শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

সিংহ-পিঙ্গলককে সঞ্জীবকের দুঃখে এই ভাবে প্রলাপ করতে দেখে দমনক তাঁর কাছে গিয়ে বলল, হে দেব! আপনার এই নীতি কাপুরুষের নীতি। ওই তৃণভোজী রাজদ্রোহী বৃষ-সঞ্জীবকটিকে মেরে এইভাবে শোকে বিষণ্ণ হয়ে যাওয়াটা আপনার উচিত হচ্ছে না। আপনার এই নীতি একজন রাজার জন্য মোটেও শোভনীয় নয়। রাজনীতিজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেন—

পিতা বা যদি বা ভ্রাতা পুত্রো ভার্যাঽথবা সুহৃৎ।
প্রাণদ্রোহং যদা গচ্ছেদ্ধন্তব্যো নাস্তি পাতকম্‌।। (মিত্রভেদ, ৪৫৭)
বাবা হোক বা ভাই, এমনকি ছেলে, বউ বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও কেউ যদি কখনও প্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে তাকে বিনা দ্বিধায় হত্যা করা উচিত। এ কাজ করলে কেউ পাতক হয় না। কোমল হৃদয়ের রাজা, কিংবা এমন ব্রাহ্মণ যে কোনটা তাঁর খাওয়া উচিত আর কোনটা খাওয়া উচিত নয়—এই সব ভোজ্যাভোজ্য সম্পর্কে চিন্তা না করেই যারা সবকিছু খায়, লজ্জাহীন স্ত্রী, দুষ্টবুদ্ধি সহায়ক, বিরুদ্ধ আচরণকারী সেবক, অলস-অধ্যক্ষ এবং যিনি উপকার মনে রাখেন না এমন অকৃতজ্ঞব্যক্তি। এদের সকলকেই সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করা উচিত। এই সঞ্জীবক আপনার এইরকমই একজন অকৃতজ্ঞ সহায়ক যে আপনার বিরুদ্ধাচরণ করেছে, আপনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। সুতরাং তাকে হত্যা করে আপনি বিন্দুমাত্র অন্যায় করেননি। বরং তাঁকে হত্যা করে আপশোষ করাটা আপনার ঠিক হচ্ছে না। এতে আপনি নিজেকে একজন দুর্বল ও কোমল হৃদয় রাজা বলে প্রমাণিত করছেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

নীতিজ্ঞরা বারে বারে এইরকম রাজাকে পরিত্যাগ করার কথা বলেছেন। মনের মধ্যে আপনার বেদনা বা পশ্চাত্তাপ থাকলেও সেটা সকলের কাছে প্রকাশ করাটা উচিত নয়। তাতে আপনার দুর্বলচিত্তের পরিচয় বাইরে সকলে জেনে যাবে। শত্রুরা সাহস পেয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে রাজাকে বেশ্যার মতো অভিনয় করতে হয়। কখনও তাকে অন্যের কাছে সত্য বলতে হয় আবার কখন মিথ্যাকেই সত্যের মতো বিশ্বাস যোগ্য করে অন্যের সামনে তুলে ধরতে হয়। কখনও আপনাকে যেমন হিংস্র হতে হবে আবার কখন দয়ালুও হতে হবে।

ভালো শাসক হতে গেলে কখনও কখনও স্বার্থপর হয়ে যেমন শুধু নিজের ভালোটাই দেখতে হয় আবার তেমনই সময় বিশেষে কখনও কখনও অন্যের কাছে বদান্যও হতে হয়। অনেক ধনসম্পদ যেমন সঞ্চয় করতে হবে তেমনই তিনি যে খুব দানবীর, প্রজাকল্যাণে বহুব্যয় করেন— এইটাও প্রমাণ করতে হবে। ফলে রাজাকে হতে হয় বেশ্যার মতো। বেশ্যার মনের গভীরে কি আছে সেটা যেমন তার নাগরেরা জানতে পারে না, তেমনই রাজার মনের মধ্যেও কি আছে সেটাও রাজার অন্যকে জানতে দেওয়া উচিত নয়। রাজাকে হতে হয় বেশ্যার মতো পাকা অভিনেতা, যাতে তার আসল চেহারাটা কেউ জানতে না পারে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

তাই এই ভাবে সঞ্জীবকের জন্য প্রকাশ্যে এই ভাবে বিলাপ করে মোটেও কোনও সুশাসকের পরিচয় দিচ্ছেন না আপনি। লোক যে কাকে সম্মান করে আর কাকে করে না সেটা বোঝা খুবই মুশকিল। বড় বড় মহাত্মা ব্যক্তি, যিনি প্রজাবর্গকে বিন্দুমাত্র উপদ্রব না করেই প্রজাগণের মঙ্গল করেছেন তাকেই দেখা গিয়েছে প্রজারা সম্মান করে না। যেমন নাগেদের হত্যা করে মানুষের উপকার করলেও গরুড়ের পূজা কিন্তু কেউ করেন না উল্টে বরং মানুষে নাগেদের পুজো করে। তাই লোকেরা যাতে আপনাকে কোনবাবেই অসম্মান করবার সুযোগ না পায় সেই খেয়ালটাও আপনাকেই রাখতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথাটা কি জানেন মহারাজ—
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূচগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ।। (ঐ, ৪৬১)


যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয় আপনি সেই নিয়েই শোক করছেন। অথচ পণ্ডিতের মতন কথা বলছেন। পণ্ডিতেরা কে জীবিত আর কে মৃত সেই নিয়ে শোক করে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

মিত্রভেদ নামক প্রথম তন্ত্রের শেষে শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই শ্লোকটির ব্যবহার এখানে ভারতীয় চিরন্তন দর্শনকে কি করে রাজনীতির প্রাঙ্গনে ব্যবহার করতে হয় তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জন্মান্তর কর্মফলবাদে বিশ্বাসী ভারতীয় বেদান্তদর্শনের মতে, আত্মা এক এবং অবিনশ্বর। তাঁকে কেউ মারতে পারেনা, শস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে পারে না — আত্মার মৃত্যু নেই। জীর্ণ বস্ত্রকে পরিত্যাগ করে যেমন মানুষ নতুন বস্ত্র পরিধান করে তেমনই জীর্ণ শরীরকে পরিত্যাগ করে আত্মা নতুন শরীরকে বেছে নেয়। সুতরাং মৃত্যুতে আত্মার শেষ নয় না, শরীরকে পিছনে ফেলে আত্মা নূতনের পথে এগিয়ে যায়।

কৃষ্ণসখা মধ্যমপাণ্ডব অর্জুন যখন যুদ্ধ করতে নেমে প্রতিপক্ষ কুরুসেনার মধ্যে পিতামহ ভীষ্ম, কুলগুরু কৃপাচার্য বা দ্রোণাচার্যকে দেখে মোহগ্রস্ত হয়ে বলেছিলেন—এদেরকে হত্যা করে আমি রাজ্যসুখ ভোগ করতে চাইনা তখন শ্রীভগবান্‌ এই কথাগুলি তাঁকে বলেছিলেন। ক্ষত্রিয় হিসেবে অর্জুনের কর্তব্য হল ধর্মরক্ষায় যুদ্ধ করা। তাই জয়-পরাজয়ের কথা চিন্তা না করে যুদ্ধ করাটাই তাঁর কর্তব্য। তাই যুদ্ধ করবো না করবো না বলে অর্জুনের এই যে মায়া এটা তাঁকে মানায় না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

আচার্য কৌটিল্যও বলেছেন লোকযাত্রাবিদ্‌রা ধর্মকে নিজস্বার্থ সিদ্ধির আবরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। দমনকও সিংহ-পিঙ্গলককে সেই ধর্মের আবরণটা দিয়েই বললে, আপনি পণ্ডিত মানুষ রাজন্! আপনার এইভাবে শোক করাটা উচিত নয়, বিশেষতঃ যে রাজদ্রোহ করেছে তার জন্য। রাজদ্রোহীকে হত্যা করাই ছিল আপনার ধর্ম কিন্তু তার জন্য এভাবে বিলাপ করাটা আপনার শোভনীয় হচ্ছে না মোটেই এতে আপনার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। মানুষ আপনাকে দুর্বল চিত্ত ভাববে আর দুর্বল চিত্ত রাজা যে রাজ্যশাসনের অনুপযোগী সেটা সকলেই জানে।
দমনক এইভাবে বোঝালে অবশেষে সিংহপিঙ্গলক সঞ্জীবকের শোক ভুলে দমনককে পুনরায় সচিবের পদে নিযুক্ত করে রাজ্যশাসন করতে লাগল।

এই ভাবে শ্রীবিষ্ণুশর্মা পঞ্চতন্ত্রের প্রথম তন্ত্র ‘মিত্রভেদ’ শেষ করলেন। পিঙ্গলক ও সঞ্জীবক ছিল দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কিন্তু কোনও তৃতীয় ব্যক্তি তাঁর নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সেইরকম দু’জন অভিন্নহৃদয় বন্ধুর মধ্যে কিভাবে ভেদ তৈরি করতে পারে সেইটাই এই মিত্রভেদ নামক প্রথম তন্ত্রের বিষয়। আসলে জগতে যে দমনকের মতো স্বার্থান্বেষী মানুষেরাও আছে এবং তারা যে এইভাবেই দু’জন বন্ধুর মধ্যে ভেদ তৈরী করার চেষ্টা করে এই শিক্ষাও একটা ভবিষ্যৎ রাজার হওয়া দরকার। এই মানুষগুলোকে চিনে নেওয়ার জন্যেও পঞ্চতন্ত্রের মতন গ্রন্থ আমাদেরকে পড়তে হবে।—চলবে।
 

‘মিত্রভেদ’ নামক প্রথমতন্ত্র সমাপ্ত।

* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content