ছবি বিশ্বাস।
১৯৬২ সালের ১১ জুন নিউ থিয়েটারর্স স্টুডিয়োর এক নম্বর ফ্লোরে শুটিং চলছে ‘বর্ণচোরা’ ছবির। আর দু’ নম্বর ফ্লোরে শুটিং চলছে ‘শেষ অঙ্ক’ ছবির। বর্ণচোরা-র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং সেখানে অভিনয় করছেন সন্ধা রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, গঙ্গাপদ বসু প্রমুখ শিল্পী। শেষ অঙ্ক ছবির পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। ওই ছবিতে অভিনয় করছিলেন উত্তম কুমার, বিকাশ রায়, কমল মিত্র, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ওই দিনটির কথা আমাদের জানিয়েছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। সেখানে তিনি বলছেন বর্ণচোরা হাসির ছবি। লাঞ্চের পর একটা মজার শট নিচ্ছি। সুলালদা (জহর গঙ্গোপাধ্যায়) এত সুন্দর গম্ভীরভাবে অভিনয় করছেন যে সেটে সবাই হেসে ফেলছে। তার জন্য এনজি হচ্ছে। সেই সময় স্টুডিয়ো ম্যানেজার কালো দাস এসে দাঁড়াল। যাক শটটা টেক হল। ও কে।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬০: অপরিচিত ছবিতে উত্তম-সৌমিত্রের মাঝে নজর কাড়েন অপর্ণা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন
কালো বলল, ঢুলু তুই কি প্যাকআপ করে দিবি। “ঢুলু (অর্থাৎ অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ডাক নাম) জানতে চাইলেন” কেন? “তখন কালো জানালেন” ছবিদা মারা গেছেন”। এই খবর শুনে জহর গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “কি বললি? কি হয়েছিল?” কালো জানালো” মোটর অ্যাক্সিডেন্ট।”
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৬:কোনও একটি দাবিতে বিরোধীরা জোট বাঁধুক কখনও চায় না শাসক
জহর গঙ্গোপাধ্যায় জোর করে গোঁফটা তুলে দিয়ে ফ্লোর থেকে বেরিয়ে গেলেন। গঙ্গাপদ বসু বললেন “বিশ্বাস হচ্ছে না”। সন্ধ্যা রায় দরাম করে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পরে বাইরে গিয়ে অরবিন্দ বাবু বেরিয়ে দেখেন শেষ অঙ্ক ছবির প্যাকআপ হয়ে গিয়েছে। ফ্লোরের বাইরে তখন উত্তমকুমার কমল মিত্র দাঁড়িয়ে রয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায় এডিট করছিলেন। তিনিও বেরিয়ে এসে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন। উত্তমকুমার অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়কে বললেন, “ঢুলুদা আর ব্যারিস্টারের ছেলের পার্ট করা যাবে না”।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৮: যেথা আমি যাই নাকো / তুমি প্রকাশিত থাকো
তখন সবাই মিলে তাঁরা চলে গেলেন আর জি কর হাসপাতালে। ছবি বিশ্বাসের রক্তাক্ত দেহ দেখে গঙ্গাপদ বসু বললেন, “আমার মাথা ঘুরছে”। তাঁকে ধরে নিয়ে বাইরের মাঠে এনে বসানো হল। বাইরে প্রচুর ভিড় জমেছে। পুলিশ ময়না তদন্ত না করে মৃতদেহ বেরোতে দেবে না। অপঘাতে মৃত্যুর এই নিয়ম। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বললেন, “ছবি বিশ্বাসের পোস্টমর্টেম হবে না”।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৮: নন্দিতা কৃপালনি— বিশ শতকের বিদুষী
ঠিকই ছবি বিশ্বাসকে জানতে গেলে ছুরি-কাঁচি দিয়ে কেটে পোস্টমর্টেম কখনোই করা যেতে পারে না। তিনি অনেক গভীরের। অনেক ঊর্ধের মানুষ ছিলেন। অকালে চলে গেলেন ঠিকই, বেঁচে থাকলে আরও কত স্মরণীয় ছবি তিনি আমাদের উপহার দিতে পারতেন।—চলবে।
*পর্দার আড়ালে (Behind the scenes) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।