বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

কনরাডের জীবনীকার বাইনস তাঁর বিয়ের প্রসঙ্গ লিখতে গিয়ে একটু থমকে গিয়েছেন। কনরাড কেন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং তা আবার জেসি কনরাডের মতো মেয়েকে এটার কারণ তার মাথায় আসছিল না। আসলে এই বিয়েটি যে সামাজিক ও বাস্তবিক লাভজনক একটি বিয়ে এটি জীবনী কারের মানতে অসুবিধে হচ্ছিল।

একজন পোল্যান্ডের নাবিক ও খ্যাতনামা লেখকের সঙ্গে মফস্বলের এক সাধারণ টাইপিস্টের বিয়ে। বৌদ্ধিক সঙ্গী না হয়েও একে অপরের পরিপূরক হয়েছেন অন্যরকম ভাবে। বন্ধুজন সবাই বলেছেন জেসি এক চমৎকার গৃহকর্ত্রী। জেসি নিজেও স্মৃতিচারণে এর সমর্থন করেছেন। কনরাডের স্বল্প আয়ে ও বাউন্ডুলে জীবনের জন্য জেসির মতো সাধারণ একজন মেয়েই উপযুক্ত স্ত্রী।

বিয়ের আগে কুড়ি বছর নাবিকের যাযাবর জীবন যাপন করে কনরাড এবং জেসিকে বিয়ে করে এক নিশ্চিত বন্দরে নোঙর ফেললেন। তাঁর নতুন উপন্যাসের জগতে নিশ্চিন্তে নিমগ্ন হলেন। জেসি তাঁকে ঘিরে এক সুরক্ষা বলয় করলেন, যত্নে, ভালোবাসায় গড়লেন এক সুখী গৃহকোণ।

কনরাডের বাবা ছিলেন পোলিশ দেশপ্রেমী। রাশিয়ানরা তাঁকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠায়। সেখানকার চরম ঠান্ডায় কনরাডের মা অসুস্থ হয়ে পরেন এবং মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। পাঁচ বছর নির্বাসনে থাকার পর কনরাড এবং তাঁর বাবা পোল্যান্ডে ফেরেন। বাবা, শোকে দুঃখে, অসুস্থতায় তার পরের বছর মারা যান। মাত্র এগারো বছর বয়সে কনরাড অনাথ হলেন। মামা থেদ্দুসে অভিভাবকত্বে এলেন।

১৮৭৪ থেকে ১৮৯৪, এ কুড়ি বছর কনরাড নাবিক হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। একাকীত্বে ভুগেছেন। শারীরিক এবং মানসিক অবসাদ, নার্ভাসনেস, অন্যমনস্কতা, খামখেয়ালিপনা, এ সবরকম মানসিক অসুস্থতাই তার ছিল। একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছেন। বিয়ের দু’মাস পর কনরাড তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছেন, তার দীর্ঘ সময় ধরে মাঝে মাঝেই অবসাদের ফিট চলত। সাধারণ মানুষ তাঁকে এই অবস্থায় পাগল ছাড়া কিছুই বলবে না। “কেন এমন হতো জানি না। কোনও কারণ ছাড়াই হতো। কোনও কোনও সময় সারাদিন ধরে চলতো। এক ভয়ানক অস্থিরতা। তারপর সেটা ছেড়ে মনে এক প্রচণ্ড ভয় এর উদ্রেক হতো।”

জেসি কিন্তু এমন মানসিক অবস্থাকে সস্নেহ প্রশ্রয়ে দেখেছেন। তাঁর মতে, খুব অল্প মানুষই কনরাডকে বুঝতে পারবে। একদিকে অতি সংবেদনশীল, অন্যদিকে গভীর চিন্তাশীল এক ব্যক্তিত্ব। কনরাডের সুন্দর মনের তল পাওয়া যার তার কাজ নয়। তবে? জেসির মতো মেয়ে ছাড়া কে কনরাডের যোগ্য সহধর্মিনী হবে?

জেসি এক পিতৃহীন নিঃস্ব পরিবারের নয় ভাইবোনের দ্বিতীয়। কনরাডের সঙ্গে প্রথম দেখা এক বন্ধুর বাড়িতে। বয়েসে কনরাডের চেয়ে ১৬ বছরের ছোট। পরে এক বন্ধুকে বলেছেন, তাঁর খুব ভালো লেগেছিল যখন কনরাড তাঁর প্রতি আগ্রহ দেখান। এই প্রথম একজন বড় মানুষ তাঁকে গুরুত্ব দিল। তারপর একবছর ধরে প্রেম চলল।

১৮৯৬ সালে কনরাড দরিদ্র ও স্বল্পশিক্ষিত জেসিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। প্রস্তাবটিও অদ্ভুত। তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না, তাই ছেলেমেয়ে ইত্যাদি নিয়ে প্রথাগত সংসার করা ঠিক হবে না। কিন্তু মরার আগে কয়েকটা বছর জেসির সঙ্গে সুখে কাটাতে চান। তাই বিয়ের প্রস্তাব। প্রস্তাব দেওয়ার পরদিন থেকেই কনরাড নিখোঁজ। জেসি তো প্রচণ্ড লজ্জায় পড়লেন সকলের কাছে।

তিনদিন বাদে কনরাড ফিরে এসে বললেন, একমাসের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপরই জেসিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। জেসির মায়ের জেসি ছাড়াও আরও আটজন ছেলেমেয়ে। তাই চিন্তার কোনও অবকাশ নেই। কন্যাদায়মুক্ত হওয়ার সুযোগে ঝাঁপিয়ে পরলেন। শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললেন, এমন বিয়ে করা কেন?—চলবে।