ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
কিছুটা সময় অপেক্ষা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে লঘুপতনক বলল, এখানে থেকে রোজ রোজ এ ভাবে চোখের সামনে জালে আটকে পড়ে পাখিদের মরতে আর দেখতে পারছি না। শাস্ত্রকাররা কি সাধে বলেছেন যে, দেশে অনাবৃষ্টি কিংবা খরার সময়ে সমস্ত ফলস নষ্ট হয়ে গেলেও সেই মানুষটিই ভাগ্যবান যাঁকে নিজের চোখে তাঁর নিজের দেশ বা তাঁর নিজের সমগ্র কুলের বিনাশ দেখতে হয় না। তাই জীবন থাকতে থাকতে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়াটাই ভালো।
সত্যি বলতে, কাজ করতে সমর্থ ব্যক্তিদের কাছে কোনো কাজই দুঃসাধ্য নয় — “কোঽতিভারঃ সমর্থানাম্?”। তেমনই উদ্যোগী ব্যবসায়ীদের কাছেও কোনও দেশই দূরদেশ নয়। ব্যবসা করে টাকা রোজগার করার জন্য তাঁরা অনায়াসে দূর-দূরান্তে দুর্গম প্রদেশের পাড়ি দেন। বিদ্বানদের কাছে যেমন পরদেশ বলে কিছু হয় না। যেখানেই তিনি গমন করেন সেখানেই আদর আপ্যায়ন পেয়ে থাকেন, ঠিক তেমনই প্রিয়বাদী মানুষদের কাছেও সকলেই হন আপনজন। তাঁদের শত্রু হয় না – সকলেই তাঁদের পছন্দ করেন—
বিদ্বত্বং চ নৃপত্বং চ নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ৫৮)
লঘুপতনকের কথা শুনে মুষিকরাজ হিরণ্যক বলল, ভাই তাই যদি হয় তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমারও এখানে খুবই দুঃখে কষ্টে দিন কাটছে।
কাকটি তখন খুবই আশ্চর্য হয়ে হিরণ্যককে জিজ্ঞাসা করল— তোমার আবার কী এত সমস্যা হল?
হিরণ্যক বলল— সে অনেক কথা ভাই! চলো এখন বেরিয়ে পড়া যাক! গন্তব্যে গিয়েই সব কথা বিস্তারে বলব।
লঘুপতনক তখন কিছুটা চিন্তা করে বলল, কিন্তু আমি তো আকাশ পথে উড়ে যাই—“অহং তাবৎ আকাশগতিঃ”! তুমি কি করে ভাই আমার সঙ্গে এতো দূর দেশে যাবে?
মুষিক হিরণ্যক তখন বলল— “ভাই! যদি চাও যে আমি বেঁচে থাকি তাহলে আমাকে তোমার পিঠে করে নিয়ে চলো। এছাড়া আমার আর কোনও গতি নেই—“নান্যথা মম গতিরস্তি”।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬০: বাস্তবে একে অপরের উপকার না করলে, কখনও মৈত্রী-বন্ধন তৈরি হয় না
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— রামবাণ ও পানি তাঙ্কি
হিরণ্যক বলল, আমি তো আকাশে ওড়াবার ব্যাপারে একেবারে অনভিজ্ঞ! তাই এই যে ওড়বার উপায়গুলোর কথা বলছিলে এগুলোর নাম জানতে ইচ্ছে করছে। লঘুপতন বলল—উড্ডীয়ন শাস্ত্রে এই নিয়ে অনেক কথা বলা আছে। শাস্ত্রের পাতায় লেখা আছে—
বক্রং তির্যক্তথা চোর্ধ্বমষ্টমং লঘুসংজ্ঞকম্।। (ঐ, ৫৯)
অর্থাৎ প্রথম উপায়টি হল ‘সম্পাতম্’ —ডানা না নাড়িয়ে সমভাবে বাতাসে ভর করে উড়ে চলা; দ্বিতীয় উপায় হল—‘বিপ্রপাতম্’। হাওয়ার ভরের বিপরীতে বিশেষভাবে ডানা মেরে উড়ে চলা। তৃতীয় উপায় হল ‘মহাপাতম্’ অর্থাৎ তীব্রগতিতে উড়ে যাওয়া। মাথা নিচু করে উড়ে যাওয়ার চতুর্থ উপায় হলো ‘নিপাতনম্’। বাতাসে ভারসাম্য বজায় রেখে এঁকেবেঁকে ওড়বারপঞ্চম কায়দাটা হল ‘বক্রম্’। সামনে থাকা বিভিন্ন বাধাকে এড়িয়ে ‘তির্যক্’ ভাবে উড়ে যাওয়াটা হল ষষ্ঠ উপায়। তীব্রগতিতে আকাশে উর্ধ্বমুখে উড়ে যাওয়া হলো ‘উর্ধ্বম্’ নামক সপ্তম উপায়। এবং অষ্টম এবং সর্বশেষ ওড়বার উপায়টি হল ‘লঘু’, যেক্ষেত্রে নিজের শরীরটাকে হালকা করে পাখিরা তীব্র গতিতে উড়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছয়।
মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
বায়স লঘুপতনকের এই বিচিত্র সব উড্ডীয়ন কৌশল শুনে মূষিক হিরণ্যক অত্যন্ত উত্সাহিত হয়ে তার পিঠে চড়ে বসলো।লঘুপতনকও তাকে পিঠে নিয়ে ‘সম্পাত’ গতিতে ধীরে ধীরে উড়তে উড়তেক্রমে সেই সরোবরে এসে উপস্থিত হল।
সেই সরোবরের দীর্ঘকাল ধরে বাস করতো মন্থরক নামে এক কচ্ছপ। সে মন্থর অর্থাৎ খুব ধীর গতিতে চলে বলেই তার নাম মন্থরক। দূর থেকে ইঁদুর পিঠে নিয়ে একটা কাককে সেই সরোবরের কাছে আসতে দেখে সে মন্থরক প্রাণভয়ে যতোটা তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে সেই সরোবরের জলে লুকিয়ে পড়ল। লঘুপতনক এসে সেই সরোবরের তীরে একটা গাছের কোটরে হিরণ্যককে নামিয়ে সেই গাছের ডাল থেকে তারস্বরে ডাকতে লাগলো, ওহে মন্থরক! এদিকে এসো। আমি তোমার বন্ধু, বায়স লঘুপতনক। বহুদিন পরে আজ তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য উত্কণ্ঠিত হয়ে এসেছি। তুমি কোথায় চলে গেলে? এসো আমরাপরস্পর আলিঙ্গন করি। কথায় আছে—
সর্বে তে মিত্রগাত্রস্য কলাং নার্হন্তি ষোডশীম্।। (ঐ, ৬০)
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৪: ঝোপে-ঝাড়ে হায়েনা
এবার বাক্পটু সেই বায়স লঘুপতনককে চিনতে এতটুকু দেরি হল না মন্থরকের। তাড়াতাড়ি জল থেকে বেরিয়ে এল সে। শরীরে তখন তার রোমাঞ্চ আর চোখে আনন্দাশ্রু। গদগদ কণ্ঠে এগিয়ে এসে সে লঘুপতনককে বলল, এসে বন্ধু এসো! তোমার আলিঙ্গন থেকে আমি যে বহুকাল বঞ্চিত হয়ে আছি। বহুদিন তোমাকে দেখিনি, তাই দূর থেকে চিনতে অসুবিধা হয়েছিল। তাই ভয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম জলের গভীরে। দেবগুরু বৃহস্পতিও তাঁর নীতিশাস্ত্রে বলেছেন, যাঁর পরাক্রম, বংশ পরিচয় কিংবা আচার-আচরণ সম্পর্কে জানা নেই তার সঙ্গে মেলামেশা করাটাও উচিত নয় একেবারেই। সেইজন্যেই তোমাকে দূর থেকে বুঝতে না পেরে লুকিয়ে পড়েছিলাম।
লঘুপতনক তখন গাছের ডাল থেকে নেমে এসে কূর্ম মন্থরককে জড়িয়ে ধরল। বলা ভালো— জলস্পর্শে তো কেবল শরীর শীতল হয় মাত্র। কিন্তু মিত্রের শরীরের স্পর্শে শরীর, মন—উভয়ই শীতল হয়। তাই যথার্থ বন্ধুর আলিঙ্গন এক অমূল্য সম্পদ।
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
লঘুপতনক তখন বলল, ওহে ইনি মূষিক হিরণ্যক। আমার বন্ধু, আমার দ্বিতীয় জীবন বলতে পারো। বলা ভালো—যেমন বাদলের ধারা, আকাশের তারা আর বালুকণা সংখ্যা দিয়ে গোণা যায় না, তেমনই এই মহান্ হিরণ্যকের গুণাবলীও সংখ্যার হিসেবে আসে না। ইনি অত্যন্ত গুণবান একজন ব্যক্তি কিন্তু কোনও এক বিশেষ কারণে স্বদেশের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ইনি আমার সঙ্গে এখানে তোমার কাছে চলে এসেছেন।
একটু থেকে হিরণ্যককে সে বলল— “তদ্ভদ্র হিরণ্যক! ইদানীং নিবেদ্যতামুভযোরাপ্যাবযোস্তদাত্মনো বৈরাগ্যকারণম্” — ভদ্র হিরণ্যক! এখান আমাদের দু’ জনকেই তোমার সেই বিরক্তির কারণটি বলো। লঘুপনকের কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিরণ্যক তখন বলতে শুরু করল।—চলবে।