প্রফুল্লময়ী।
কাজের সূত্রে ‘মন’ নিয়ে পড়াশুনা করি। আজ এমন একটি ভেয়ের কথা লিখছি, সময় যার মনখারাপের তোয়াক্কা করেনি। এখন ‘ডিপ্রেশন’ কথাটি বেশ বহুব্যবহৃত। ‘ডিপ্রেশন’ বলতেই অনেকের মনে পড়ে যাবে শ্রীজাতর কবিতার শেষ অংশ—‘ডিপ্রেশনের বাংলা জানি— মনখারাপ।’ আমি একটু অন্য কথা বলি? ফ্যাশনেবল মনখারাপের হালকা পর্দা সরিয়ে, চলুন চোখ রাখা যাক উনিশ শতকে, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। এমন গল্প শোনাই, যা ডিপ্রেশনেরও, আবার তার থেকে উত্তরণেরও।
ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর! অসম্ভব সুপুরুষ আর ততোধিক মেধাবী। অঙ্কশাস্ত্রে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। প্রেসিডেন্সি কলেজেও পড়াশুনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় এক অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ের। নাম প্রফুল্লময়ী। স্বর্ণচাঁপার পাপড়ির ফিকে সোনার মতো গায়ের রং, পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা ডাগর দুটি ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ, নিখুঁত মুখশ্রী, চমৎকার গড়ন, অপূর্ব গানের গলা—বীরেন্দ্র প্রফুল্লময়ী একেবারে রাজযোটক! প্রফুল্লময়ীর দিদি নীপময়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী। দিদির বিবাহসূত্রেই মায়ের সঙ্গে রূপকথার মতো সুন্দর সেই ঠাকুরবাড়িতে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন প্রফুল্লময়ী। তারপর সেই ঠাকুরবাড়ির লম্বা বারান্দা, খিলান, দেওয়াল, ঘরগুলি জানে তাঁর জীবনের ব্যথার গল্প!
ঠাকুরবাড়ির দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর! অসম্ভব সুপুরুষ আর ততোধিক মেধাবী। অঙ্কশাস্ত্রে তিনি ছিলেন বিশেষ পারদর্শী। প্রেসিডেন্সি কলেজেও পড়াশুনা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় এক অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ের। নাম প্রফুল্লময়ী। স্বর্ণচাঁপার পাপড়ির ফিকে সোনার মতো গায়ের রং, পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা ডাগর দুটি ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ, নিখুঁত মুখশ্রী, চমৎকার গড়ন, অপূর্ব গানের গলা—বীরেন্দ্র প্রফুল্লময়ী একেবারে রাজযোটক! প্রফুল্লময়ীর দিদি নীপময়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী। দিদির বিবাহসূত্রেই মায়ের সঙ্গে রূপকথার মতো সুন্দর সেই ঠাকুরবাড়িতে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন প্রফুল্লময়ী। তারপর সেই ঠাকুরবাড়ির লম্বা বারান্দা, খিলান, দেওয়াল, ঘরগুলি জানে তাঁর জীবনের ব্যথার গল্প!
১৮৬৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বীরেন্দ্র প্রফুল্লময়ীর বিয়ে হয়। পরে আত্মস্মৃতিতে ভুল করে প্রফুল্লময়ী লিখেছিলেন ‘আশ্বিনের ঝড়’ এর বছরে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু এই তথ্য ঠিক নয়। তবে একটা প্রবল কালো ঝড় প্রফুল্লময়ীর জন্য অপেক্ষা করছিল। যখন গলায় চিক, ঝিলদানা, চুড়ি, বালা, বাজুবন্ধ, বীরবৌলি, কানবালা, মাথায় জড়োয়ার সিঁথি, পায়জোড়, মল, দশভরির গোট এবং আরো অনেক গয়না পরে একটি বারো তেরো বছরের সুন্দরী মেয়ে সুসজ্জিত তাঞ্জামে চড়ে স্বামীগৃহে প্রবেশ করছেন, তখন তো তাঁর দুচোখ ভরা স্বপ্ন! কত সাধ আহ্লাদ জীবনকে ঘিরে। শুরুটা বেশ স্বপ্নের মতোই ছিল। বীরেন্দ্রনাথ সসম্মানে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, শাশুড়ি মা সারদাদেবীর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন প্রফুল্লময়ী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর গানের গলা শুনে গান শেখানোর ব্যবস্থা করলেন। একসময় কিশোর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাইতেন প্রফুল্লময়ী। কিন্তু নিয়তি তাঁর জন্যে অন্য গল্প বুনছিল। তাই বিয়ের ঠিক চারবছর পর বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন দেবেন্দ্রনাথের মেধাবী পুত্র বীরেন্দ্রনাথ। প্রফুল্লময়ীর জীবন থেকে খুশি শব্দটি মুছে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। অস্বাভাবিক স্বামী স্নান, আহার সব ত্যাগ করলেন। ঘরের চারদেওয়ালে চারকোল দিয়ে অঙ্ক কষে রাখতেন। সকলকে সন্দেহ করতেন। সেই সন্দেহের বিষে প্রফুল্লময়ীর জীবনের মুহূর্তগুলি হারিয়ে যেতে লাগলো ঝড়ের মুখে পড়া পাতার মতো। এক চামচ ভাত অথবা একটু পটলপোড়া —এই খাওয়াতে হিমসিম খেয়ে যেতেন। সকলে চিন্তিত! কিন্তু সমাধানহীন সমস্যা!
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ
অঙ্কে পারদর্শী বলে দেবেন্দ্রনাথ সংসার তহবিলের সমস্ত হিসাব রাখার কাজ দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথকে। মানসিক সমস্যার কারণে সেই কাজটিও আর করতে পারেন নি তিনি। তাঁকে সুস্থ করার প্রাথমিক চেষ্টা হিসেবে বোলপুরে হাওয়াবদল করানো, সাহেব ডাক্তার দেখানো, ড্রয়িং শেখানো —সবই হয়েছে। ফল হয়নি কোনও। অবশেষে বীরেন্দ্রনাথকে পাঠানো হল পাগলাগারদে। একলা তরুণী মেয়ে প্রফুল্লময়ী শুধু ঠাকুরবাড়ির গৃহবধূ হয়ে ঘরের এককোণে জীবন কাটাচ্ছিলেন সকলের উপহাস ও তামাশার পাত্রী হয়ে। যখন খুব অস্থির লাগতো, মনখারাপ করতো, তখন একলা ঘরে বসে নিজের যত কান্না উজাড় করে দিতেন। সেইসময় তিনি পাশে পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনীকে।
তারপর কয়েকবছর পাগলাগারদে কাটিয়ে একটু সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন বীরেন্দ্রনাথ। পরের বছর জন্ম হল বীরেন্দ্র প্রফুল্লময়ীর একমাত্র পুত্রসন্তান বলেন্দ্রনাথের। বীরেন্দ্রনাথ ফিরে আসার পরে প্রফুল্লময়ী একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছিলেন,একটি মেয়ে লাল শাড়ি পরে, একমাথা সিঁদুর মেখে, একটি সরাতে রক্তাক্ত ছাগমুণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রফুল্লময়ীকে বলা হয়েছিল এই স্বপ্ন শুভ। কাকতালীয়ভাবে তার পরেই বলেন্দ্রনাথের জন্ম হওয়ায় প্রফুল্লময়ীও সেকথাই মানতেন। কিন্তু আধুনিক যুগে আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের মানসিক পরিস্থিতিকে প্রতীকের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে। একটি মেয়েকে যখন উন্মাদ, ম্যানিক ডিপ্রেসিভ স্বামীর সঙ্গে একই ঘরে বাস করতে হয়, তাঁর মনের অবস্থা নিশ্চয়ই ভয়াবহই থাকে, ওই স্বপ্নের মতোন। একমাথা সিঁদুর আর বলিপ্রদত্ত ছাগমুণ্ড নিশ্চয়ই সেই মানসিক টানাপোড়েনের প্রতীক ছিল। সন্তান জন্মালো দুর্বল, অশক্ত হয়ে। প্রফুল্লময়ী নিজেও মৃতপ্রায় হয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের গতি তাঁকে আবার উঠিয়ে দাঁড় করালো। পুত্রলাভ তাঁকে পরিবারে কিছু মর্যাদা ফিরিয়ে দিল। আসলে, স্বামীর মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য ঠাকুরবাড়িতেও অনেকে তাঁকেই দায়ী করেছিল। সমাজ এখনো সেই দোষারোপ পদ্ধতি ভোলেনি। অথচ জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি থেকে জানা যায় বীরেন্দ্রনাথের মধ্যে আগে থেকেই এই ভারসাম্যহীনতা ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বীরেন্দ্রের বিষয় আমাদের যাহা ভয় ছিল তাহাই ঘটিল—বড় আক্ষেপের বিষয়।’
তারপর কয়েকবছর পাগলাগারদে কাটিয়ে একটু সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন বীরেন্দ্রনাথ। পরের বছর জন্ম হল বীরেন্দ্র প্রফুল্লময়ীর একমাত্র পুত্রসন্তান বলেন্দ্রনাথের। বীরেন্দ্রনাথ ফিরে আসার পরে প্রফুল্লময়ী একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছিলেন,একটি মেয়ে লাল শাড়ি পরে, একমাথা সিঁদুর মেখে, একটি সরাতে রক্তাক্ত ছাগমুণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রফুল্লময়ীকে বলা হয়েছিল এই স্বপ্ন শুভ। কাকতালীয়ভাবে তার পরেই বলেন্দ্রনাথের জন্ম হওয়ায় প্রফুল্লময়ীও সেকথাই মানতেন। কিন্তু আধুনিক যুগে আমরা জানি স্বপ্ন আমাদের মানসিক পরিস্থিতিকে প্রতীকের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে। একটি মেয়েকে যখন উন্মাদ, ম্যানিক ডিপ্রেসিভ স্বামীর সঙ্গে একই ঘরে বাস করতে হয়, তাঁর মনের অবস্থা নিশ্চয়ই ভয়াবহই থাকে, ওই স্বপ্নের মতোন। একমাথা সিঁদুর আর বলিপ্রদত্ত ছাগমুণ্ড নিশ্চয়ই সেই মানসিক টানাপোড়েনের প্রতীক ছিল। সন্তান জন্মালো দুর্বল, অশক্ত হয়ে। প্রফুল্লময়ী নিজেও মৃতপ্রায় হয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের গতি তাঁকে আবার উঠিয়ে দাঁড় করালো। পুত্রলাভ তাঁকে পরিবারে কিছু মর্যাদা ফিরিয়ে দিল। আসলে, স্বামীর মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য ঠাকুরবাড়িতেও অনেকে তাঁকেই দায়ী করেছিল। সমাজ এখনো সেই দোষারোপ পদ্ধতি ভোলেনি। অথচ জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি থেকে জানা যায় বীরেন্দ্রনাথের মধ্যে আগে থেকেই এই ভারসাম্যহীনতা ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বীরেন্দ্রের বিষয় আমাদের যাহা ভয় ছিল তাহাই ঘটিল—বড় আক্ষেপের বিষয়।’
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ
বলেন্দ্রনাথের জন্মের পর বীরেন্দ্রনাথ আবার সেই উন্মাদ দশায় ফিরে যান। প্রফুল্লময়ী সন্তানকে ঘিরে নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করেন। বলেন্দ্রনাথ বাবার অসুস্থতা ও মায়ের কষ্ট দেখে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে কিছু করে দেখাতে চাইতেন। আসলে উপহাস ও বঞ্চনার গল্প হয়তো তাঁরও পিছু ছাড়েনি। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহভাজন এই যুবকের বিয়ে হয় ছাব্বিশ বছর বয়সে সাহানা দেবীর সঙ্গে। প্রফুল্লময়ীর বড় আদরের ছিল তাঁর পুত্রবধূ। ঘর ভরা এই সুখটুকুও সহ্য হল না প্রফুল্লময়ীর। মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে বলেন্দ্রনাথ মারা গেলেন। এই শোকের মুহূর্তে হয়তো একটু এলোমেলো আচরণ করে ফেলেছিলেন প্রফুল্লময়ী।
বলেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধের আগের দিন তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন মৃণালিনী দেবীকে—‘নবোঠানের এক ছেলে , সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে ,তবু তিনি টাকাকড়ি কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত যেরকম ব্যপৃত আছেন, তাই দেখে সকলেই বিরক্ত হয়ে গেছে।’ একবারও কারো মনে হয়নি, সদ্য সন্তানহারা মা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করবেন না। নিজের লেখা স্মৃতিচারণে প্রফুল্লময়ী লিখেছিলেন, বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর ঘরের সামনে পড়ে থাকতেন তিনি। জল, ঝড়, বৃষ্টি —সব তাঁর উপর দিয়েই যেতো। কিন্তু পুত্রশোকে বেঁহুশ হয়েই থাকতেন তিনি। এই মেয়েটির ডিপ্রেশন আসাই স্বাভাবিক। তাই না? কিন্তু মনের সমস্ত শক্তি একজোট করে আবার তিনি উঠে দাঁড়ান পুত্রবধূ সাহানার মুখের দিকে তাকিয়ে।
বলেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধের আগের দিন তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন মৃণালিনী দেবীকে—‘নবোঠানের এক ছেলে , সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে ,তবু তিনি টাকাকড়ি কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত যেরকম ব্যপৃত আছেন, তাই দেখে সকলেই বিরক্ত হয়ে গেছে।’ একবারও কারো মনে হয়নি, সদ্য সন্তানহারা মা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করবেন না। নিজের লেখা স্মৃতিচারণে প্রফুল্লময়ী লিখেছিলেন, বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর ঘরের সামনে পড়ে থাকতেন তিনি। জল, ঝড়, বৃষ্টি —সব তাঁর উপর দিয়েই যেতো। কিন্তু পুত্রশোকে বেঁহুশ হয়েই থাকতেন তিনি। এই মেয়েটির ডিপ্রেশন আসাই স্বাভাবিক। তাই না? কিন্তু মনের সমস্ত শক্তি একজোট করে আবার তিনি উঠে দাঁড়ান পুত্রবধূ সাহানার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
তার আগে এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল তাঁর। ঈশ্বরচেতনা এবং আধ্যাত্মিক বোধ তাঁকে শক্তি দিল। অপৌত্তলিক ঠাকুরবাড়িতে এই গুরুর কাছে নত হওয়ার রীতি ছিল না। তবু, পরমহংস শিবনারায়ণ স্বামীর সাহচর্য, বিদ্যারত্ন মহাশয়ের গীতাপাঠ এবং বলেন্দ্রনাথের স্মৃতি তাঁকে সাহানার মা করে তুললো। পুত্রবধূকে লেখাপড়া , সেলাই ইত্যাদি শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিলেন তিনি। বিলেত পাঠিয়েছিলেন,এলাহাবাদে নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয়বার বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে রবীন্দ্রনাথ নিজে গিয়ে সেই বিবাহ বন্ধ করিয়ে আসেন। এরপর সাহানা দেবী শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অনুমতি দেন না এই বলে যে ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞান পড়ার সুবিধা আছে, কিন্তু তার জন্য সাহানাদেবীকে সর্বসমক্ষে বের হতে হবে। তা কী করে সম্ভব?
কেন নয়? তাও অস্পষ্ট। কারণ ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা তো তখন পর্দানশীন ছিলেন না। ঠাকুরবাড়ির অন্দরে প্রফুল্লময়ী সবসময়ই দুঃখিনী। স্বামী উন্মাদ এবং পুত্র মৃত—তাই দুটি নারীর জন্য শুধু মাসোহরা নির্দিষ্ট ছিল। সম্পত্তির অংশে অধিকার ছিল না। একটা সময় প্রফুল্লময়ী হাওড়াতে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। একাকিত্ব ছিল। কিন্তু সেই নির্জনতা তাঁকে নতুন বোধের জগতে নিয়ে যায়। পুত্র মারা যাওয়ার পর গেরুয়া পরতেন। দুইহাতে শুধু শাঁখা—এই ছিল অলঙ্কার। বীরেন্দ্রনাথকে জানাতে পারেননি পুত্রের মৃত্যুসংবাদ। সব কষ্ট একাই গ্রহণ করেছেন। যেন নীলকন্ঠ!
কেন নয়? তাও অস্পষ্ট। কারণ ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা তো তখন পর্দানশীন ছিলেন না। ঠাকুরবাড়ির অন্দরে প্রফুল্লময়ী সবসময়ই দুঃখিনী। স্বামী উন্মাদ এবং পুত্র মৃত—তাই দুটি নারীর জন্য শুধু মাসোহরা নির্দিষ্ট ছিল। সম্পত্তির অংশে অধিকার ছিল না। একটা সময় প্রফুল্লময়ী হাওড়াতে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। একাকিত্ব ছিল। কিন্তু সেই নির্জনতা তাঁকে নতুন বোধের জগতে নিয়ে যায়। পুত্র মারা যাওয়ার পর গেরুয়া পরতেন। দুইহাতে শুধু শাঁখা—এই ছিল অলঙ্কার। বীরেন্দ্রনাথকে জানাতে পারেননি পুত্রের মৃত্যুসংবাদ। সব কষ্ট একাই গ্রহণ করেছেন। যেন নীলকন্ঠ!
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
তারপর একে একে সকলে চলে গিয়েছে। বীরেন্দ্রনাথ, পুত্রতুল্য ভ্রাতুষ্পুত্র এবং প্রাণের প্রিয় পুত্রবধূ সাহানাও। একলা এই জগৎপারাবারের তীরে দাঁড়িয়ে কর্মকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। ফলের আশা না করে শুধু কর্ম করেই গিয়েছেন।
একদিন চার ঘোড়ার গাড়িতে করে যে পুরুষ এসেছিলেন রাজপুত্রের মতো, তাঁর অসুস্থতাকে গ্রহণ করেছেন নতশিরে। একমাত্র অবলম্বন পুত্রের মৃত্যুতে পৌঁছেছেন অধ্যাত্ম জগতে। পুত্রবধূর মৃত্যুতে গ্রন্থিমোচন হয়েছে তাঁর। কিন্তু কোনও ডিপ্রেশন তো মুহ্যমান করতে পারে নি তাঁকে। প্রতিবার আঘাতে আঘাতে খাঁটি সোনার মতো ঝলমলিয়ে উঠেছেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি রমা দেবীর উৎসাহে জীবনের প্রবীণ বয়সে যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন প্রফুল্লময়ী, সেখানে আমরা তাঁর শোকে জীর্ণ হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পাবো এক সন্ন্যাসিনীকে। প্রফুল্লময়ী লিখেছিলেন, ‘দুঃখশোক যদি জগতে না থাকিত, কেবল সুখের তরঙ্গে ভাসিয়া বেড়াইতাম, তবে বোধহয় অমৃতের সন্ধান পাইবার প্রবল ইচ্ছা জাগিয়া উঠিতো না বা মনের ভ্রম দূর হইতো না।’ আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘সেই শক্তি দাও যাহার গুণে বিপদও আমাদের নিকট তুচ্ছ হইয়া শান্তম শিবম রূপে প্রতীয়মান হয়।’
আজকের এই কফির কাপে দুই চুমুক দেওয়া আমাদের শখের ডিপ্রেশন কতো ফিকে হয়ে যায় উনিশ শতকের এই মেয়েটির জীবনযুদ্ধের কাছে। প্রফুল্লময়ী আসলে একটি অন্যরকম লড়াইয়ের নাম। —চলবে।
একদিন চার ঘোড়ার গাড়িতে করে যে পুরুষ এসেছিলেন রাজপুত্রের মতো, তাঁর অসুস্থতাকে গ্রহণ করেছেন নতশিরে। একমাত্র অবলম্বন পুত্রের মৃত্যুতে পৌঁছেছেন অধ্যাত্ম জগতে। পুত্রবধূর মৃত্যুতে গ্রন্থিমোচন হয়েছে তাঁর। কিন্তু কোনও ডিপ্রেশন তো মুহ্যমান করতে পারে নি তাঁকে। প্রতিবার আঘাতে আঘাতে খাঁটি সোনার মতো ঝলমলিয়ে উঠেছেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি রমা দেবীর উৎসাহে জীবনের প্রবীণ বয়সে যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন প্রফুল্লময়ী, সেখানে আমরা তাঁর শোকে জীর্ণ হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পাবো এক সন্ন্যাসিনীকে। প্রফুল্লময়ী লিখেছিলেন, ‘দুঃখশোক যদি জগতে না থাকিত, কেবল সুখের তরঙ্গে ভাসিয়া বেড়াইতাম, তবে বোধহয় অমৃতের সন্ধান পাইবার প্রবল ইচ্ছা জাগিয়া উঠিতো না বা মনের ভ্রম দূর হইতো না।’ আরাধ্য দেবতার উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘সেই শক্তি দাও যাহার গুণে বিপদও আমাদের নিকট তুচ্ছ হইয়া শান্তম শিবম রূপে প্রতীয়মান হয়।’
আজকের এই কফির কাপে দুই চুমুক দেওয়া আমাদের শখের ডিপ্রেশন কতো ফিকে হয়ে যায় উনিশ শতকের এই মেয়েটির জীবনযুদ্ধের কাছে। প্রফুল্লময়ী আসলে একটি অন্যরকম লড়াইয়ের নাম। —চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।