শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওমৃণালদেবী।

সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে ঠাকুরবাড়ির চৌকাঠ পেরোনো খুব সহজ নয়। কারণ সেই সময় মেয়েদের লেখাপড়া, জীবনযাত্রা — সবকিছুর আদর্শ ছিলেন এই মেয়েরাই। সকলের যে বই প্রকাশিত হয়েছে তা নয়, কিন্তু নিজেদের রসবোধ, জীবনযাত্রা, পত্রলেখার মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের লেখক সত্তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমার আর কাজ কী! ঠাকুরবাড়ির চেনাশোনা গল্পগুলিকে ভাবনার কেন্দ্র থেকে আলোয় স্থাপন করি। কথার আল্পনা দিতে দিতে দেখি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি যেন আবার গমগম করে ওঠে। ইতিহাস অন্ধকারের তোরঙ্গ থেকে বাইরে এসে বসে পুরনো ঘ্রাণ নিয়েই। শহর কলকাতা বাবরি চুলে, সোনার চশমায় আবার নবীন হয়। ছন্দে ভুল হলে উদাস হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ! আজ বলি, রবীন্দ্রনাথ আর মৃণালিনীর দাম্পত্যের কথা, মৃনালিনীর লেখক সত্তার কথা!

রবীন্দ্রনাথ বিনয় করে যতই বলুন, ‘আমার বিয়ের কোন গল্প নেই’—আমরা বিশ্বাস করবো না। গল্প তো রয়েই যায়। অতীতের চৌকাঠ পেরোলেই জীবনের গল্প বুনতে থাকে কেউ। আবার ভবিষ্যৎ ইচ্ছে মতো গালগপ্পো তৈরি করে অতীত জীবনের সেপিয়া রঙের ছবিগুলোকে এমনি ধূসর করে দেয় যে আসল কাহিনি অধরাই থেকে যায়। ঠাকুরবাড়ির কাছের মানুষদের স্মৃতিচারণাকে সম্বল করে অল্পকথায় তৈরি করি, বিশ্বকবির দাম্পত্যের কথকতা।

রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিল ১২৯০ সালের ২৪ অঘ্রাণ। ঠাকুরবাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মামা ব্রজেন্দ্রনাথ রায়ের পিসিমা আদ্যাসুন্দরী। আশীর্বাদ ও পাকাদেখার সময় ঠাকুরবাড়ি থেকে নানা খেলনা, কাপড় জামা আর মিষ্টি গিয়েছিল। কনের জন্য কেনা হয়েছিল তিরিশটাকার বেনারসি জোড় ও সত্তরটাকার চেলি। পাত্রী যশোরের ফুলতলি গ্রামের এগারো বছরের লাজুক গ্রাম্যবালিকা। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বাইশ। বিয়ে করতে কোথাও রবীন্দ্রনাথ যাবেন না, ঠাকুরবাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে—এমনই শর্ত ছিল রবীন্দ্রনাথের। বাঙালি অবাঙালি অনেক মেয়ে দেখার পর দক্ষিণডিহির বেণীমাধব রায়চৌধুরীর শ্যামলা মেয়েটিকেই সকলের পছন্দ হল। মেয়ে দেখতে নাকি জোড়াসাঁকো থেকে বিরাট এক দল গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের আইবুড়ো ভাত হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের পিসিমার ঘরে। তারপর এল সেই প্রতীক্ষিত বিয়ের দিন। জমকালো কাশ্মিরী শাল গায়ে দিয়ে নিজের বাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে রবি ঠাকুর বিয়ে করতে এলেন অন্দরমহলে। পিঁড়ির উপর দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে, কালো জড়িদার বেনারসি পরে বরণ করে নিয়েছিলেন কাদম্বরী দেবীর এক আত্মীয়া, সবাই যাঁকে ডাকতেন ‘বড় গাঙ্গুলির স্ত্রী’ বলে। তারপর সাতপাক, মালাবদল, সম্প্রদানের পর বাসরঘরে স্ত্রী আচার শুরু হল যখন, রবীন্দ্রনাথ বেশ রসিকতা করেছিলেন। ভাঁড়ের খেলার সময় সব ভাঁড় উল্টে দিতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটকাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী বিস্ময় প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘জানো না কাকিমা, সব যে উলট পালট হয়ে যাচ্ছে— কাজে কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উলটে দিচ্ছি। ‘তারপরেই নিজের বাসরে নিজেই গান শুরু করলেন, ‘আ-মরি লাবণ্যময়ী / কে ও স্থির সৌদামিনী, / পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে / মার্জিত বদনখানি।’ নববধূর দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই গান গাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভবতারিণী সেই কাণ্ড দেখে লজ্জায় জড়োসড়ো। হেমলতা ঠাকুরের স্মৃতিচারণায় রবি ঠাকুরের বিয়ের এমন ছবিই আঁকা আছে।

তারপর শুরু হল কবির দাম্পত্যজীবন। বিশ্বকবির সংসার তো আর পাঁচজন মানুষের মতো সাধারণ হবে না। তাই রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর দাম্পত্য অবশ্যই বিশিষ্ট ছিল। কিন্তু সেই দাম্পত্যে সম্পর্কের মাধুর্য ছিল। নির্ভরতা আর সম্মানে বিনি সুতোর মালায় গাঁথা ছিল। টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজে এক সুন্দর ছবিই তো চোখে ভেসে ওঠে। সহধর্মিণী বলতে যা বোঝায়, মৃণালিনী দেবী ঠিক তাই ছিলেন। অমন প্রতিভাবান কবির পত্নী হওয়ার জন্য ঠিক যেমন ব্যক্তিত্বময়ী হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তেমনটাই ছিলেন তিনি। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘মৃণালিনী’। কথায় যশুরে টান থাকায় প্রথমদিকে কারো সঙ্গে কথাই বলতেন না মৃণালিনী দেবী। নীপময়ীদেবীর কাছে ঠাকুরবাড়ির আদবকায়দা, বাচনভঙ্গির ঘরোয়া তালিম পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬২: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— সুখদর্শন ও হুড়ো

লোরেটো হাউসে পড়তেও গিয়েছিলেন মৃণালিনী। জ্ঞানদানন্দিনীর তত্ত্বাবধানে চলছিলো মৃণালিনীর আধুনিকা হওয়ার শিক্ষা। লোরেটোর ইংরেজি, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে সংস্কৃত শিক্ষা, পিয়ানো, সঙ্গীত —সব চর্চাই করেছিলেন মৃণালিনী। কিন্তু নিজের সহজাত কোমল আটপৌরে ভঙ্গিটি একইরকম করে রেখে দিয়েছিলেন নিজের সঙ্গে। এইখানেই তাঁর বিশিষ্টতা। অথচ, বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃতে রীতিমতো দখল ছিল তাঁর। রূপকথা সংগ্রহের কাজ করেছিলেন তিনি। অবন ঠাকুর ক্ষীরের পুতুলের লৌকিক কাহিনি মৃণালিনী দেবীর কাছ থেকেই শুনেছিলেন। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পিতৃস্মৃতি’তে গল্পকথক মৃণালিনী দেবীর ছবি ধরা আছে। চিঠি লিখতেন খুব সুন্দর করে।

সুধীন্দ্রনাথের স্ত্রী চারুবালাকে লিখেছিলেন, ‘…তোমার সুন্দর মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আমাকে আর খবর দাওনি পাছে আমি খুব হিংসে করি, তার মাথায় খুব চুল হয়েছে শুনে পর্যন্ত ‘কুন্তলীন’ মাখতে আরম্ভ করেছি, তোমার মেয়ে মাথা ভরা চুল নিয়ে আমার ন্যাড়া মাথা দেখে হাসবে, সে আমার কিছুতেই সহ্য হবে না। সত্যিই বাপু, আমার বড় অভিমান হয়েছে, না হয় আমাদের একটি সুন্দরী নাতনী হয়েছে, তাই বলে কি আর আমাদের একেবারে ভুলে যেতে হয়।’

রামায়ণের অনুবাদের কাজও করেছিলেন মৃণালিনী। মহাভারত, মনুসংহিতার কিছু শ্লোকের অনুবাদও। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ওই অনুবাদের খাতাখানা খুঁজে পাওয়া যায় না। মৃণালিনীর অভিনয় দক্ষতাও ছিল প্রশংসনীয়। ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে নথ নেড়ে, ঝাঁটা ঘুরিয়ে তাঁর নারায়ণীর ভূমিকায় অভিনয় বেশ প্রশংসনীয় হয়েছিল। কিন্তু মৃণালিনী এইসব কাজে ততটা উৎসাহী ছিলেন না, যতটা উৎসাহী ছিলেন সাংসারিক দায়িত্ব বিষয়ে। মৃদু কোমল ব্যক্তিত্বে সকলের মন জয় করেছিলেন মৃণালিনী। সকলে তাঁর কথা শুনতেন, ভালোবাসতেন। সকলকে সাজাতেন, কিন্তু নিজে সাজতেন না। বলতেন, বড় বড় ভাশুর পো ভাগনেরা চারিদিকে ঘুরছে— আমি আবার সাজবো কী?
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৬: আহা শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী কারে রেখে কারে ফেলি

একবার সকলের অনুরোধে কানে দুটো ঝোলানো দুল, বীরবৌলি পরেছিলেন। কিন্তু সেইসময় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হওয়ায় দুই হাত চাপা দিয়ে বীরবৌলি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সাধারণ জীবনচর্যাই পছন্দ করতেন। হেমলতা ঠাকুরের স্মৃতিচারণায় বাসন্তী রঙের লাল পাড় শাড়িতে লাবণ্যময়ী মৃণালিনীর ছবি আঁকা আছে। রবীন্দ্রনাথ সেদিন মৃণালিনীর দিকে চেয়ে গান করেছিলেন—
‘হৃদয় কাননে ফুল ফোটাও
আধ নয়নে সখী চাও।’


ভবতারিণী ততদিনে রবি ঠাকুরের মনে স্বর্ণসিংহাসনটিতে এসে বসেছেন। চিঠির পাতায় গভীর আবেগে কবি তাঁকে লিখছেন, ‘ভাই ছুটি—’! অতীতের আঁধার থেকে যে কটি টুকরো সংলাপ আমরা খুঁজে পাই, সেখানে দাম্পত্যপ্রেমের কোনও ঘাটতি চোখে পড়ে না। রবিঠাকুরের খামখেয়ালি জীবন তখন আগলে রেখেছিলেন মৃণালিনী। অসাধারণ রান্না করতেন কবিপত্নী। মিষ্টি তৈরি করতে পারতেন অনেকরকম। মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের মিঠাই, চিঁড়ের পুলি যারা খেয়েছে, সকলেই মনে রেখেছে। কবির আজব ফরমাশে হিমসিম খেয়ে যেতেন মৃণালিনী।

খামখেয়ালি সভা বসবে বাড়িতে, রবি ঠাকুর ফরমাশ করলেন, প্রতিটি পদের বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, মামুলি কিছু করলে হবে না। মৃণালিনী তাই করলেন। কারণ ওই ফরমাশে পুরুষতন্ত্রের কর্তৃত্ব ছিল না। শিশুর মতো আবদার ছিল। মৃণালিনীকে রাগাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘দেখলে তোমাদের কাজ তোমাদেরই কেমন শিখিয়ে দিলুম।’ মৃণালিনী ছদ্মকোপে বলতেন, ‘তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? জিতেই তো আছ সকল বিষয়ে। ’ঠিক রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতার কবিপত্নী যেমন বলেছিলেন, ‘কথার কখনো ঘটে নি অভাব/ যখনই চেয়েছি, পেয়েছি জবাব/ একবার ওগো বাক্যনবাব চলো দেখি কথা শুনে।’
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭০: জন্মান্তরের সুরসাধক আরডি বর্মন

মৃণালিনীর সংসার মাঝে মাঝেই কবির খেয়ালে জায়গা বদল করতো। পাঁচ সন্তান নিয়ে জোড়াসাঁকো, শিলাইদহ, শান্তিনিকেতনে ঘুরে ঘুরে চলেছে কবি ও কবি পত্নীর ঘরকন্না। সন্তানদের দামী জামাকাপড় পরাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের সাধারণ জীবনচর্যার আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন মনে মনে। একবার শখ করে রবি ঠাকুরকে সোনার বোতাম গড়িয়ে দিয়েছিলেন। যথারীতি কবির পছন্দ হয়নি। তখন আবার বদলে দিয়েছিলেন উপহার। রবীন্দ্রনাথও স্ত্রীকে নিজের ছাঁচে বদলে নিতে চাননি কখনও। মৃণালিনীর সহজিয়া সৌন্দর্যকেই গ্রহণ করেছিলেন গভীর অনুরাগে। প্রতিমাদেবীর কাছে গল্প করতেন স্ত্রীকে রান্না শেখানোর কাহিনি। বৃদ্ধ বয়সে মৈত্রেয়ীদেবীকে বলেছিলেন, এমন কেউ নেই যাকে সবটা বলা যায়। রথীন্দ্রনাথের বিয়ের সময় নাকি প্ল্যানচেটে মৃণালিনীকে আহ্বান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীকে পছন্দ করতেন মৃণালিনী। হয়তো তাই রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও তাঁর পছন্দকেই গুরুত্ব দিলেন। ভালোবাসার শিকড় কতটা গভীর হলে স্ত্রীর স্মৃতি এই ভাবে বুকের কোটরে গোপনে বয়ে বেড়ানো যায়?

শিলাইদহে, জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদে বসতো গানের আসর, জাজিম পেতে আড্ডাও জমে উঠতো। মৃণালিনী আমপোড়ার শরবত, নানারকমের মিষ্টি বানিয়ে আনতেন। একবার এমন আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। রান্নাঘরে কুলুপ!গাছ থেকে আম পেড়ে সেই আমের অম্বল আর ভাত খাওয়া হয়েছিল পরম তৃপ্তিতে। রবীন্দ্রনাথের বোহেমিয়ান মন তখন একটু স্থির হয়েছিল মৃণালিনীর কল্যাণী স্পর্শে। রবি ঠাকুর বন্ধুদের বাড়িতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে আসতেন প্রায়ই। আর স্ত্রীকে তা বলতেও ভুলে যেতেন। মৃণালিনী সেইকারণে আগে থেকেই মিষ্টি তৈরি করে রাখতেন। কবি যখন লেখায় ডুবে যেতেন, তখন তাঁর কাছে চুপিসারে ফলের রস বা শরবত রেখে আসতেন মৃণালিনী ,যাতে লেখার ব্যাঘাত না ঘটে। শিলাইদহে স্ত্রীর ইচ্ছেতেই সম্ভবত ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে নিয়ম করে আসতো মন্দিরের শীতলী প্রসাদ।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

মৃণালিনীর পরের দুঃখেও প্রাণ কাঁদতো। নিজের বাড়ি থেকেও অনেকসময় খাবার পাঠাতেন কর্মচারীদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালিপনা অনেকসময় আর্থিক সমস্যা তৈরি করেছে সংসারে। দক্ষ হাতে সেসব সামলেছেন মৃণালিনী। ‘মাথার উপরে বাড়ি পড়ো পড়ো’ হলেও খেয়ালী কবির হুঁশ থাকবে না—এ বলাই বাহুল্য। শান্তিনিকেতন গৃহবিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে নিজের গয়না বিক্রি করে অর্থের জোগান দিয়েছিলেন মৃণালিনী। শান্তিনিকেতনের অতিথিশালায় থাকতেন মৃণালিনী। বারান্দার এককোণে উনুন পেতে রান্না করতেন সকলের জন্য। ছাত্রদের জন্য রান্নার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সন্ধ্যেবেলা ল্যাম্প জ্বেলে ইংরাজি নভেল পড়তেন। রবীন্দ্রনাথের সহধর্মিণী শুধু নয়, সহকর্মিণীও হয়ে উঠছিলেন মৃণালিনী।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো অভিশপ্ত গন্ধর্ব । তাঁর বুকের ভিতর কষ্টের পাখি যত যন্ত্রনায় ছটফট করবে, তত সৃষ্টি করবেন কবি। তাই বুঝি মৃণালিনীও চলে গেলেন চিরঘুমের দেশে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ লিখবেন—
‘তোমার সংসার মাঝে হায় তোমাহীন
এখনো আসিবে কত সুদিন দুর্দিন—
তখন এ শূন্য ঘরে চিরাভ্যাস-টানে
তোমারে খুঁজিতে এসে চাব কার পানে?’


মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে চলে গেলেন মৃনালিনী। দীর্ঘজীবন পেলে তাঁর কাজগুলি সমাপ্ত হত আর রবি ঠাকুরের সহকর্মিনী হয়ে উঠতে পারতেন।

মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুশয্যার পাশে নিরলসভাবে বসে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। সেবার কোনো ত্রুটি করেন নি। তখন ইলেকট্রিক ফ্যান ছিল না। হাতপাখা দিয়ে অক্লান্ত ভাবে বাতাস করেই যেতেন রবীন্দ্রনাথ। সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে অনেক অভিযোগ হয়তো উঠেছে, কিন্তু দাম্পত্য সঙ্গিনীর বিদায়ের মুহূর্তে রবিঠাকুরের এই নিরলস যত্নও তো মিথ্যা নয়। ১৯০২ সালের ২৩ শে নভেম্বর মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃত্যু হল মৃণালিনী দেবীর। কবি সেদিন সারারাত ছাদে পায়চারি করছেন। তারপর মস্ত বড়ো জীবনপথে একাই তো চলবেন। হয়তো কখনো কোনো নারী মাধুর্য মুগ্ধ করবে তাঁকে। কিন্তু জীবনের এই বিশেষ সম্পর্কটির অধিকার সর্বশেষের গানের মতো একজনের জন্যই রেখে দেবেন আজীবন।

একটি চিঠিতে মৃণালিনীকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জোর করে নিজের ইচ্ছেমতো স্ত্রীকে তিনি বদলাতে চান না। ‘আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশি কোনো চেষ্টা কোরো না— আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্ট।’ এই ভালোবাসাই দাম্পত্যের সম্মান। রবীন্দ্রনাথ আর মৃণালিনীর দাম্পত্য এই ভালোবাসায় গড়া ছিল। যা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সময়ের দূরত্ব, নিন্দুকদের আস্ফালন, ব্যবসায়িক স্বার্থ এই বন্ধনের ছিদ্রান্বেষণ করার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু রবিঠাকুরের দীর্ঘজীবনের উনিশটি বছরে মৃণালিনী যে বন্ধন তৈরি করেছিলেন, তার মর্যাদা একলা জীবনপথে চলতে চলতে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই রক্ষা করেছিলেন। মৃণালিনী কবির মনের স্মৃতির ক্যানভাসে পরম নির্ভরতার ছবি হয়ে জেগেছিলেন আজীবন! কোনও অতিরঞ্জিত কল্পনা তাকে ম্লান করতে পারবে না।

সহায়ক বই
ঠাকুরবাড়ির সাতকাহন, শান্তা শ্রীমানী
স্মৃতিকথা, সোমেন্দ্রনাথ বসু (সম্পাদক)
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content