সব বৈশিষ্ট্য বড় বকদের মতোই।
(বাঁদিক থেকে) বাসা নির্মাণরত বড় বক। মাঝারি বক। বড় বকের মাছ শিকার। প্রজনন পালক-সহ মাঝারি বক। ছবি: সংগৃহীত।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে এই দুই ধরনের বক প্রচুর পরিমাণে প্রাণ দিয়েছে মানুষের সৌখিনতার মূল্য দিতে। এদের অসাধারণ সুন্দর পালকের লোভে মানুষ নির্বিচারে এদের হত্যা করেছে। অবশ্য বর্তমানে বিভিন্ন দেশে এরা সংরক্ষিত পাখির মর্যাদা পাওয়ায় এবং শৌখিন জিনিস তৈরির ক্ষেত্রে পাখির পালকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ায় এদের এখন আর হত্যা করা হয় না। আর তাই এদের সংখ্যাও সুন্দরবনের সাথে সাথে পৃথিবীর অন্যত্রও বেড়েছে। স্বস্তির খবর এটাই।
* সৌম্যকান্তি জানা। সুন্দরবনের ভূমিপুত্র। নিবাস কাকদ্বীপ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা। পেশা শিক্ষকতা। নেশা লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চা। জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ‘দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ২০১৬ সালে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ এবং শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান লেখক হিসেবে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ২০১৭ সালে ‘অমলেশচন্দ্র তালুকদার স্মৃতি সম্মান’ প্রদান করে সম্মানিত করেছে।