ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
ইন্দ্রের যদিও এইরকম কীর্তিকাহিনি অনেক আছে। পুরাণের কাহিনি আছে যে বিমাতা দিতির সেবা করার ছলে ইন্দ্র নাকি দিতির বিশ্বাস অর্জন করে সুযোগ বুঝে তাঁর গর্ভ নষ্ট করে দিয়েছিল। কারণ সে শুনেছিল যে বিমাতা দিতির গর্ভে যে পুত্র জন্মাচ্ছে সে ইন্দ্রের বিরোধী হবে। ফলে সন্ধি-শপথ এসবের কোনও দাম নেই।
সত্যি বলতে যে, বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজের উন্নতি এবং দীর্ঘায়ু চায় তার দেবগুরুর মতো শুদ্ধচরিত্রের মানুষকেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। সামান্য ছিদ্র পেলেই জল যেমন সেই সূক্ষ্ম পথ দিয়েই নৌকায় ঢুকে নৌকাকে ডুবিয়ে দিতে পারে, শত্রুও ঠিক তেমনই ছিদ্র পেলেই সেখান দিয়ে প্রবেশ করে মানুষের ক্ষতি করে। তাই পণ্ডিতেরা বলে অবিশ্বাসের যোগ্য মানুষকে যেমন বিশ্বাস করা উচিত নয়, তেমনই বিশ্বস্ত মানুষকেও অন্ধের মতো বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারণ ইতিহাস সাক্ষী যে একে অপরের বিশ্বাস অর্জন করেও মানুষ একে অপরের ক্ষতি করে।
কূটনীতি বলে, বিশ্বাস না করলে অন্যন্ত দুর্বল ব্যক্তিকেও কোনও বলবান লোক মারতে পারে না। আবার শুধু অর্জিত বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েই একজন বলবান লোককেও একজন দুর্বল ব্যক্তি হত্যা করতে পারে। রাজনীতি শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা বলেন, যেসন্ধিনীতি তিনভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে। [১] আচার্য বিষ্ণুগুপ্ত অর্থাৎ চাণক্যের মতে, যথার্থ সন্ধি ভালো কাজের সহায়ক হতে পারে। ভালো কাজ করলে, অন্যায় না করলে, ভালো লোকেরা আপনিই সঙ্গে আসে। ফলে যথার্থ মানুষের সঙ্গে সন্ধি উদ্যোগী মানুষকে ভালো কাজ করতে উত্সাহ দেয়। ফলে সেই সন্ধি তার উদ্দেশ্যসিদ্ধির সহায়ক হয়। [২] দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মতে, সন্ধিকার্যের মাধ্যমে যথার্থ মিত্রপ্রাপ্তি হয়, যা সকল কার্যসিদ্ধির উপায় স্বরূপ। এবং [৩] দেবগুরু বৃহস্পতির মতে, শত্রুর উপর বিশ্বাস স্থাপন না করাটাও কিন্তু একটা পন্থা। অর্থাৎ শত্রুকেবিশ্বাস করে কখনই তার সঙ্গে সন্ধি করতে নেই।
হিরণ্যকের মুখে এইরকম যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা শুনে আর কি বলবে ভেবে পেলো না লঘুপতনক। বুঝতে পারলো যে এই মুষিক অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং নীতিশাস্ত্র বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আছে তার।যেভাবেই হোক এই হিরণ্যকের সঙ্গে তাই বন্ধুত্বটাকরতেই হবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, ওহে হিরণ্যক! এবার আমার কথাটা শুনুন—
তস্মাৎ ত্বং মিত্রতাং প্রাপ্তো বচনং তচ্ছৃণু।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ৪৮)
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৯: রাজ আমলের বাংলা গদ্য
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার
কাক বলল, ‘ভদ্র! এবং ভবতু।’ —বেশ কথা। তাই হোক।
তারপর থেকেই তারা দু’জনে সারাক্ষণ পরস্পর মিলে গল্পগুজব করে ভালো সময় কাটাতো। একে অপরের অনেক উপকার করে দিতো। কখনও লঘুপতনক কিছু মাংসের টুকরো কিংবা লোকে যে বায়সবলি দেয় তার কিছু অবশিষ্ট অংশ এনেহিরণ্যককে দিতো, আবার হিরণ্যকও কখনো কখনও চালের দানা কিংবা অন্যান্য ভোজ্য পদার্থের অবশেষ রাত্রিকালে জোগার করে এনে কাককে দিতো। পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন—
ভুঙ্ক্তে ভোজযতে চৈব ষড্বিধং প্রীতিলক্ষণম্।। (ঐ, ৫০)
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ
সুতরাং দান বা উপহার প্রদানের মাহাত্ম্য যে কতোটা ভয়ানক সেটা নিশ্চয় বোঝাই যাচ্ছে! দানের এমনই মহিমা যে শত্রু পর্যন্ত মিত্র হয়ে যায় কিছু না কিছু পেলে। পঞ্চতন্ত্রকার বলছেন, বিবেকজ্ঞানহীন মনুষ্যেতর প্রাণীরাও পর্যন্ত পুত্রের থেকেও বেশি দানকে বেশি গুরুত্ব দেয়। না হলে দুধ দোহন করবার সময়ে গাভীকে সামান্য খাবার দিলেই সে গাভী কেমন নিজের বাছুরটির জন্য কিছু মাত্র অবশিষ্ট না রেখে সবটাই দোহনকারীকে দিয়ে দেয়। আর প্রীতি এমনই একটা জিনিস যে নখ দিয়ে মাংস ছিন্ন করা হয় মানুষের আঙ্গুলে অগ্রভাগে সেই নখ আর মাংসই একসঙ্গে মিলে মিশে থাকে। শুধু তাই নয় বরং নখই মাংসকে সুরক্ষিত আর আবৃত রাখে। তাই প্রীতিদানের আদান-প্রদান থেকে ইঁদুর আর কাকের মধ্যে যে কৃত্রিম মিত্রতা গড়ে উঠেছিল জগতে সেটা কোনও বিরল দৃষ্টান্ত নয়। এমনকি সেই মুষিক হিরণ্যকের জন্য লঘুপতনক নিত্যদিন কিছু না কিছু উপকার করার চেষ্টা করতো আর সেই হিরণ্যক কিছুদিন পরে সেই কাকের প্রতি এতটাই অনুরক্ত হয়ে গিয়েছিল যে ডানার মধ্যে বসে একসঙ্গে নির্ভয়ে গল্প করতো।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
হিরণ্যক খুবই আশ্চর্য হয়ে বলল, ভাই! এই বিরক্তির কারণ কি? হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেন?
সে বলল, হে ভদ্র! শুনুন তবে। বেশ কিছু বছর ধরে এদেশে অনাবৃষ্টি চলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে এখন দুর্ভিক্ষ লোকের খাওয়ার কিছুই নেই। ঘরে ঘরে দিনের পর দিন লোকে উপবাস করছে। কেউ কেউ আবার তার মধ্যে খেতে না পেয়ে আমাদের মতো পাখিদেরকে ধরে খাওয়ার জন্য ফাঁদ পাতছে। আমি এইরকম একটা ফাঁদে পড়ে জালে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। শুধু আয়ু এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে বলেই কোনও ক্রমে উদ্ধার পেয়েছি। এইটাই বিরক্তির কারণ। এদেশের প্রতি আমার এখন মন উঠে গিয়েছে। তাই বিদেশ যাওয়াই স্থির করেছি। কিন্তু তোমাদের মতো বন্ধুদের কথা ভেবে চোখের জল ফেলছি।
হিরণ্যক বলল, কোথায় যাবেন কিছু স্থির করেছেন কি?
লঘুপনক বলল, দক্ষিণাপথে গহন বনের মধ্যে একটা বিশাল সরোবর আছে। সেখানে তোমার থেকেও অন্তরঙ্গ আমার মন্থরক নামে এক কচ্ছপ বন্ধু আছে। তার সঙ্গে আমার দীর্ঘকালের পরিচয়। সে আমাকে সব সময়ে সরোবরের মাছ ধরে দিতো। সেইটা খেতে খেতে তার সঙ্গে অনেক ভালো ভালো আলাপ আলোচনা করে একসময়ে একসঙ্গে অনেক কাল কাটিয়েছি আমরা। তার কাছেই যাব স্থির করেছি।—চলবে।