রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


হেমন্তবালা দেবী।

উনিশ বিশ শতক বেশ দুমুখো। একদিকে মেয়েরা পর্দার আড়ালটিকেই নিজেদের জীবন মনে করে মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার দোলাচলে কাটিয়ে দিত গোটা জীবন। অন্যদিকে আরেক দল মেয়ে ঠিক যেন রক্তকরবীর নন্দিনী। প্রশ্ন আর যুক্তির শানিত দীপ্তি মেয়েদের জীবনকে ঠেলে নিয়ে চলেছিল আলোর পথে।

“জোনাকি সে কমতি কিসে বল না রবি!
কিরণ কি গো তোমার কেনা
ভুবন শুধু তোমার চেনা
সবার চোখে আঁকা শুধু তোমারি ছবি?”


কবির জন্য চিঠির সাদা পাতায় ছন্দে গেঁথে শব্দের ফুল ফোটানোর স্পর্ধা একটি মেয়ের হয়েছিল। চিঠি গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিকানায়! এমন চিঠি তো কতই আসত। শান্তিনিকেতনে এই সব চিঠি সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন সুধীরচন্দ্র কর। রবীন্দ্রনাথ জানতেন না, সুধীরচন্দ্র এবং আরও কয়েকজন মিলে এই সব হুজুগে চিঠি রাখার জন্য একটি বিশেষ ফাইলের ব্যবস্থা করেছিলেন। খ্যাপা পবনের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসা এই সব চিঠি রাখার ফাইলের নাম দেওয়া হয়েছিল, পাগলা ফাইল। মেয়েটির প্রথম চিঠি জায়গা পেয়েছিল ওই পাগলা ফাইলে।

পরের চিঠিতে মেয়েটি স্বাক্ষর করেছিলেন খদ্যোৎবালা! তৃতীয় চিঠিতে পত্রপ্রেরক হলেন জোনাকী দেবী! এই নিরন্তর অধ্যাবসায় হয়তো রবীন্দ্রনাথের মন ছুঁয়েছিল, তাই আটই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১ এ ডাকঘরের রাজার চিঠির মতো রবীন্দ্রনাথের চিঠি পেলেন মেয়েটি—“কল্যাণীয়া জোনাকী, তুমি আমার অন্তরের আশীর্বাদ গ্রহণ কর।” মেয়েটি বুঝি ডাকঘরের অমলের মতোই প্রতীক্ষায় বসেছিলেন। এই চিঠি তাঁর অন্তরের সেরা ধন হয়ে রইল। মেয়েটির নাম হেমন্তবালা! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্রবন্ধু।
হেমন্তবালার শিশুবেলা ও কিশোরীবেলা কেটেছে বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। তাঁর বাবা ছিলেন গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, মায়ের নাম ছিল অনন্তবালা দেবী। সেই আমলের পর্দানশীন মেয়েদের মতো তাঁর ছোটবেলা কাটেনি। বাবা ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী, তাঁর গানের সঙ্গে হেমন্তবালা ঢোলকে বোল তুলতেন। সেই সময়ের ছেলেদের মতোই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল সরস্বতী পুজোর দিন। বাগান করা, ব্যাটবল, উইকেট, পায়ে বাঁধার প্যাড নিয়ে দিব্যি খেলা জমাতেন বাড়ির ছোট ছেলে আর বালক ভৃত্যদের সঙ্গে।

খেলাঘরে সাজতেন বাবু কর্তা! মিথ্যে মিথ্যে হুঁকো টেনে, মিথ্যে মদ খেয়ে আজব সব খেলা ছিল তাঁর। বুক কাঁপতো তাঁর মায়ের। তাই এই সবের পাশাপাশি রান্নার মশলা চেনা, ব্রত উদযাপনের মতো মেয়েলি কাজও চলত। বাড়িতে পুজো হত ঘটা করে। পদ্য লিখতে পারতেন বলে ছোট থেকেই দেবদেবীদের নিয়ে কবিতা ও গান লিখতেন হেমন্তবালা। অথচ দুর্গাপুজোয় অঞ্জলি দিতে গিয়ে প্রশ্ন ভাসত মনে—“এ কেন মা হবে? এতো মাটির পুতুল — ঐ মাটির পুতুল কি নৈবেদ্য খায়?”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩০: নলিনী দাশ— গণ্ডালুর সৃজনশিল্পী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭১: মহাভারতে বর্ণিত পোষ্যপ্রাণী ও পালকপিতার সম্পর্কের বাঁধন, আজও খুঁজে পাওয়া যায় কী?

ব্রাহ্ম বাড়ির মেয়েদের শিক্ষা দীক্ষা, সাজপোশাক বড় আকর্ষণ করত হেমন্তবালার মনকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে অসংখ্য বই পড়ে বড় হচ্ছিলেন হেমন্তবালা। সংসারের সব কাজ জানলেও তিনি হয়তো ঠিক সংসার করার জন্য জন্মাননি। এত সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন মনের মেয়েদের যথার্থ দোসর সহজে মেলে না। তারাই হয়তো রাধা হয়, মীরা হয়, লাবণ্য বা দামিনী হয় অথবা হেমন্তবালা হয়। ১৯০৪ সালের ফাল্গুন মাসে রাত তিনটের সময় ঘুমন্ত হেমন্তবালার মালাবদলের সময় মালা পড়ে গিয়েছিল নীচে। কে যেন তুলে পরিয়ে দিয়েছিল বরের গলায়। নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের ভাগ্নে ব্রজেন্দ্রকান্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু মনের মিল কোনোদিন হল না। স্বামীসঙ্গ বলতে গন্ধতেল, এসেন্স, কুন্তনীল পুরস্কার পাওয়া বই আর রবীন্দ্রনাথের বই পাওয়া! রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কাছে মন্ত্র!
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৭: গাড়ি থেকে নেমেই ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘তোদের ছবির নামই তো পথে হল দেরি’

অন্দরমহলে ‘আমরা স্ত্রীলোক’, ‘পুরুষের দাসী’ — এই ধরণের কথায় হেমন্তবালা রীতিমত বিরক্ত হতেন। ভাব জমেছিল শুধু দিদিশাশুড়ি ব্রজসুন্দরীর সঙ্গে। এই প্রবীণাও লুকিয়ে লেখাপড়া করে পদ্য লিখে তা বাক্সবন্দি করে রাখতেন। শ্বশুরবাড়ির ঘেরাটোপে নাস্তিক মেয়েটি মানুষকে ভালোবাসতে না পেরে গৃহদেবতা মদনমোহন আর শ্যামসুন্দরকে ভালোবেসে ফেলেন। আশ্চর্য মনের গড়ন ছিল মেয়েটির। সম্ভবত বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বলেই পনেরো বছরের মাতৃত্বও তাঁকে সংসারমুখী করতে পারেনি। তার উপর ছিল দুই পরিবারের মধ্যে অহংকারের দ্বন্দ্ব! হেমন্তবালা একদিক থেকে সেই লড়াইয়ের বলিও বটে।

ব্রজেন্দ্রকান্ত নিতে এলেও তিনি ফিরলেন না। শ্বশুরবাড়ি থেকে যখন স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের হুমকি দেওয়া হল, হেমন্তবালা সম্মতিপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও ব্রজেন্দ্রকান্ত আর বিয়ে করেননি। এরপর হেমন্তবালা মনের শান্তি পাওয়ার জন্য দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোনও নিয়মের নিগড়ে বন্দি করেননি নিজেকে। শিক্ষাগুরু শ্রীকিশোরানন্দ মহারাজা শ্রীঠাকুরকে দেখে তাঁর রূপমুগ্ধ হয়েছিলেন। এই শ্রীঠাকুরের চেহারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের চেহারার মিল ছিল। শ্রীঠাকুরের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হেমন্তবালার আচরণও সবসময় স্বাভাবিক ছিল না। তাঁর স্বামী কিন্তু দাম্পত্য সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হেমন্তবালার বিদ্রোহী মন বার বার বাধ সেধেছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

এর মধ্যে কিশোরানন্দ মহারাজার মৃত্যু হেমন্তবালাকে বদলে দিল আবার। আর ধর্মগ্রন্থ নয়! এইবার মাসিকপত্র, রবীন্দ্রসাহিত্য পড়তে লাগলেন হেমন্তবালা। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘অচলায়তন’ পঞ্চকের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেলেন। নিজেকে ‘দুরন্তবালা আকাশ নারী’ রূপে নতুনভাবে আবিষ্কার করলেন হেমন্তবালা। ঠিক এইসময় রবীন্দ্রনাথকে তাঁর প্রথম চিঠি লেখা। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনায়াসে একটি কবিতা চেয়ে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই তাঁর লেখার বাঁধুনিতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাই সত্যিই কবিতা লিখে পাঠালেন —‘নীহারিকা’ নামে।

প্রথমে তো বিশ্বাসই করেননি হেমন্তবালা। তারপর যখন বুঝলেন সত্যিই কবি নিজের হাতের লেখায় কবিতা লিখে পাঠিয়েছেন, তখন মনের আড় ভেঙে গেল। শুরু হল কবির সঙ্গে পত্রমিতালি। রবীন্দ্রনাথ হলেন হেমন্তবালার ‘কবিদাদা’! হেমন্তবালা হলেন রবির আদরের জোনাকি। দীর্ঘ দশ বছরের এই পত্রবিনিময় জন্ম দিল ২৬৪টি অসাধারণ পত্র। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র নবম খণ্ডে এই চিঠিগুলি মুদ্রিত হয়েছে ১৯৬৪ সালে। এই চিঠিগুলিতে কেবল আবেগ বিনিময় নেই। পৌত্তলিকতা এবং অপৌত্তলিকতার যে দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল, তার সহজ প্রকাশ আছে।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

চিঠি লেখার শুরুর দিনগুলিতে হেমন্তবালা নিজের পরিচয় গোপন করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আন্তরিকতায় তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। তারপর তাঁদের দেখাও হয়েছে। উপহার বিনিময়ও হয়েছে। কথার কালো মেঘ জমেছে দুজনের সম্পর্ককে ঘিরে। অনেকে বলেছেন রবি ঠাকুর হেমন্তবালাকে নাকি ব্রাহ্ম করে দেবেন! দুজনেই নীরব থেকেছেন। কিন্তু অটুট রেখেছেন দুজনের সখ্য। হেমন্তবালার লেখায় লেখক সত্তার পরিচয় পেযেছিলেন। লিখেছিলেন, “তোমার চিঠিতে আমি তোমার কবিতার যে পরিচয় যে পেয়েছি তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। অত্যন্ত খাঁটি কবিতা। বানানো নয় নব পরিণত সৃষ্টি।” এই প্রশংসা সেই সময়ের এক নারীর কাছে বিশেষ পাওনা। তাছাড়াও হেমন্তবালা নিয়মিত লেখাপড়া চর্চা করতেন। কবিতা লিখতেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। হেমন্তবালা একজন শক্তিশালী লেখক ছিলেন। না হলে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁকে ২০০-র বেশি চিঠি কখনোই লিখতেন না।

হেমন্তবালার মনের মধ্যে বিশ শতকের এক দৃপ্ত, শিক্ষিত মানুষের বাস ছিল। শুধুমাত্র মেয়েমানুষের ঘেরাটোপে হেমন্তবালাকে বাঁধা যায়নি কখনও। তাই সেই শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা মানুষের অটুট সখ্য ও সম্মান পেয়েছিলেন তিনি। যে সম্মান দেওয়ার সাধ্য সেই সময়ের অন্দরমহলের ছিল না। যেকোনও মেয়ের মধ্যে একটা বিরহী মন রয়েছে। লেখকের মধ্যে তো বটেই। হেমন্তবালা লিখেছিলেন, “একদিন শুধু একদিন মোরে/ কঠিন বাঁধনে বেঁধে নিয়ো। / একদিন শুধু হারায়ো মনের বাসনা/ নয়নে নয়ন মেলায়ে নীরব ভাষণা—!”

হেমন্তবালার মন ছিল চঞ্চল। নাহলে সেইসময়ের বলিষ্ঠ লেখকদের মধ্যে একজন হতেন তিনি।
ঋণ
রবি ও জোনাকি: জয়ন্তী সান্যাল
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content