মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


‘আ স্যুটেবল বয়’ ছবির একটি দৃশ্য।

 

আ স্যুটেবল বয়

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: সাহিত্যধর্মী পিরিয়ড সিরিজ (২০২০)
ভাষা: হিন্দি/ ইংরিজি
কাহিনি: বিক্রম শেঠ
চিত্রনাট্য: অ্যান্ড্রু ডেভিস
পরিচালনা: মীরা নায়ার
অভিনয়: তব্বু, ইশান খট্টর, তানিয়া মানিকতলা, রসিকা দুগগল, মাহিরা কক্কর, রাম কাপুর, বরুণ চন্দ, বিজয় বর্মা, রণবীর শোরে প্রমুখ
ওটিটি: নেটফ্লিক্স
পর্ব: ৬
রেটিং: ৭/১০

১৯৫০-৫২ সালের ভারতীয় পটভূমিকায় লেখা বিক্রম শেঠের উপন্যাস ‘আ স্যুটেবল বয়’ ১৯৯৩ সালে প্রকাশ পেয়েছিল। সাড়ে ১৩০০ পৃষ্ঠার এই ইংরেজি ভাষায় লেখা বইটি এক খণ্ডে প্রকাশিত লম্বা ইংরিজি উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম। দেশভাগ ও স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের কয়েকটি উচ্চবিত্ত পরিবারের দিনলিপি জীবনযাত্রা ও কাহিনির মূলচরিত্রদের মানসিক বিশ্লেষণ ও পারিপার্শিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিত এই জনপ্রিয় উপন্যাসটির উপজীব্য।
কাহিনি শুরু হয় কাল্পনিক শহর ব্রহ্মপুরে। এর পাশে অবস্থিত গঙ্গা, পাটনা, ব্রহ্মপুর, কলকাতা, দিল্লি, লখনউ এবং অন্যান্য ভারতীয় শহরে কাহিনি আবর্তিত হতে থাকে।

১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই উপন্যাসে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাগুলির শ্লেষ্মাত্মক উপস্থাপনা করা হয়েছে। এই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত মীরা নায়ার-কৃত ছয়পর্বের ওয়েব সিরিজ ‘আ স্যুটেবল বয়’ পর্যায়ক্রমে ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের জাতীয় নির্বাচন, হিন্দু-মুসলিম জাতিবিরোধ, নিম্ন বর্ণের মানুষের মর্যাদা দাবি, ভূমি সংস্কার তদানীন্তন শিক্ষাব্যবস্থা, জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি, বদলে যাওয়া পারিবারিক পরিস্থিতি ও মানবিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রায়ণ হয়ে উঠেছে।

১৯৫০ সাল। ১৯ বছর বয়সী লতা মেহরার দিদি, সবিতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার প্রাণ কাপুরের বিয়ে। লতার মা, মিসেস রূপা মেহরা ছোটমেয়ে লতার বিয়ে নিয়েও সমান চিন্তিত। লতা এখনই বিয়েতে রাজি নয়। সে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে চায়। তবুও, লতার মা তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রায় সকলের কাছেই লতার জন্য সৎপাত্রের খোঁজ করতে থাকেন।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: ঐতিহাসিক পটভূমির ‘মহারাজ’ ছবিতে আমিরপুত্র জুনেদ নজর কাড়বে

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৪: যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না?

ব্রহ্মপুর বিশবিদ্যালয়ে পড়ার সময় লতার সঙ্গে সমবয়সী ছাত্র কবীরের পরিচয় হয়। দু’জনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং কিছুদিন বাদেই লতা অনুভব করে যে সে ভালো করে জানাচেনার আগেই নিজের অজান্তে কবীরের প্রেমে পড়েছে। কিছুদিন বাদে বান্ধবী মালতীর কাছ থেকে কবীর সম্বন্ধে লতা বিস্তারিত জানতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। কবীরের পুরো নাম কবীর দুরানি, মুসলমান। লতা জানে সে গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে, কোনও অবস্থাতেই তার মা মুসলমান ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের অনুমতি দেবেন না। কিন্তু লতার মা রুপা মেহেরা অচিরেই কবীর ও লতার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে কলকাতায় বড় ছেলে অরুণের কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫২: হিতকারী মূর্খ বন্ধুর থেকে একজন পণ্ডিত শত্রু থাকা ভালো

এদিকে লতা লুকিয়ে কবীরের সঙ্গে দেখা করে। তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু কবীর লতাকে বোঝায় যে, এরকম কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া লতার পক্ষে ভুল হবে। এ ভাবেই লতা এবং তার জীবনে আসা নানান সম্ভাব্য সুপাত্রদের নিয়ে গল্প গড়িয়েছে এক আকর্ষণীয় ছন্দে। গল্পের পটভূমি কখনও তদানীন্তন কলকাতা কখনও বা দিল্লি।

মূল কাহিনি সঙ্গে সেই সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে এসেছে মান কাপুরের গল্প, সে লতার জামাইবাবু প্রাণ কাপুরের ভাই। শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ, রাজস্ব প্রতিমন্ত্রী মহেশ কাপুরের ছোট ছেলে মান কাপুর পার্থিব চাওয়া পাওয়ার বাইরে একটি রোম্যান্টিক বোহেমিয়ান ছেলে সে উর্দু কবিতার ভক্ত, ভারতীয় মার্গ সংগীতের অনুরক্ত। হোলি উপলক্ষে ঘরোয়া গানের অনুষ্ঠানে মান কাপুর গান শুনে বয়সে বড় সাঈদা বাঈয়ের অনুরক্ত হয়ে পড়ে। শহরে সাঈদা বাঈকে সকলেই চেনে জানে সে এক অতি পরিচিত বাঈজি। শহরের অনেক বড় মানুষজন তার কোঠিতে যাতায়াত করেন। সাঈদার প্রেমে অন্ধ মান কাপুর সেখানে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৭: ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও?

কোনও প্রতিবেদনেই আমি কাহিনি উল্লেখ করার পক্ষপাতি নই। কিন্তু যেহেতু স্যুটেবল বয় একটি ভিন্নধারার ওয়েব সিরিজ, তাই আর পাঁচটা সচরাচর ওয়েব সিরিজের মতো সহজ বিনোদনের আকর্ষণ নেই এ সিরিজে। অভ্যস্ত ওয়েব সিরিজের ফর্মুলা মেনে বানানো নয়। তাই সামান্যভাবে কাহিনির উল্লেখ করলাম।

এই উপন্যাসকে বিবিসি নিউজ তাদের ১০০টি সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক উপন্যাসের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। টাইমস পত্রিকায় ড্যানিয়েল জনসন লিখেছেন এটি কেবল ইংরেজির দীর্ঘতম উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি নয়, এটি গত শতাব্দীর শেষার্ধের সবচেয়ে অসাধারণ এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি। জনসন বলেছেন বিক্রম শেঠ ইতিমধ্যেই তার প্রজন্মের সেরা লেখক হিসেবে প্রমাণিত। অন্যদিকে ইউজিন রবিনসন ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা সোভিয়েত সাহিত্যিক, আনা কারেনিনা ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর মতো কালজয়ী রচনার স্রষ্টা লিও টলস্টয়ের সঙ্গে বিক্রম শেঠের তুলনা টেনেছেন। অবশ্যই সেটি রবিনসনের নিজস্ব মতামত। বইটি ২০১৪ সালের তালিকায় টেলিগ্রাফ ১০টি সর্বকালের সেরা এশিয়ান উপন্যাসের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল এই উপন্যাস।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৩: মিলাডা—বিদেশিনীর হরফ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

সালাম বোম্বে, মিসিসিপি মশালা, মনসুন ওয়েডিং, দ্য নেমসেক-এর মতো যুগান্তকারী ছবির পরিচালিকা মীরা নায়ার পরিচালিত এই ছয় পর্বের ওয়েব সিরিজের চিত্রনাট্য রচয়িতা অ্যান্ড্রু ডেভিস। সিরিজের নানা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন অনেক গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী। এর মধ্যে সাঈদা বাঈ চরিত্রে তব্বু, মান কাপুর-এর ভূমিকায় ইশান খট্টর, মিসেস রূপা মেহেরার চরিত্রে মাহিরা কক্কর, মহেশ কাপুর চরিত্রে রাম কাপুর, জাস্টিস চ্যাটার্জির ভূমিকায় বরুণ চন্দ, দুই বোন লতা এবং সবিতার ভূমিকায় যথাক্রমে তানিয়া মানিকতলা এবং রসিকা দুগগল-এর অভিনয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

তবে কাহিনীতে নায়িকার কলকাতা যোগ থাকলেও চরিত্রাভিনেত্রী তানিয়ার কোনও পূর্বপুরুষ মানিকতলায় থাকতেন কিনা সেটা জানা নেই। এই সিরিজ সম্প্রচারিত হয়েছিল বিবিসি ওয়ান চ্যানেলে। এখন দেখা যাবে নেটফ্লিক্সে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content