ছবি: প্রতীকী।
মিত্রভেদ
রাজা অমরশক্তির তিন পুত্রকে ছ’মাসের মধ্যে রাজনীতি-কূটনীতি বিষয়ে উপদেশ দিতেই বিষ্ণুশর্মা রচনা করেছিলেন ‘পঞ্চতন্ত্র’। কথামুখ অংশেই এ আলোচনা আমরা পূর্বেই করেছি। কিন্তু কোথায় কখন উপদেশ দিতে হয় এবং অপাত্রে উপদেশ দিলে কি অঘটন ঘটতে পারে সে কথাও তিনি পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন কাহিনিতে বলে গিয়েছেন প্রচ্ছন্নভাবে। সেই ভাবনাই ধ্বনিত হয় স্পষ্টভাবে করটকের কণ্ঠে—“উপদেশো ন দাতব্যঃ”। যেখানে সেখানে উপদেশ দিতে নেই। সিংহ-পিঙ্গলক আর বৃষ-সঞ্জীবকের মধ্যে যখন দমনক ভেদনীতির খেয়াল মেতে উঠেছিল করটক তাকে সাবধান করেছিল বারে বারে। কিন্তু করটকের সেই সাবধানবাণী দমনক কানে তোলেনি। কিন্তু তার ফলে এখন যখন সিংহের প্রাণহানির সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই করটক তাকে মূর্খ বলতে ছাড়েনি। কারণ মূর্খ ব্যক্তিই ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না এবং অন্যে তাকে সতর্ক করলেও সে তাকে উপেক্ষা করে। উল্টে উপদেশ শুনলে তারা রেগে যায়।
করটক তবুও বকাঝকা থামায় না। দমনককে বলে, ওরে মূর্খ! তোমাকে তো শিক্ষা দিলেও সে শিক্ষা তুমি নিতে পারো না। সত্যি বলতে এতে তোমার দোষও কিছু নেই। কারণ শিক্ষা সজ্জনদেরই উপকার করে, তাঁরা শিক্ষাকে গ্রহণ করতে পারে। যারা দুষ্টস্বভাবের লোক, তাদের সে শিক্ষা কোনও কাজেই লাগে না। অন্ধকারপূর্ণ ঘটের উপর যদি প্রদীপের আলো রাখা হয় সে আলো যেমন ঘটের ভিতরের অন্ধকারকে দূর করতে পারে না; ঠিক তেমনই ভাবে, যে ব্যক্তি মূর্খ, ভিতরটা যার অজ্ঞানান্ধকারে পূর্ণ, তার কাছে জ্ঞানের দীপ নিয়ে এলেও অন্তরের অন্ধকার দূর হয় না তার।
বলা ভালো—
পুত্রেণ ব্যর্থপাণ্ডিত্যাৎ পিতা ধূমেন ঘাতিতঃ।। (মিত্রভেদ, ৪২৯)
অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধি আর কুবুদ্ধি—এই দু’জনকেই আমি এখন বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছি। পুত্রের কুবুদ্ধির জন্যেই নিজের ব্যর্থ পাণ্ডিত্যের আত্মবিশ্বাসের ডুবে নিজের পিতাকেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ করে মেরে ফেলল।
দমনক বলল— “কথমেতৎ”। সে ঘটনাটা আবার কী রকম?
করটক তখন বলতে শুরু করল।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?
১৯: ধর্মবুদ্ধি-পাপবুদ্ধি-কথা
কোনও এক দেশে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি নামের দুই বন্ধু বাস করতো। দুই বন্ধুর নামকরণের মাধ্যমেই পঞ্চতন্ত্রকার তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টদুটিও পাঠকদের কাছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। একবার পাপবুদ্ধি চিন্তা করল, একে তো সে মূর্খ আর তার উপরে নিতান্ত দরিদ্র। তাই ধর্মবুদ্ধিকে সঙ্গে নিয়ে দূরদেশে কোনও বিদেশ-বিভূঁইতে গিয়ে অনেক ধনোপার্জন করে তারপর তাকে ধোকা দিয়ে যদি সেসব হস্তগত করা যায় তাহলে ভবিষ্যতের চিন্তা আর থাকে না। এরপর সুযোগ বুঝে একদিন পাপবুদ্ধি ধর্মবুদ্ধিকে গিয়ে বলল, ওহে মিত্র! বয়স হলে অনন্ত অবসরে নিজের যৌবনের কথা তো কিছু স্মরণ করতে হবে? তাই দেশ-বিদেশে না গেলে বাচ্চাদের বা নাতিনাতনিদের কি গল্প বলবে? লোকে বলে—
ভ্রমতা ধরণীপীঠে তস্য ফলং জন্মনো ব্যর্থম্।। (ঐ, ৪৩০)
যে লোক দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়ে সেখানকার বেশভূষা, ভাষা বা সেখানকার বহুসংস্কৃতি রপ্ত করে না তার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়াটাই বৃথা। আরও বললে বলতে হয়, যে লোক এই সংসারে এসে বিদ্যা, ধনসম্পদ বা কারিগরী শিক্ষা যতক্ষণ না আয়ত্ত করতে পারে ততক্ষণ সে এই দুনিয়ায় বিভিন্ন জায়গায় মনের আনন্দে ঘুরে বেরাতে পারবে না।
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা
এরপর অন্য একদিন ধর্মবুদ্ধির যখন কিছু টাকা-পয়সার প্রয়োজন পড়ল সে তখন পাপবুদ্ধির কাছে বলল, মিত্র! আমার বিশাল সংসার। এইটুকু টাকায় আমার চলছে না। চলো দু’জনে মিলে সেই গর্তে গিয়ে কিছু ধন নিয়ে আসি।
পাপবুদ্ধি নিষ্পাপ শিশুর মতন বলল— “ভদ্র! এবং ক্রিযতাম্”। বন্ধু! তাই হোক।
এরপর দুজনে গিয়ে সেই স্থানে মাটি খুড়তে শুরু করল এবং যথারীতি মাটির তলা থেকে ফাঁকা ঘরা বেরলো।
পাপবুদ্ধি মাথায় হাত দিয়ে চিত্কার চেঁচামেঁচি শুরু করলো, ওহে ধর্মবুদ্ধি! তুমিই এই সব সম্পদ চুরি করেছো, আর কেউ না। এই নিধির খবর তুমি ছাড়া আর কেউ জানতো না। সব কিছু নিয়ে আগের মতন গর্ত তুমি ভরিয়ে দিয়েছো যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আমার অর্ধেক ধন তোমাকে এখনই দিতে হবে। নাহলে এখনই আমি রাজদরবারে যাব। আমি তোমাকে ছাড়ব না।—চলবে।