রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


নায়ক ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর ও উত্তমকুমার।

সত্যজিৎ রায় তখন একটি নতুন ছবির শুটিং করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। নিজেরই গল্প। নিজেরই চিত্রনাট্য। বাংলার এক বিখ্যাত হিরো অরিন্দম মুখোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করে এই গল্পের বিস্তার। অরিন্দম রাষ্ট্রপতি পুরস্কার আনতে চলেছেন দিল্লিতে। তাও আবার ট্রেনে। অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল কারণ বিখ্যাত নট অরিন্দম মুখোপাধ্যায় যে তাঁদের সহযাত্রী। যে ছবিকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা সে ছবির নাম ‘নায়ক’ এবং সেখানে নায়ক অরিন্দমের ভূমিকাতে সত্যজিৎ রায় নিয়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমারকে।
উত্তমকুমারের এই ছবির শুটিং শুরু করার আগে চিকেন পক্স হয়েছিল। ফলে মুখের মধ্যে একটা বসন্তের দাগ লেগেই ছিল। সত্যজিৎ রায় চেয়েছিলেন নায়ক ছবিতে উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ থাকবে না। একেবারে ‘নো মেকআপ লুক’ থাকবে। কিন্তু বসন্তের দাগগুলির কথা ভেবেই হয়তো উত্তমকুমার কথাটাকে অত সিরিয়াসলি নেননি। স্টুডিয়োতে ঢুকে উত্তমকুমার যে কাজটি করেন অর্থাৎ সরাসরি চলে যান মেকআপ রুমে। মেকআপ করতে বসে যান। ঠিক তেমনি ভাবে নায়ক ছবির সেদিনের শুটিংয়ে তিনি চলে গেলেন মেকআপ রুমে। বসে পড়লেন মেকআপের চেয়ার।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬১: এই আরজি কর হাসপাতালেই ময়নাতদন্তের জন্য ছবি বিশ্বাসের দেহ নিয়ে আসা হয়েছিল

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

ওই ছবির মেকআপ ম্যান ছিলেন বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট অনন্ত দাস। অনন্ত দাসকে সত্যজিৎ রায় বলেই দিয়েছিলেন যে উত্তমকুমারের কোনওরকম মেকআপ হবে না। এদিকে উত্তমকুমার চেয়ারে বসে পড়েছেন। তাঁকে তো উঠতেও বলা যাচ্ছে না। তখন অনন্ত সরাসরি চলে গেলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে। সবটা বললেন। তখন সত্যজিৎবাবু চলে এলেন মেকআপ রুমে। উত্তমকুমারকে বললেন, “উত্তম তোমার ফ্ল্যাশব্যাক সিনে শুধু মেকআপ হবে, আর বাকি সিনগুলিতে কোনওরকম মেকআপ হবে না। আজকের শটে কোনও মেকআপ লাগবে না”। উত্তমকুমার তো শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। ভাবতেই পাচ্ছেন না যে মেকআপ ছাড়া কি করে অভিনয় করা যায়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৭: দুবেজি যে রুষ্ট, তাঁর কথাতেই স্পষ্ট

উত্তম কুমার বললেন, “মানিকদা, একটুও কিছু করবেন না। আমার তো মুখে পক্সের দাগ রয়েছে একটু একটু”। সত্যজিৎ রায় তাতেও সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, “খালি চোখে দেখে তো কিছু মনে হচ্ছে না। বরং খুবই ভালো দেখাচ্ছে। আমি এই ন্যাচারাল লুকটাই চাইছি। যদি তোমার তেমন কিছু মনে হয়, আমি না হয় আজকের শুটিংয়ের রাশ তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। তুমি দেখো। কিছু মনে হলে না হয় দেখা যাবে”।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

সেদিনের শুটিং তো হল। কিন্তু মেকআপ ছাড়া শুটিং করে যে উত্তমকুমার খুব খুশি হয়েছেন এমনটা নয়। মজাটা হল কিন্তু পরের দিন। সত্যজিৎ রায় ইউনিট থেকে নানান কাজের ফাঁকে সেদিনের শুটিংয়ের রাশ উত্তমকুমারের কাছে পাঠালেন। রাশ দেখে উত্তমকুমার অবাক। অত্যন্ত খুশি হলেন রাশ দেখে। তিনি সত্যজিৎ রায়কে বললেন, “আরে দাদা এত অকল্পনীয়। তাহলে আমি দিনরাত এত মেকআপের পিছনে সময় নষ্ট করি কেন?” তারপরের দিন থেকে উত্তমকুমার দারুণ মেজাজে নায়ক ছবি শুটিং করলেন। এই ঘটনাটার কথা সত্যজিৎ রায় প্রায়ই অনেক জায়গায় বলেছেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

‘নায়ক’ ছবি তো সুপার ডুপার হিট হল। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৬ সালের ৬ মে শ্রী, প্রাচী ইন্দিরা প্রেক্ষাগৃহে। এ প্রযোজক হলন আর ডি বনশল। এই ছবিতে উত্তমকুমার ছাড়াও যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শর্মিলা ঠাকুর, সুমিতা সান্যাল, ভারতী দেবী, কামু মুখোপাধ্যায়, যোগেশ চট্টোপাধ্যায়, প্রেমাংশু বসু, নির্মল ঘোষ-সহ বহুশিল্পী। চিত্রগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত মিত্র এবং সম্পাদনের দায়িত্বে ছিলেন দুলাল দত্ত। শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত।

সত্যজিৎ উত্তম জুটির এই ছবি সকলের মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং উত্তম কুমারের অভিনয় জীবনের একটা বাঁক যেন তৈরি করে দিয়েছিল এই ‘নায়ক’ ছবিটি।—চলবে।
* পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content