শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মহারাজা কল্যাণ মাণিক্যের সনদের লেখাটিকে ত্রিপুরার প্রাচীন বাংলা গদ্যের প্রামাণ্য নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কল্যাণ মাণিক্যের পরবর্তী রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের (১৬৬০-৭৩ খ্রিস্টাব্দ) সময়কালেও প্রশাসনিক গদ্যের প্রায় একই ধারা পরিলক্ষিত হয়েছে। গোবিন্দ মাণিক্যের একটি তাম্রশাসনের উল্লেখ করা হচ্ছে এখানে—”…রাজধানী হস্তিনাপুর সরকার উদয়পুর পরগণে মেহেরকুল মৌজে শোলনল অজহাসিলা জমা ১৯০ আঠার কানি ভূমি শ্রীনরসিংহ শর্ম্মারে ব্রক্ষ্ম উত্তর দিলাম এহার পাঁচা পঞ্চম ভেট বেগার ইত্যাদি মানা সুখে ভোগ করোক ইতি সন ১০৭৭ তেং ১৯ কার্ত্তিক শক ১৫৯৮ সন ১০৮৬ তেং ১৬ চৈত্র।”
সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে রাজা নরেন্দ্র মাণিক্যের সময়ে পলাতক যুবরাজ চম্পক রায়ের উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী রাজপুরুষদের লেখা পত্রটিকেও সেই আমলের ত্রিপুরার প্রশাসনিক গদ্যের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ। পত্রটি হচ্ছে—” নরেন্দ্র মাণিক্য রাজা হূই অনিতি এ প্রবর্ত্তে প্রজারো সুখ দুখ বিচার না করে এই কারণতে দেশ উচ্ছন্ন হইল আপনেও ঢাকাতে গৈয়া নিশ্চিন্তে রহিলেন এখন যেমন রত্ন মাণিক্যকে রাজা করি আপনেও যুবরাজ হয়া পূর্ব্ববতে প্রজাপালন করিবেন এই রূপ উপায়ক চিন্তি শীঘ্রে আসিবেন আমি ও আপনার সঙ্গতে আছো হেন জানিবেন।”
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩১: ত্রিপুরার রাজকার্যে বাংলা ভাষা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

ত্রিপুরায় সে সময়ের ব্যবহৃত বাংলা গদ্যের মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে ইতিহাসও। উল্লিখিত পত্রটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ত্রিপুরার সিংহাসনে তখন দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য। কিন্তু রাজা নিতান্ত নাবালক। বাংলার সুবাদারকে আগের তুলনায় আরও বেশি হস্তীকর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোগলদের সহায়তায় সিংহাসনে বসলেন নরেন্দ্র মাণিক্য। দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্যকে তিনি নজরবন্দি করে রাখলেন। দেওয়ান চম্পক রায়কে বন্দি করতে চাইলেন। কিন্তু চম্পক রায় পালিয়ে গেলেন ঢাকা। মোগলদের সহায়তায় সিংহাসনে বসা নরেন্দ্র মাণিক্যের প্রতি প্রজাদের কোনও সমর্থন ছিল না। প্রজাবৃন্দ আবার রত্ন মাণিক্যকেই সিংহাসনে দেখতে চেয়েছিলেন। এই সুযোগটা শেষপর্যন্ত কাজে লাগিয়েছেন চম্পক রায়।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্যের রাজত্বকাল হচ্ছে ১৬৮৫-১৭১২ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর আমলে মনুষ্য বিক্রয় (আত্মবিক্রয়) সম্পর্কিত একটি দলিলে সেই সময়ে ত্রিপুরায় প্রচলিত গদ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। দলিলটির কয়েকটি লাইন—”…শ্রীযুত রত্ন মাণিক্য মহারাজাধিকারে উদয়পুর সরকারান্তর্গত নূরনগর স্যামন্তঘর গ্রামে সপ্তদশাধিক ষোড়ষশত শকাব্দীয়াশ্বিনস্য দ্বিতীয়াংশে শ্রীঅনন্তরাম দেয়স্য সভায়ামনেক মুসলমান দ্বিজ সজ্জনাধিষ্ঠিতায়াং শ্রীভুবনেশ্বর ভট্টাচার্য্যস্য সকাশাদ্রাজত চতুর্মুদ্রামাদায় শ্রীসন্তোষ নাপিতেনময়া রাজস্বর্ণান্নোপহত্যা লিখিত বিত্তদাতরি স্বেচ্ছয়াত্মা বিক্রিত ইতি।”
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

এখানে যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে ত্রিপুরাতো বটেই, অন্যত্রও বাংলা গদ্যের তেমন বিকাশ ঘটেনি। তবে ত্রিপুরা সহ প্রান্তীয় রাজ্য সমূহের রাজসভার কাজে বাংলার ব্যবহার যেন অপরিহার্য ছিল। এমনকি সংস্কৃতকে যথেষ্ঠ সম্মান করেও রাজাগণ ‘কেজো’ ভাষা হিসেবে বাংলাকেই ব্যবহার করেছেন। সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক কালের ত্রিপুরার রাজাদের স্মারক মুদ্রা, শিলালিপি, তাম্রলেখ, রাজকীয় সনদ, চিঠিপত্র ইত্যাদি সহ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজাদের রাজত্বকালেও রাজকার্যে বাংলার নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার ছিল।

অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরার রাজকার্যে ব্যবহৃত বাংলা গদ্য সম্পর্কে এক ধারণা পাওয়া যায় ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ২য় ধর্ম মাণিক্যের রাজত্বকালের একটি সনদ থেকে। সনদটির কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে—”স্বস্তি শ্রী শ্রী যুত ধর্ম্ম মাণিক্য দেব বিষম সমর বিজয়ী মহামহোদয়ি রাজনামাদোসোয় শ্রীকারকোন বর্গে বিরাজত হন্যত রাজধানী হস্তিনাপুর সরকার উদয়পুর পরগণে কৈলাসহর মজুমদারি খেদমত শ্রীমমরাজ খাঁকে দিলাম…”।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজা জয় মাণিক্যের সনদের ভাষা ছিল এই রকম—”…রাজধানী হস্তিনাপুর সরকার উদয়পুর পরগণে কৈলাসহর শ্রী রামনারায়ণ চক্রবর্ত্তি ও শ্রী রঘুনাথ চক্রবর্ত্তি ও শ্রী কির্ত্তিনারায়ণ চক্রবর্ত্তিকে অজ হাঁশীহালে পুঁতে মহাফিক জায়মতে ৫/১ পাঁচ দ্রোণ এক কানি জমি ব্রহ্ম উত্তর দিলাম।…” আবার ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণ মাণিক্যের একটি সনদের ভাষা ছিল —”মাহাফিলক তপছিল ৮।০ জমি তোমারগ বেরা চাকর রাখনের জন্য ইনাম দেওয়া গেল। এই জমি দিয়া তোমারগ পুত্র পৌত্রাধিক্রমে বেরা চাকর রাখিয়া তোমরারগ আপন আপন কাজকর্ম্ম করাও। এই জমির মালখাজাজানা ও বৃসিংহ ইত্যাদির সমস্তাঙ্ক নিষেদ।” সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ত্রিপুরার রাজসভার কাজে পর্যায়ক্রমে বাংলা কি রূপ পরিগ্রহ করেছিল তার একটি আভাস পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ের রাজাদের উপরোক্ত সনদ সমূহের ভাষা থেকে।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের তুলনায় ত্রিপুরার রাজকার্যে প্রচলিত বাংলা গদ্য নিঃসন্দেহে আরও কিছু উন্নত রূপ পরিগ্রহ করেছিল ঊনবিংশ শতকে। কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৮২৯-৪৯ খ্রিঃ) কৈলাসহর অঞ্চলের কিছু প্রজা বাস্তভিটা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলে তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজা পরোয়ানা জারি করেছিলেন। সেদিন কী কারণে এই সব প্রজা বাস্তত্যাগ করেছিলেন তা জানা না গেলেও পরোয়ানাতে রাজার এ রকম অভয়বাণী ছিল যে, তারা ফিরে এলে তাদের সঙ্গে কোনো অন্যায় হবে না। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জারি করা পরোয়ানাটি হচ্ছে—”চিঠি রুজু-শ্রীবকস আলী ও ইচমাইল আলি সাকিন নিজ কৈলাসহর মোতালকে পর্ব্বত ত্রিপুরাকে সমাজ্ঞেয়ং কার্য্যঞ্চ পরং শোনা গেল তোমরা তোমাগ বাটী ছাড়িয়া অন্যখানে যাইয়া রহিয়াছ অতএব লিখা যায় তোমরা খাতির জমা হইয়া আপন বাটিতে আসিবা তোমাগ কোন বিষয় অন্যায় হইব না ইতি সন ১২৫৬। ১৮ কার্ত্তিক।”—চলবে।
* ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।

Skip to content