শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

রাজা অমরশক্তির তিন পুত্রকে ছ’মাসের মধ্যে রাজনীতি-কূটনীতি বিষয়ে উপদেশ দিতেই বিষ্ণুশর্মা রচনা করেছিলেন ‘পঞ্চতন্ত্র’। কথামুখ অংশেই এ আলোচনা আমরা পূর্বেই করেছি। কিন্তু কোথায় কখন উপদেশ দিতে হয় এবং অপাত্রে উপদেশ দিলে কি অঘটন ঘটতে পারে সে কথাও তিনি পঞ্চতন্ত্রের বিভিন্ন কাহিনিতে বলে গিয়েছেন প্রচ্ছন্নভাবে। সেই ভাবনাই ধ্বনিত হয় স্পষ্টভাবে করটকের কণ্ঠে—“উপদেশো ন দাতব্যঃ”। যেখানে সেখানে উপদেশ দিতে নেই। সিংহ-পিঙ্গলক আর বৃষ-সঞ্জীবকের মধ্যে যখন দমনক ভেদনীতির খেয়াল মেতে উঠেছিল করটক তাকে সাবধান করেছিল বারে বারে। কিন্তু করটকের সেই সাবধানবাণী দমনক কানে তোলেনি। কিন্তু তার ফলে এখন যখন সিংহের প্রাণহানির সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই করটক তাকে মূর্খ বলতে ছাড়েনি। কারণ মূর্খ ব্যক্তিই ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না এবং অন্যে তাকে সতর্ক করলেও সে তাকে উপেক্ষা করে। উল্টে উপদেশ শুনলে তারা রেগে যায়।

করটক তবুও বকাঝকা থামায় না। দমনককে বলে, ওরে মূর্খ! তোমাকে তো শিক্ষা দিলেও সে শিক্ষা তুমি নিতে পারো না। সত্যি বলতে এতে তোমার দোষও কিছু নেই। কারণ শিক্ষা সজ্জনদেরই উপকার করে, তাঁরা শিক্ষাকে গ্রহণ করতে পারে। যারা দুষ্টস্বভাবের লোক, তাদের সে শিক্ষা কোনও কাজেই লাগে না। অন্ধকারপূর্ণ ঘটের উপর যদি প্রদীপের আলো রাখা হয় সে আলো যেমন ঘটের ভিতরের অন্ধকারকে দূর করতে পারে না; ঠিক তেমনই ভাবে, যে ব্যক্তি মূর্খ, ভিতরটা যার অজ্ঞানান্ধকারে পূর্ণ, তার কাছে জ্ঞানের দীপ নিয়ে এলেও অন্তরের অন্ধকার দূর হয় না তার।

করটক বলেই চলে, আসলে কেউ যদি নিজেকে পণ্ডিত বা সবজান্তা বলে মনে করে তার এমনই ভাগ্যবিপর্যয় হয়। তাই আমার কথা তো তোমার কানে গেলই না, উল্টে তেমনই মনের শান্তিটুকুও খোয়ালে। ফলে তুমি যে সত্যি সত্যিই একজন অধম শ্রেণির মানুষ সেটা আর বুঝতে বাকি নেই আমার। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা পুত্রদের চার ভাগে ভাগ করেছেন— [১] জাত, [২] অনুজাত, [৩] অতিজাত, এবং [৪] অপজাত। যে পুত্র মায়ের সমান গুণসম্পন্ন পণ্ডিতেরা তাকে ‘জাত’ বলে উল্লেখ করেছেন; পিতার ন্যায় গুণবান যারা তারা ‘অনুজাত’ শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত। যে পুত্র পিতার থেকেও গুণবান পণ্ডিতেরা তাকে “অতিজাত” বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যে পুত্র অত্যন্ত অধম স্বভাবের পণ্ডিতেরা তাকে বলেছেন ‘অপজাত’। ওহে দমনক! তুমি প্রকৃত অর্থেই ‘অপজাত’। আসলে দুষ্ট ব্যক্তিদের চরিত্রই এমন। তারা অন্যকে পীড়া দিয়ে আনন্দ পায় কিন্তু নিজের বিনাশ তারা দেখতে পায় না। যুদ্ধের সময়ে মাথা কাটা পড়লেও মুণ্ডহীন ধরটা কেমন যুদ্ধভূমিতে নাচতে থাকে দেখেছো? তোমার অবস্থাটা ঠিক সেইরকম।
বলা ভালো—
ধর্মবুদ্ধিঃ কুবুদ্ধিশ্চ দ্বাবেতৌ বিদিতৌ মম।
পুত্রেণ ব্যর্থপাণ্ডিত্যাৎ পিতা ধূমেন ঘাতিতঃ।। (মিত্রভেদ, ৪২৯)


অর্থাৎ ধর্মবুদ্ধি আর কুবুদ্ধি—এই দু’জনকেই আমি এখন বেশ ভালো করেই বুঝে নিয়েছি। পুত্রের কুবুদ্ধির জন্যেই নিজের ব্যর্থ পাণ্ডিত্যের আত্মবিশ্বাসের ডুবে নিজের পিতাকেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ করে মেরে ফেলল।
দমনক বলল— “কথমেতৎ”। সে ঘটনাটা আবার কী রকম?
করটক তখন বলতে শুরু করল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

 

১৯: ধর্মবুদ্ধি-পাপবুদ্ধি-কথা

কোনও এক দেশে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি নামের দুই বন্ধু বাস করতো। দুই বন্ধুর নামকরণের মাধ্যমেই পঞ্চতন্ত্রকার তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টদুটিও পাঠকদের কাছে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। একবার পাপবুদ্ধি চিন্তা করল, একে তো সে মূর্খ আর তার উপরে নিতান্ত দরিদ্র। তাই ধর্মবুদ্ধিকে সঙ্গে নিয়ে দূরদেশে কোনও বিদেশ-বিভূঁইতে গিয়ে অনেক ধনোপার্জন করে তারপর তাকে ধোকা দিয়ে যদি সেসব হস্তগত করা যায় তাহলে ভবিষ্যতের চিন্তা আর থাকে না। এরপর সুযোগ বুঝে একদিন পাপবুদ্ধি ধর্মবুদ্ধিকে গিয়ে বলল, ওহে মিত্র! বয়স হলে অনন্ত অবসরে নিজের যৌবনের কথা তো কিছু স্মরণ করতে হবে? তাই দেশ-বিদেশে না গেলে বাচ্চাদের বা নাতিনাতনিদের কি গল্প বলবে? লোকে বলে—

দেশান্তরেষু বহুবিধভাষাবেশাদি যেন ন জ্ঞাতম্।
ভ্রমতা ধরণীপীঠে তস্য ফলং জন্মনো ব্যর্থম্।। (ঐ, ৪৩০)


যে লোক দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়ে সেখানকার বেশভূষা, ভাষা বা সেখানকার বহুসংস্কৃতি রপ্ত করে না তার এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়াটাই বৃথা। আরও বললে বলতে হয়, যে লোক এই সংসারে এসে বিদ্যা, ধনসম্পদ বা কারিগরী শিক্ষা যতক্ষণ না আয়ত্ত করতে পারে ততক্ষণ সে এই দুনিয়ায় বিভিন্ন জায়গায় মনের আনন্দে ঘুরে বেরাতে পারবে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসাসা— নুনিয়া ও সিঙ্গরা

পাপবুদ্ধির যুক্তি শুনে ধর্মবুদ্ধি বেশ উত্সাহ পেলো। সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে, শুভ মুহূর্ত দেখে বাড়ির গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে পাপবুদ্ধির সঙ্গে সে ভাগ্য অন্বেষণে দেশ-বিদেশ দেখতে বেরলো। পাপবুদ্ধির অনুমানও সত্য হল। ধর্মবুদ্ধির প্রভাবে বহু অর্থোপার্জন করলো সে। এরপর একদিন উপার্জিত অর্থ দেখে প্রসন্ন হয়ে দুজনে স্থির করলো যে এবার তারা স্বদেশে ফিরবে। কারণ যে ব্যক্তি বিদেশে বসবাস করে বিদ্যালাভ করে বা উপার্জিত অর্থের দ্বারা ধনলাভ করে বা কারিগরী বিদ্যা বিক্রয় করে উপার্জন করে তার কাছে এক ক্রোশ ভূমিও শতযোজনের মতন প্রতিভাত হয়। সবকিছু কাছে থেকেও যেন সবকিছু তার দূরে-দূরেই থাকে। ব্যাপারটা হল জীবনে রোজগার করাটাই সব নয়, তাকে ভোগ না করলে রোজগার করার কোনও মানেই হয় না।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৩: জোর কা ঝটকা

দুই বন্ধুতে আলোচনা করে উপার্জিত অর্থ নিয়ে স্বদেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। স্বদেশের কাছে এসে পাপবুদ্ধি ধর্মবুদ্ধিকে বলল, হে ভদ্র! এই সব ধনসম্পদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। টাকা আছে শুনলেই আত্মীয়-পরিজন সকলে হাত পাততে শুরু করবে। তাই আমার মনে হয় এখানেই মাটির মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে কিছুটা ধনসম্পদ এখানে লুকিয়ে রেখে সামান্য কিছু বাড়িতে নিয়ে যাই। যখন যখন দরকার পড়বে তখন এসে আবার প্রয়োজন মতন নিয়ে গেলেই হল? কথায় বলে, বুদ্ধিমান লোক লোকেরা নিজের সামান্য ধনও অন্যকে দেখায় না। কারণ টাকা দেখলে মুনি-ঋষিদের মতন আত্মকামী মানুষের মনও বাস্তবে চঞ্চল হয়, কী ভাবে সেই টাকাপয়সা লাভ করা যায় সে চিন্তা একবার না একবার তাদের মাথাতে আসেই। যেমন ভাবে জলে মাংসের টুকরো পড়লে মাছেরা খেয়ে নেয়; আকাশে পড়লে পাখীরা বা পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকা হিংস্র প্রাণীরা মাংসের টুকরো দেখলেই একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেটা খেয়ে নেয়, ঠিক তেমনই ভাবে ধনীদের দেখলেই লোকেরা তার থেকে টাকা লুঠতে চায়।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

পাপবুদ্ধির কথাটা ধর্মবুদ্ধির মনঃপূত হল। বলল, সেই ভালো। গর্তের মধ্যে টাকা-পয়সা গুলো রেখেই বরং সামান্য কিছু নিয়ে বাড়িতে যাই। কিন্তু শুরু থেকেই পাপবুদ্ধির মনে যে তঞ্চকতা করে ধর্মবুদ্ধির সব ধনসম্পদ লুঠ করে নেওয়ার চক্রান্ত ছিল সেটা আমরা আগে থেকেই জানি। একদিন গোপনে গভীর রাত্রে গিয়ে পাপবুদ্ধি সেই গর্তের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সব ধনটুকু নিয়ে এসে সেই গর্তটাকে আগের মতন মাটি দিয়ে পূর্ণ করে দিল। নিঃশব্দে সকলের চোখের অন্তরালে ফিরে এলো সে নিজের বাড়িতে, যেন কিছুই হয়নি।

এরপর অন্য একদিন ধর্মবুদ্ধির যখন কিছু টাকা-পয়সার প্রয়োজন পড়ল সে তখন পাপবুদ্ধির কাছে বলল, মিত্র! আমার বিশাল সংসার। এইটুকু টাকায় আমার চলছে না। চলো দু’জনে মিলে সেই গর্তে গিয়ে কিছু ধন নিয়ে আসি।

পাপবুদ্ধি নিষ্পাপ শিশুর মতন বলল— “ভদ্র! এবং ক্রিযতাম্”। বন্ধু! তাই হোক।

এরপর দুজনে গিয়ে সেই স্থানে মাটি খুড়তে শুরু করল এবং যথারীতি মাটির তলা থেকে ফাঁকা ঘরা বেরলো।

পাপবুদ্ধি মাথায় হাত দিয়ে চিত্কার চেঁচামেঁচি শুরু করলো, ওহে ধর্মবুদ্ধি! তুমিই এই সব সম্পদ চুরি করেছো, আর কেউ না। এই নিধির খবর তুমি ছাড়া আর কেউ জানতো না। সব কিছু নিয়ে আগের মতন গর্ত তুমি ভরিয়ে দিয়েছো যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আমার অর্ধেক ধন তোমাকে এখনই দিতে হবে। নাহলে এখনই আমি রাজদরবারে যাব। আমি তোমাকে ছাড়ব না।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content