শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


মৈত্রেয়ী দেবী।

সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। এই উদারচেতা ভোলেভালা দার্শনিক মানুষটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। বয়সে সুরেন্দ্রনাথ ছোটো হলেও বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। কবির সঙ্গে তাঁর বড়ো মধুর সম্পর্ক ছিল। বন্ধুকন্যা মৈত্রেয়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই স্নেহময়। তাঁর স্নেহময়তার কোনো তুলনা হয় না। আত্মজন যেমন সেই স্নেহসুধায় স্নাত হয়েছেন, তেমনই স্নাত হয়েছেন অনাত্মীয় দূরের মানুষ। আপাতভাবে দূরের মানুষ, কিন্তু তাঁর জীবনও কবির স্নেহধারায় ভরে উঠেছে, এমনতরো দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর। লিখতেন, যত না লিখতেন, তাঁর থেকে ঢের বেশি পড়তেন। জীবনের প্রথম দিকে লিখতেন কবিতা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বছর ষোলো যখন বয়েস,তখনই বের হয়েছিল তাঁর প্রথম বই। সে বইয়ের নাম ‘উদিতা’। ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। এই উদারচেতা ভোলেভালা দার্শনিক মানুষটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। বয়সে সুরেন্দ্রনাথ ছোটো হলেও বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। কবির সঙ্গে তাঁর বড়ো মধুর সম্পর্ক ছিল। বন্ধুকন্যা মৈত্রেয়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই স্নেহময়। তাঁর স্নেহময়তার কোনো তুলনা হয় না। আত্মজন যেমন সেই স্নেহসুধায় স্নাত হয়েছেন, তেমনই স্নাত হয়েছেন অনাত্মীয় দূরের মানুষ। আপাতভাবে দূরের মানুষ, কিন্তু তাঁর জীবনও কবির স্নেহধারায় ভরে উঠেছে, এমনতরো দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর। লিখতেন, যত না লিখতেন, তাঁর থেকে ঢের বেশি পড়তেন। জীবনের প্রথম দিকে লিখতেন কবিতা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, বছর ষোলো যখন বয়েস,তখনই বের হয়েছিল তাঁর প্রথম বই। সে বইয়ের নাম ‘উদিতা’। ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৩: চোর-ডাকাতও যদি দান-ধ্যান করে, তবে লোকে ‘তাকে’-ও ভগবানের মতোই শ্রদ্ধা করে

কবি তখন অসুস্থ,শয্যাশায়ী। তারই মধ্যে অব্যাহত কবির রসিকতা। মৈত্রেয়ী তখন কলকাতায়। অসুস্থ কবির সেবা-শুশ্রূষা করার তাগিদে ছিলেন জোড়াসাঁকোয়। একটানা ছিলেন মাসখানেক। সারাক্ষণই থাকতেন কবির শয্যাপার্শ্বে। তাঁকে দু-দণ্ড দেখতে না পেলেই কবির গলায় শোনা যেত সহাস্য জিজ্ঞাসা,’তুমি ক্ষণে ক্ষণে যাও কোথায়, মংপু নাকি?’

মৈত্রেয়ী দেবী যেভাবে অকাতরে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের সেবা করেছেন, পরিচর্যা করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। শুধু তিনি একা নন, রাণী চন্দ ও প্রতিমা দেবীও সঙ্গে থেকেছেন সব সময়। একদিন জোড়াসাঁকোয় আকস্মিক এক ‘সুন্দর অভিজ্ঞতা’ হয়েছিল মৈত্রেয়ী দেবীর। দুপুরের দিকে ঢুলুনি এসেছে, ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। যখন ঘুম ভাঙল, দেখলেন ‘শুভ্রবেশা শুভ্রকেশা মহিমান্বিত সরলা দেবী’ তাঁর মুখের দিকে ঝুঁকে বাতাস করছেন। সরলা দেবীর এই মমতাময়ী রূপ মৈত্রেয়ীকে মুগ্ধ করেছিল। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কেন?’ সরলা দেবী হেসেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, ‘আহা তাতে কি? সারারাত জাগো, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ, তাই…।’

রবীন্দ্রনাথ ও মৈত্রেয়ী।

ডাঃ নীলরতন সরকার রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করতেন। তাঁর ওষুধ কথা বলত। কবির কিডনি ইনফেকশন কমে, জ্বরও বিদেয় হয়। মৈত্রেয়ী অনেক দিন ধরে বাড়িঘর, স্বামী-সংসার, পাহাড় ছেড়ে রয়েছেন কবির পাহারায়। কবি শারীরিকভাবে একটু ভালো হতেই মৈত্রেয়ী কবি-পুত্রের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুমোদন চেয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ অনুমতি দিয়ে বলেছিলেন,’যাও, আবার মাসখানেক পরে এসো। কবির পুত্রবধূ প্রতিমা অবশ্য মৈত্রেয়ীকে সানন্দে ফিরে যাওয়ার ছাড়পত্র দিতে পারেননি। বলেছেন, ‘বাবামশায়ের তোমার জন্য মন কেমন করবে।’

স্বামী মনোমোহন পাহাড়ে একলা রয়েছেন। উতলা হয়ে মৈত্রেয়ী শেষ পর্যন্ত ফিরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে কবিপুত্রের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘রথীদা, শেষ সময় যেন খবর পাই। আমাকে ভুলে যাবেন না তো?’

ক-টা দিন মৈত্রেয়ীকে কাছে পেয়ে প্রবল অসুস্থতার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল। সুধাকান্ত রায়চৌধুরী অনেক ভনিতা করার পর যখন মৈত্রেয়ী দেবীর চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে শুনে কবি শুধু দুঃখই পাননি, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। সে বর্ণনা আছে মৈত্রেয়ী দেবীর ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ বইতে। পত্নী মৈত্রেয়ী না থাকায় মনোমোহনের দুর্গতির শেষ থাকেনি। রবীন্দ্রনাথও ভাবনায় পড়েছিলেন, কী খাবেন! আহা, বেচারা মংপুতে একা রয়েছেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

চিন্তিত রবীন্দ্রনাথ মনোমোহনের উদ্দেশে চিঠির খসড়া মনে মনে তৈরি করেছিলেন।সে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন রানী চন্দ। কাঁপা কাঁপা হাতে কবি স্বাক্ষর করেছিলেন। সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,’মৈত্রেয়ীর সহযোগে যে অকৃত্রিম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাকে তোমাদের সেবা উপহার দিয়েছ এবং দীর্ঘকাল সাংসারিক অসুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও সহিষ্ণুভাবে এই দুঃখ স্বীকার করে নিয়েছ — এতে আমার হৃদয় বিগলিত হয়ে গিয়েছে। তোমাদের এই অর্ঘ্য চিরদিন আমার মনে থাকবে।’

মংপুতে রবীন্দ্রনাথ।

মংপুতে ফিরে গিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রনাথকে আর সেভাবে চিঠি লেখেননি। লিখলেই কবি উত্তর দিতে চাইবেন। নিজে পারবেন না, কাউকে লিখে দিতে বলবেন। এমন মনে হয়েছিল মৈত্রেয়ী দেবীর। মংপুতে ফিরে যাওয়ার পর কবি কেমন আছেন, শেষ পরিস্থিতি জানার জন্য আকুল হয়ে থাকতেন তিনি। নিয়মিত চিঠি লিখে খবর পাঠাতেন অমিতা ঠাকুর। কবি ‘মোটের উপর ভালো আছেন’ জেনে মৈত্রেয়ী দেবীও স্বস্তি প্রকাশ করতেন। এক চিঠিতে অমিতা দেবী মৈত্রেয়ীকে লিখেছিলেন, ‘তোমার নাম প্রায়ই করেন। … তোমার অনেক প্রশংসা করেন। তুমি ভাই সব দিক দিয়েই ভাগ্যবতী।’ অমিতার লেখা এরকম চিঠি প্রায়ই পাহাড়ে পৌঁছে যেত, মৈত্রেয়ী দেবীর মন খুশিতে ভরে উঠত।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে খানিক সুস্থ হলেন বটে, কিন্তু খাওয়াদাওয়ায় অরুচি গেল না। মুখ-বদলের ব্যবস্থা হল,মুখরোচক রান্নার আয়োজন হল। শান্তিনিকেতনে থাকতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ হেমলতা দেবী। তিনিও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন। ডাক দিলেন এক ভোজসভার। কবিতায় চিঠি লিখে সবার কাছে আমন্ত্রণ পাঠালেন। কবি একটু সুস্থ, তাই জোড়াসাঁকোয় পুরো না হলেও খানিক পুরোনো মেজাজ ফিরে আসে। মুখে হাসির আভা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথও খুশি-খুশি, মেজাজ ফুরফুরে। যেতে চাইলেন শান্তিনিকেতনে। ডাক্তাররাও অনুমতি দিলেন। মৈত্রেয়ী দেবীর সাধ হল,মংপুর কমলাবাগানের কমলা পাঠাবেন শান্তিনিকেতনে, কবির কাছে।

মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা প্রতিমা দেবীর চিঠি।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাক্সে ভরা কমলালেবু প্যাকিং করে পাঠালেন শান্তিনিকেতনে। কমলার প্রাপ্তি-স্বীকার কবি করলেন কবিতায়। কবি লিখলেন, ‘রসপাত্রগুলি / আনিল এ শয্যাতলে…।’ ছোট্ট এই কবিতাটিতে মিশে আছে কবির আনন্দানুভূতি। ‘রোগপঙ্গু লেখনীর বিরলভাষা’য় লেখা এ কবিতায় কবির বিষাদ-বেদনা গোপন থাকেনি। কবিতাটি অবশ্য কবি স্বহস্তে লেখেননি। অন্য কেউ লিখে দিয়েছিলেন। কবি শুধু স্বাক্ষর করেছিলেন, মৈত্রেয়ী দেবীর তা নজর এড়িয়ে যায়নি। বুঝতে পেরেছেন, গুরুদেব মেজাজে-মর্জিতে আগের মতো থাকলেও শরীর আর আগের মতো নেই। সারাক্ষণ যিনি লেখায় ডুবে থাকতেন, তিনি লেখার ক্ষমতা হারিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?

কমলা পেয়ে কবি যে আনন্দ পেয়েছেন, তা বুঝতে পেরে পরের মাসে মৈত্রেয়ী দেবী আবার এক বাক্স লেবু পাঠিয়েছিলেন। লেবু পেয়ে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ততদিনে তিনি খানিক সুস্থ হয়ে উঠেছেন। পত্রের প্রথমেই ছিল সুস্থ হয়ে ওঠার খবর, ‘তোমার কমলালেবু উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। এখন আমার প্রধান পানীয় এই কমলালেবুর রস।’ একথা জেনে সঙ্গত কারণেই মৈত্রেয়ী দেবী খুব খুশি হয়েছিলেন। কবির সহকারী সুধাকান্ত রায়চৌধুরীরও একটি পৃথক চিঠি পেয়েছিলেন। সে চিঠি থেকে বোঝা যায়, মৈত্রেয়ী দেবীর পাঠানো লেবু পেয়ে কতখানি আনন্দ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুধাকান্ত জানিয়েছিলেন, ’আপনার প্রেরিত কমলালেবু দেখে গুরুদেব যে কী আনন্দ পেয়েছেন সেটা ভাষায় বলতে পারব না।’ লেবুগুলো দেখেই গুরুদেব সুধাকান্তকে বলেছিলেন, ‘বেচারী আমাকে চিঠি লেখে না। পাছে আমার পড়তে বা জবাব দিতে কষ্ট হয়। কিন্তু আমার জন্য সর্বক্ষণ ভাবছে।’ এসব শুনে পুলকিত হওয়ার কথা। মৈত্রেয়ী দেবী শুধু পুলকিত হননি, উপলব্ধি করেছিলেন, ‘এ এক নিরন্তর উৎসারিত ভালোবাসা।’

মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি।

কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও জানিয়েছিলেন, কমলালেবু পেয়ে ‘বাবামশায়’ কতখানি খুশি হয়েছেন। তিনি প্রতিদিন কমলালেবুর রস করে দেন কবিকে, সে কথাও মৈত্রেয়ীকে জানিয়েছিলেন। এই সব ভালোলাগার মতো সংবাদ, এর পাশাপাশি এমন একটি খবর প্রতিমা দেবী তাঁকে জানিয়েছিলেন, যা প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল তাঁকে। প্রতিমা দেবীর চিঠি থেকেই জানতে পেরেছিলেন, পাঠানো ফলের বাক্সটিকেও কবি ফেলে দিতে দেননি। চেয়ারে বসলে সেটিকে পা রাখার চৌকি হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি।

আনন্দময় এই সংবাদ জেনে মৈত্রেয়ী দেবীর বিস্ময়ের শেষ থাকেনি। সেই ‘টুলের উপর রাখা চরণ দুখানি’ তিনি ‘হৃদয়ের মধ্যে অনুভব’ করেছিলেন।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content