রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


(বাঁদিকে) ঝুম্পা লাহিড়ী। (ডান দিকে) ছবির একটি দৃশ্যে তব্বু ও ইরফান খান।

 

দ্য নেমসেক

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: সাহিত্যধর্মী অন্যধারার ছবি (২০০৬)
ভাষা: ইংরিজি
কাহিনি: ঝুম্পা লাহিড়ী
চিত্রনাট্য: সুনি তারাপরেওয়ালা
পরিচালনা: মীরা নায়ার
অভিনয়: ইরফান খান, তব্বু, কল পেন, রুমা গুহ ঠাকুরতা, তমাল রায়চৌধুরী, তনুশ্রীশঙ্কর, সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং সুপ্রিয়া দেবী প্রমুখ
ওটিটি: ডিজনি প্লাস
রেটিং: ৮.৫/১০

২০০৩ সালে ‘দ্য নেমসেক’ বইটি প্রকাশিত হয়। তিন বছর পর ২০০৬ সালে মীরা নায়ার এই উপন্যাস অবলম্বনে একই নামের চলচ্চিত্র তৈরি করলেন। নেমসেক মানে নামের মিল। যে মিল রয়েছে উপন্যাসে এবং অবশ্যই ছবিতে। সারা বিশ্বের উচ্চপ্রশংসিত এই ছবি কলকাতার ভাতে মাছে বাঙালি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট অশোক গঙ্গোপাধ্যায় ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী অসীমা গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বদেশ ছেড়ে আমেরিকার মাটিতে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার গল্প। উত্তর পূর্ব আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের ম্যাসাচুসেটস। সেখানে কেমব্রিজ সেন্ট্রাল স্কোয়ারে বসবাস।

অশোক ও অসীমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলের ভালো নাম রাখা হল নিখিল, আর ডাকনাম গোগোল। সোভিয়েত লেখক নিকোলাই গোগোলের নামে অশোক ছেলের নাম রেখেছিলেন। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। অশোক তখনও আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ পায়নি। ট্রেন যাত্রার সময় ভয়ংকর প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় পড়েছিল অশোক দুর্ঘটনার ঠিক আগে তার হাতে ছিল নিকোলাই গোগোলের উপন্যাস দ্য ওভারকোট। এই বইটি দেখেই গুরুতর আহত অবস্থায় অশোককে উদ্ধার করা গিয়েছিল। ছেলে যখন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ে তখন তার নিখিল নামে ঘোরতর আপত্তি ছিল। নাম বদলে গোগোল করা হল। কিন্তু কলেজে এসে আমেরিকান বন্ধুবান্ধবীরা গোগোল নাম নিয়ে তাকে ঠাট্টা করত।সে আবার বায়না ধরল নাম বদলের আবার নাম হল নিখিল বন্ধুবান্ধবীদের মুখে নিখিল থেকে নিক।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: বিক্রমের উপন্যাসে মীরার সিরিজ ‘আ স্যুটেবল বয়’—মন্দ নয়, সে পাত্র ভালো

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

নীলাঞ্জনা বা সুদেষ্ণা লাহিড়ী। ডাকনাম ঝুম্পা। জন্ম লন্ডনে। তিন বছর বয়সে লন্ডন থেকে বাবা-মার সঙ্গে আমেরিকায়। রোহড আইল্যান্ড কিংস্টনে বেড়ে ওঠা। বাবা অমর লাহিড়ী কলকাতার বসবাস ছেড়ে বিদেশে প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী। কিংস্টনের ইউনিভার্সিটি অফ রোহড আইল্যান্ডের লাইব্রেরিয়ান। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ার সময় আমেরিকান শিক্ষক-শিক্ষিকারা উচ্চারণের সুবিধের জন্য নীলাঞ্জনা বা সুদেষ্ণা থেকে ঝুম্পা বলে ডাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তাই সারা বিশ্ব আজ তাঁকে ঝুম্পা নামেই চেনে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

বিদেশে থাকলেও ঝুম্পার মা চেয়েছিলেন সন্তান যেন বাঙালি শিক্ষাদীক্ষা ঐতিহ্যের মূলধারার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখে। তাই কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল। নেমসেক উপন্যাসে অশোক এবং অসীমা প্রথম প্রজন্মের প্রবাসী। মার্কিন প্রবাসে থেকেও দু’জনের মধ্যেই বাঙালিয়ানার মূলধারা স্পষ্ট। নেমসেক ছবিতে সনাতন ভারতীয় ও আধুনিক মার্কিন জীবনযাত্রার দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এমনকি ঝুম্পার এক কাকা এক রেল দুর্ঘটনায় পড়ে তাঁর হাতঘড়ির ঝকঝকে ধাতব প্লেটের ওপর সূর্যের আলোর প্রতিফলনের জন্য উদ্ধারকারী দলের নজরে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

জীবনের এইসব অভিজ্ঞতা ঝুম্পা তাঁর নেমসেক উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতায় জানিয়েছেন যে তাঁর প্রথমদিকের লেখা ছোটগল্প বছরের পর বছর প্রকাশকেরা ক্রমাগত বাতিল করেছেন। ১৯৯৯ সালে ৩২ বছর বয়সে তার প্রথম ছোট গল্পের সংকলন বের হল। ‘ইন্টারপ্রেটার অফ ম্যালাডিস’ (ডাক্তারখানার দোভাষী) নামের ১৯৮ পাতার এই ছোট গল্প সংকলনে নটি গল্প রয়েছে। এই সংকলন পুলিৎজার পুরস্কার এবং পেন বা হেমিঙওয়ে পুরস্কার ভূষিত হয়েছে। এ পর্যন্ত এই বইটি দেড় কোটি কপি বিক্রি হয়েছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

অসাধারণ অভিনয় করেছেন অশোক ও অসীমার ভূমিকায় ইরফান খান এবং তব্বু। গোগোল বা নিখিলের ভূমিকায় আমেরিকান অভিনেতা কল পেন যথাযথ। গুজরাতি এই অভিনেতার প্রকৃত নাম কল্পেন সুরেশ মোদী। এই ছবিতে মীরা নায়ার অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দের সঙ্গে বাঙালিয়ানাকে ফুটিয়ে তুলেছেন আর সেই কাজে তাকে সাহায্য করেছেন অত্যন্ত গুণী একরাশ বাঙালি অভিনেতা অভিনেত্রীরা। অশোকের মা এবং বাবার ভূমিকায় রুমা গুহ ঠাকুরতা ও তমাল রায় চৌধুরী এবং অসীমার মা-বাবা ও ঠাকুমার ভূমিকায় যথাক্রমে তনুশ্রীশঙ্কর সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং সুপ্রিয়া দেবী এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

সংস্কৃতির বৈপরীত্য এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। নীতিন সাহানি কৃত আবহে রবিশঙ্করের সুরারোপিত পথের পাঁচালীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ছবিতে রয়েছে ইরফান খান ও তব্বু অভিনীত কিছু অসাধারণ সিনেমাটিক মুহূর্ত যা হয়তো আপনাকে ছবিটি বারবার দেখার জন্য আকর্ষণ করবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content