বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণ, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের কাছে, মহর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে রাজা বিশ্বামিত্রের দ্বৈরথ বর্ণনা করলেন। দুই মহর্ষির বিরোধের অবসান হল না। তপঃশক্তিতে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের সমকক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে, রাজা বিশ্বামিত্র রাজ্যসুখ ত্যাগ করে কঠোর তপশ্চর্যার মাধ্যমে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করেছিলেন। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে তাঁর সংঘাত শেষ হল না।

দুই ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের দ্বৈরথের সূচনা হল আবারও। এর মূলে ছিলেন ইক্ষ্বাকুবংশের শৌর্যশালী রাজা কল্মাষপাদ। ইহলোকে অতুলনীয় তেজস্বী ছিলেন সেই রাজা। মহর্ষি বিশ্বামিত্র, ইক্ষ্বাকুবংশীয় শৌর্যশালী রাজা কল্মাষপাদ রাজার হয়ে যজ্ঞ করতে ইচ্ছুক হলেন। অর্থাৎ মহর্ষি বিশ্বামিত্র কল্মাষপাদ রাজাকে যজমানরূপে কামনা করলেন। একদা রাজা কল্মাষপাদ মৃগয়ার্থে অরণ্যে গেলেন। গহনারণ্যে বহু হরিণ,বরাহ,খড়্গবিশিষ্ট গণ্ডার বধ করে ক্লান্ত, পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত রাজা একটি সংকীর্ণ পথে ফিরছিলেন। সে পথে শুধু একজন যেতে পারে। মহর্ষি বশিষ্ঠের শতপুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শক্ত্রি, সেই পথ দিয়েই রাজার অভিমুখে আসছিলেন। রাজা কল্মাষপদ ছিলেন যুদ্ধে অপরাজিত।

রাজার অহংবোধে হয়তো আঘাত লাগল। তিনি মুনিপুত্রকে ঔদ্ধত্যসহকারে বললেন, অপগচ্ছ পথোঽস্মাকমিত্যেবং পার্থিবোঽব্রবীৎ। আমাদের পথ থেকে সরে যান আপনি। মুনিপুত্র শক্ত্রি একজন ঋষি। তিনি ঋষিসুলভ শান্ত, সমাহিত, কোমলস্বরে প্রত্যুত্তর দিলেন, এটি তাঁর পথ। কারণ সনাতন লোকাচার হল—রাজা সর্বদাই ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেবেন। রাজা কল্মাষপদ ও ঋষি শক্ত্রি কেউ পরস্পরকে পথ ছেড়ে দিলেন না।ঋষি তাঁর মর্যাদাবোধ বিসর্জন দিয়ে ধর্মপথে নিজের অবস্থান থেকে একপাও সরলেন না। রাজাও তাঁর আত্মসম্মানবোধে অনড়। তিনি মুনির সম্মানার্থে পথ ছাড়লেন না।
শক্ত্রিমুনির এই অনমনীয় মনোভাব দেখে রাজা কল্মাষপাদ তাঁকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলেন। ক্রোধে আত্মহারা হয়ে, প্রায় সংজ্ঞাহীন ঋষি শক্ত্রি, রাজাকে অভিশাপ দিলেন, হংসি রাক্ষসবদ্ যস্মাদ্রাজাপসদ! তাপসম্। তস্মাত্ত্বমদ্য প্রভৃতি পুরুষাদো ভবিষ্যতি।। আপনি রাক্ষসতুল্য বিবেকহীন, একজন তপস্বীকে আঘাত করলেন আপনি, এই কারণে আজ থেকে আপনি নরমাংসভুক রাক্ষসে পরিণত হবেন। শুধু তাই নয়, নরমাংসে আসক্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়াবেন এই নরাধম রাজা।

মহর্ষি বশিষ্ঠেরও প্রার্থিত যজমান, রাজা কল্মাষপাদ। সেই থেকে মহর্ষিদ্বয়ের শত্রুতার সূচনা। তক্কে তক্কে ছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র। যে কোনও উপায়ে কল্মাষপাদরাজাকে যজমানরূপে প্রাপ্তি,তাঁর লক্ষ্য। কঠোর তপস্বী ও শৌর্যশালী ঋষি বিশ্বামিত্র উপলব্ধি করলেন বিবাদমান রাজা কল্মাষপদ ও ঋষি শক্ত্রি, এই দুজনের মধ্যে, শক্ত্রিমুনির তেজস্বিতা পিতা বশিষ্ঠের থেকে কোনও অংশে কম নয়। অভিশপ্ত রাজা কল্মাষপাদ, ঋষি শক্ত্রির পাদুটি ধরে তাঁকে তুষ্ট করতে চাইলেন, তিনি ঋষির শরণ নিলেন। রাজার মানসিকতা বুঝলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র। একে ঋষি শক্ত্রির অভিশাপের প্রভাবতো আছেই তার ওপরে মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আদেশে কিন্নর নামে এক রাক্ষস কল্মাষপাদ রাজার দেহে প্রবেশ করল। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার পরে বিশ্বামিত্র প্রস্থান করলেন।

রাজার শরীরস্থ রাক্ষসের দ্বারা প্রভাবিত রাজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন, কী করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। সেই সময়ে ক্ষুধার্ত এক ব্রাহ্মণ রাজাকে বনে দেখতে পেয়ে, তাঁর কাছে ভোজ্যদ্রব্যের মধ্যে মাংস খেতে চাইলেন। রাজা কল্মাষপাদ কথা দিলেন ব্রাহ্মণের ইচ্ছা পূরণ করবেন, শুধু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। রাজা যথেচ্ছ ঘুরে বেড়িয়ে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে বেমালুম ভুলে গেলেন। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে মনে পরল প্রতিশ্রুতির কথা।পাচককে আদেশ দিলেন, সত্বর মাংসমিশ্রিত অন্ন প্রস্তুত করে অপেক্ষমান ব্রাহ্মণকে তুষ্ট করা হোক। রাত গভীর। পাচক জানাল, কোথাও মাংস পাওয়া গেল না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?

মুভি রিভিউ: মহারাজা—নিথিলন, বিজয় ও অনুরাগ একযোগে থাপ্পড় মেরেছেন উগ্র পৌরুষের গালে

রাজা একটুও অনুতপ্ত হলেন না। রাজার ভেতরের রাক্ষসসত্তা বার বার পাচককে নির্দেশ দিল, অপ্যেনং নরমাংসেন ভোজয়েতি পুনঃ পুনঃ। তাহলে ওনাকে নরমাংস ভোজন করাও। রাজাদেশে, নির্ভীক পাচক বধ্যভূমি থেকে তাড়াতাড়ি নরমাংস সংগ্রহ করে উত্তমভাবে রান্না করে মাংসমিশ্রিত অন্ন নিয়ে উপস্থিত হল সেই ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণের কাছে। ব্রাহ্মণ তাঁর অনন্যদৃষ্টিবলে সেই অন্ন দেখে ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে বললেন, অখাদ্য এ অন্ন। অভোজ্যমিদমিতি। অভোজ্য অন্ন পরিবেশনকারী নরাধম রাজা নিশ্চয়ই নরমাংসলোলুপ। অতীতে শক্ত্রিমুনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তেমনই নরমাংসে আসক্ত হয়ে, এই রাজা, মানুষের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, পৃথিবীতে বিচরণ করবেন। দুই ব্রাহ্মণের অভিশাপ এক। তাই সেই অভিশাপের শক্তি বৃদ্ধি হল। অভ্যন্তরের রাক্ষসবলে আবিষ্ট রাজার বিকৃত মানসিকতা প্রকাশ পেল। রক্ষোবলসমাবিষ্ট বিসংজ্ঞশ্চাভবন্নৃপঃ।রাক্ষসের প্রভাবে বিকৃতচৈতন্য রাজা, ঋষি শক্ত্রির সম্মুখীন হলেন। তার সিদ্ধান্ত জানালেন,যেহেতু আপনার অসঙ্গত অভিশাপের শিকার আমি,তাই আপনার থেকেই নরমাংস ভক্ষণ শুরু করা যাক্। যস্মাদসদৃশঃ শাপঃ প্রযুক্তোঽয়ং ময়ি ত্বয়া। তস্মাত্ত্বত্তঃ প্রবর্ত্তিষ্যে খাদিতুং মানুষানহম্।। এই বলে, বাঘ যেমন অভীষ্ট পশুকে ভক্ষণ করে তেমনভাবে রাজা কল্মাষপাদ, ঋষি শক্ত্রিকে ভক্ষণ করে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

মহর্ষি বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে মৃত দেখে, মহর্ষি বিশ্বামিত্র, বার বার রাজার ভিতরের রাক্ষসকে, অবশিষ্ঠ বশিষ্ঠপুত্রদের ভক্ষণের আদেশ দিলেন। সিংহবিক্রমে রাজা ক্ষুদ্র পশুসম শক্ত্রির কনিষ্ঠ সব ভাইদের খেয়ে ফেললেন। বিশ্বামিত্রের পরিকল্পিত এই নৃশংস পুত্রহত্যার বৃত্তান্ত জেনেও, মহান পর্বত যেমন অবিচলিত থেকে ভূমি ধারণ করে তেমনই সেই দুর্বহ শোকের ভার বহন করলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ। তিনি মুনিশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম জ্ঞানী। বিশ্বামিত্রকে উচ্ছদের কথা তাঁর মনে এল না। আত্মবিসর্জনের ইচ্ছা জাগল তাঁর মনে। মহর্ষি বশিষ্ঠ সুমেরু পর্বতশৃঙ্গ থেকে নিজেকে শূন্যে নিক্ষেপ করলেন, কিন্তু শরীর যেন তুলোর মতো নির্ভার হয়ে পড়ল পাথরে। সেই পতনেও তাঁর মৃত্যু হল না। অরণ্যে দাবানলে প্রবেশ করে আত্মহননে প্রবৃত্ত হলেন। এ বারেও বৃথা চেষ্টা। অগ্নি দাহিকাশক্তি হারিয়ে শীতল হল। প্রদীপ্ত দেদীপ্যমান অগ্নি তাঁকে দগ্ধ করল না। গলায় বিশাল পাথরখণ্ড বেঁধে সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন মহর্ষি। সাগর তরঙ্গভঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দিল তীরে। কোনওভাবেই সেই দীর্ঘজীবন কামনায় একদা ব্রতধারীর, আত্মহত্যার প্রয়াস সফল হল না। ক্ষুণ্ণমনে মহর্ষি বশিষ্ঠ ফিরে এলেন আশ্রমে।

পুত্রহীন শোকার্ত মুনি, শূন্য আশ্রমে থাকতে পারলেন না। পথে বর্ষার নতুন জলভারে পরিপূর্ণ নদী দেখে, তাঁর আত্মহননের ইচ্ছা প্রবল হল। উপকূলবর্তী লতা প্রভৃতি সংগ্রহ করে, নিজেকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে,মহর্ষি, দুঃসহ কষ্টে নদীতে ডুব দিলেন। ঋষির সমস্ত বাঁধন মুক্ত করে, তাঁকে তীরে ফিরিয়ে দিল নদী। পাশমুক্ত ঋষি নদীটির নামকরণ করলেন ‘বিপাশা’। কিন্তু শোক থেকে ঋষির মুক্তি নেই। নদী পাহাড়, হ্রদ কোথাও তিনি স্থির থাকতে পারেন না। আবারও হিমালয় থেকে উদ্ভূত, হিংস্র জলপ্রাণীতে সমাকীর্ণ, ভয়ঙ্কর পার্বত্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঋষি। অগ্নিতুল্য ব্রাহ্মণকে অনুভব করল নদী। তরঙ্গবেগে ঋষিকে তুলে দিল তীরে। তারপরে শত গুণ বেগে প্রস্থান করল। তাই তার নাম হল শতদ্রু। স্থলভাগে নিজেকে আবিষ্কার করে, মহর্ষি বুঝতে পারলেন নিজেই নিজেকে হত্যা করতে পারবেন না। তিনি ফিরে চললেন নিজের আশ্রমে। আশ্রমের কাছে মহর্ষির অনুসরণরত অদৃশ্যন্তী নামে পুত্রবধূ। পিছন দিক থেকে, ব্যাকরণগত ষড়ঙ্গ অনুসরণহেতু শুদ্ধ, উচ্চারণে পূর্ণ অর্থ প্রকাশক, বেদবিহিত উদাত্ত অনুদাত্ত স্বরিত স্বর অনুসারে বেদপাঠধ্বনি শুনতে পেলেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

বশিষ্ঠ জানতে চাইলেন, অনুব্রজতি কো ন্বেষ মামিত্যেবাথ সোঽব্রবীৎ। আমার অনুসরণরত কে? তাঁর পুত্রবধূ অদৃশ্যন্তী, নিজের পরিচয় জানালেন।তপোব্রতচারিণী একাকিনী মহর্ষি বশিষ্ঠের সহযাত্রিণী, তিনি মহর্ষির পুত্র শক্ত্রির বিধবা স্ত্রী। আর বেদপাঠধ্বনির কারণ হল অদৃশ্যন্তীর গর্ভস্থ শক্ত্রির দ্বাদশবর্ষীয় পুত্র। সেই বেদপাঠ করছে। বংশরক্ষার কারণ শক্ত্রিপুত্র—এই তথ্য জেনে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। মৃত্যুর ইচ্ছে ত্যাগ করলেন মহর্ষি।পুত্রবধূর সঙ্গে আশ্রমে প্রত্যাবর্তনের পথে সেই নরমংসভুক কল্মাষপাদের সম্মুখীন হলেন বশিষ্ঠ। কল্মাষপাদ তাঁদের ভক্ষণের ইচ্ছায়, রেগে, তেড়ে এল। ভয়ে বিহ্বল অদৃশ্যন্তী মহর্ষির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বিভৎস আকৃতি, দণ্ডধারী, সাক্ষাৎ মূত্যুরূপ, কল্মাষপাদ তাঁদের দিকেই ধেয়ে আসছেন। একমাত্র মহর্ষি সেই নরখাদক রাক্ষসের প্রতিরোধে সক্ষম।

বশিষ্ঠ অভয় দিয়ে সেই রাক্ষসের প্রকৃত পরিচয় জানালেন। রাক্ষস নয়, তিনি পৃথিবীখ্যাত শৌর্যশালী রাজা কল্মাষপাদ। মহর্ষি, মন্ত্রপূত জল দিয়ে রাজাকে শাপমুক্ত করলেন। রাজা কল্মাষপাদ স্বদীপ্তিতে প্রকাশমান হলেন। রাজা কল্মাষপাদ, চেতনা ফিরে পেয়ে ঋষিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠকে অভিবাদন করে বললেন, তিনি সৌদাস (রাজা সুদাসের পুত্র), তিনি মহর্ষির যজমান। এখন মহর্ষির ইচ্ছানুসারেই তিনি চালিত হবেন। মহর্ষিকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, তিনি আর কোনওদিন ব্রাহ্মণদের অসম্মান করবেন না। রাজা, বশিষ্ঠমুনির কাছে, ইক্ষ্বাকুবংশের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে, রূপবান, গুণবান সচ্চরিত্র বংশধর প্রার্থনা করলেন। মহর্ষি সম্মত হলেন। রাজার প্রত্যাবর্তনের কারণে উৎসবমুখর অযোধ্যা নগরীতে ফিরে,রাজার আদেশানুসারে জ্যেষ্ঠা মহিষী বশিষ্ঠের সঙ্গে মিলিত হলেন। রানির গর্ভসঞ্চারের পরে মহর্ষি ফিরে গেলেন আশ্রমে। দীর্ঘ বার বছর পরে রানি পাথর দিয়ে গর্ভ ছিন্ন করলেন। ভূমিষ্ঠ হলেন রাজা অশ্মক,যিনি পৌদন্য নগরীতে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

দুই মহর্ষি, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের বিবাদ যেন মানুষের ইতিবাচক ও নেতিবাচক শক্তির সংঘাত। রাজা বিশ্বামিত্র মহর্ষি হয়েছেন, রাজর্ষি থেকে ব্রহ্মর্ষি হয়েছেন কিন্তু ঔদ্ধত্য ত্যাগ করতে পারেননি। দুই মহর্ষির ইগোর লড়াইতে বলি হয়েছেন রাজা কল্মাষপাদ। সদর্থক চিন্তা বলিষ্ঠ মনে প্রভাব বিস্তারে তৎপর হয়। শৌর্যশালী রাজা কল্মাষপাদ সেই মাধ্যম, যাঁকে অধিগত করতে ইচ্ছুক হয় একাধারে সদর্থক ইতিবাচক ধ্যানধারণা এবং নেতিবাচক চিন্তাও। কল্মাষপাদ রাজা, তাই তিনি সাধারণের বিশিষ্ট প্রতিনিধি। অস্ত্যর্থক চিন্তার আধার মহর্ষি বশিষ্ঠ। মহর্ষি বিশ্বামিত্র তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছতে রাজার পশুপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছেন, নেতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে। তাঁর এই লক্ষ্য স্পর্শ করার প্রয়াসের পথ বন্ধুর, হিংসা ও প্রতিহিংসার কাঁটায় পরিপূর্ণ। প্রতি মুহূর্তে সেখানে প্রাণহানি ও নিরন্তর রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা। যে কোনও ঘৃণ্য উপায়ে উদ্দেশ্যসাধনের চেষ্টা, মানবিকতা বিরোধী, নিন্দনীয়। যে কোনও উপায়ে স্বার্থসাধনই, অভীষ্টপূরণের সহজ পথ।

মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পরিকল্পিত নেগেটিভ চিন্তার ভিত্তি, পাশব প্রবৃত্তি। তিনি সেটি রাজার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন। কল্মাষপাদ ব্রাহ্মণের ইচ্ছাপূরণ করতে চেয়েছেন,সহজলভ্য বধ্যভূমি থেকে সংগৃহীত নরমাংস পরিবেশনায় তাঁর ইচ্ছাপূরণের অঙ্গীকার সফল করতে চেয়েছেন। সাধারণ মানুষ আমরা, আদর্শ পুরুষের জীবনাদর্শ অনুসরণ করি। সেই আদর্শ পুরুষটি যদি ঘৃণ্য পথ দেখান এবং সেটি প্রকাশ পায় যখন, তখন সেই তথাকথিত রোল মডেলের নগ্ন স্বরূপ প্রকাশিত হওয়ায় তিনি আরও ভয়ঙ্কর নাশকতায় মেতে ওঠে। রাজা কল্মাষপাদ কৃত হত্যালীলা যেন তার প্রমাণ।

ছবি: প্রতীকী।

রাজা কল্মাষপাদ ও ঋষি শক্ত্রির বিরোধে,রাজার উদ্ধত ক্ষমতার দম্ভের মধ্যে নিহিত হিংস্র প্রবৃত্তি প্রকট হয়েছে, শক্ত্রির প্রতি প্রদত্ত কশাঘাতে। রাক্ষসের পাশব প্রবৃত্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন ঋষি শক্ত্রি। নিজের জীবন দিয়ে তার মূল্য পরিশোধ করেছেন ঋষি। এমনটাই ঘটে থাকে। নিজস্ব ইগো বজায় রাখবার তাগিদে বাগযুদ্ধে হিংসা ও প্রতিহিংসার বাতাবরণ তৈরী হয়। ধীরে ধীরে সেটি ভেতরের ঘুমন্ত পশুবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে। পরিণতি হল সার্বিক ধ্বংস।

রাজা কল্মাষপাদের রূপান্তরের মূলে ছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অন্তর্নিহিত চক্রান্ত। মহর্ষির ক্ষমাশীলতা তাঁর পুত্রকে প্রভাবিত করেনি। মানুষ মানবিকবৃত্তিধারী প্রাণী। বুদ্ধিবৃত্তির কারণে, প্রাণীজগতে মানুষের অনন্যতা। অতর্কিত আঘাত, মানুষের পাশবপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে, বুদ্ধিবৃত্তি গৌণ হয় তখন।ঋষি শক্ত্রি সেই আহত মানসিকতার প্রতীক। হিতাহিতজ্ঞানশূন্যতার প্রভাবের ফলে সুদূরপ্রসারী চিন্তাবোধ লোপ পায়। ঋষি শক্ত্রির রাক্ষসের গ্রাসে পরিণত হওয়া যেন হিংসা ও প্রতিহিংসাকে প্রশ্রয় দেবার আত্মঘাতী পরিণাম।

ঋষি বশিষ্ঠ ইতিবাচক চিন্তার আধার। উদার মুক্ত চিন্তা কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। মহর্ষি বশিষ্ঠ শোকে আত্মহননের আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। জীবনযন্ত্রণার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। পাহাড়, নদী, আগুন, সমুদ্রর মতোই অনন্ত ও গভীর ইতিবাচক চিন্তার অস্তিত্ব। তাই মহর্ষি বশিষ্ঠের জীবনবোধ নষ্ট হয়নি। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে পরম্পরাগত জ্ঞানের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষ অনুভবের ফলে, তিনি জীবনে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছেন। দুই মহর্ষি, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র। দু’ জনে ক্রমান্বয়ে সদর্থক ও নঞর্থক চিন্তার বাহক। ইতি ও নেতির দ্বন্দ্বে সদর্থক চিন্তার জয় ঘোষণা— চিরন্তন, অমোঘ, অব্যর্থ। দুই মহর্ষির প্রতিদ্বন্দ্বিতার টানাপোড়েনের মধ্যে হয়তো সেই আবহমান ইতিবাচক চিন্তার বিজয়বার্তা নিহিত, নয় কী?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content