(বাঁদিক থেকে) শান্তিলতা, বিধুমুখী (মা), পুণ্যলতা, সুকুমার, উপেন্দ্রকিশোর। পিছনের সারিতে সুবিনয় ও সুবিমল। একেবারে ডানদিকে সুখলতা।
সরস্বতীর লীলাকমল যেসব সময়ের গল্প বলে, সে ছিল মেয়েদের জন্য পর্দানশীন যুগ। পর্দা মানে আড়াল। এক্ষেত্রে এই আড়াল ছিল পুরুষদের থেকে নারীদের। পুরুষ সাহিত্যিকরা নারীশিক্ষার বাড়বাড়ন্ত দেখে একটু ভয়ই পেয়েছিলেন মনে হয়। ঈশ্বর গুপ্ত তো বলেই বসলেন, ‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো, ব্রত ধর্ম কর্তো সবে/ একা বেথুন এসে শেষ করেছে, আর কি তাদের তেমন পাবে/– এরা আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে—!’ নারীশিক্ষা যেন জ্ঞানবৃক্ষের ফল। সমাজের ঈশ্বর পুরুষ সেই ফলসেবনের পর নারীদের সমাজ থেকে পারলে নির্বাসিত করেন!
এদিকে সময়ের চাকা তখন উল্টোমুখে ঘুরতে শুরু করেছে। মেয়েরা শুধু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হননি, তাঁরা ভালো লেখক ও পাঠক হয়ে উঠছিলেন। পুরুষতন্ত্র হাহাকার করে উঠল। গল্প উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে বাঙালি রমনীদের মধ্যে সঞ্চারিত হচ্ছে ‘বিলিতি পাপ’! এমন ধারণা মেয়েদের পাঠযোগ্য লেখাও নির্দিষ্ট করে দিতে লাগল। ‘স্ত্রীপাঠ্য’ ও ‘সতীপাঠ্য’ রচনা সৃজন হতে শুরু করল। অথচ এই সব ভয় ত্রাসের মধ্যেই কিছু নারী কিন্তু শুধু পাঠক নন, রীতিমতো লেখক হয়ে উঠলেন। পুরুষ সমাজের শত হাহাকারেও কিছু এল গেল না শিক্ষিত মহিলাদের।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৮: জ্ঞানদানন্দিনী দেবী—উনিশ শতকের বলিষ্ঠ লেখক এবং সমাজসংস্কারক
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি
সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে আজ লিখছি পুণ্যলতা রাওকে নিয়ে। সুখলতা রাও-য়ের বোন। তিনিও ছোটদের নিয়ে কাজ করেছেন, সুখলতা রাও-এর মতোই। কিন্তু সেইভাবে তাঁর চর্চা হয়নি। পূণ্যলতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০ সালে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কন্যা হিসেবে সাহিত্যিক মেধা তাঁর মধ্যে ছিলই। পুণ্যলতা ছিলেন দ্বিতীয়া কন্যা। ১৯০৯ সালে স্নাতক পড়তে পড়তে পুণ্যলতার বিয়ে হয়। তাঁর স্বামী অরুণনাথ চক্রবর্তী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।
পূণ্যলতা বিয়ের পরেও কিন্তু একনিষ্ঠ ভাবে লিখে গিয়েছেন। ছোট ছোট গল্প, ছোটবেলার ডিঙ্গুলি, সাদিব ম্যাজিক, গাছপালার কথা, রাজবাড়ি ইত্যাদি তাঁর লেখা বিখ্যাত রচনা। তিনি কলকাতার ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয় ও বেথুন কলেজে জন্মগ্রহণ করেন। পুণ্যলতা সাহিত্য সৃজন করে গিয়েছেন। সুকুমার রায়, সুখলতা রাও-এর খ্যাতির পাশে তাঁকে একটু ম্লান লাগে।
পূণ্যলতা বিয়ের পরেও কিন্তু একনিষ্ঠ ভাবে লিখে গিয়েছেন। ছোট ছোট গল্প, ছোটবেলার ডিঙ্গুলি, সাদিব ম্যাজিক, গাছপালার কথা, রাজবাড়ি ইত্যাদি তাঁর লেখা বিখ্যাত রচনা। তিনি কলকাতার ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয় ও বেথুন কলেজে জন্মগ্রহণ করেন। পুণ্যলতা সাহিত্য সৃজন করে গিয়েছেন। সুকুমার রায়, সুখলতা রাও-এর খ্যাতির পাশে তাঁকে একটু ম্লান লাগে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্তনারী মা সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৪: জোড়াসাঁকোয় পাগল-যাচাই
তবু নিজের স্মৃতিচারণা, ছেলেবেলার দিনগুলিতে পুণ্যলতা লিখেছিলেন, ‘দিদি সবার বড় আর খুব শান্তশিষ্ট। ছেলেবেলায়ও দিদিকে কখনও চেঁচামেচি করতে কিম্বা হুড়োহুড়ি করে খেলতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুনেছি ছোটবেলায় নাকি দিদির খুব অসুখ করেছিল। হাঁটতে এবং কথা বলতে শিখেও অসুখের জন্য ভুলে গিয়েছিল। আবার দাদার সঙ্গে শিখতে শুরে করল। বলা যায়, এই বইটি সেই সময়কার এবং রায় বাড়ির একটি দলিল। পুণ্যলতার মাতামহ ছিলেন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। পুণ্যলতার তত্ত্বাবধানে তাঁর দুই মেয়ে কল্যাণী কারলেকার আর নলিনী দাশও লেখক হয়েছেন। যে বাড়িতে সন্দেশ পত্রিকার জন্ম হয়েছিল সে বাড়িতে আগে পরে অনেক সন্দেশীর জন্ম হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি
ছোটদের জন্য গুপ্তধনের মতো রায় পরিবারের লেখা। পুণ্যলতা চক্রবর্তীও তাঁদেরই একজন। তাঁর ছোটবেলায় বাবার উৎসাহে ছবি এঁকেছেন। জোর জবরদস্তি বা চোখ রাঙানো রছেলেবেলা নয়। বেশ মনোরম রঙিন ছোটবেলা কাটিয়েছেন পুণ্যলতা। বাবার কথাও লিখেছিলেন পুণ্যলতা তাঁর স্মৃতিকথায়—‘বাবার বেহালা বাজানোর প্রতি (রবীন্দ্রনাথ) অনুরাগী ছিলেন। প্রতি বছর জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেউৎসবের সময় বাবাকে নতুনগানের সঙ্গে বেহালা বাজাতে হত।’ পুণ্যলতার ছেলেবেলায় উপেন্দ্রকিশোর নিয়ম করে তাঁদের গানবাজনা করাতেন। অনেক ছাত্রছাত্রী এসে জুটত। তার উপর ছিল মন্দিরে উৎসবের গান, স্কুলে প্রাইজের গান, কত বিয়ে ও সভা সমিতির গান।’
কখনও মার্কিন কোনও ছাত্র মেঘমন্দ্র স্বরে —‘প্রভাটে বিমল আনন্ডে( প্রভাতে বিমল আনন্দে), সিকিমের কোনো ভদ্রলোকের তা তা থই থই, তা তা দই দই হয়ে যাওয়া, কংগ্রেসের গানের রিহার্সাল শুনতে শুনতে, একমন্ত্রে কর জপ, এক তনত্রে তপ’ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার স্মৃতি বড় সরস ভঙ্গিতে লিখেছিলেন পুণ্যলতা।
পুণ্যলতার শিশুসাহিত্যগুলি ছোটদের অমূল্য ভাণ্ডার।পুণ্যলতা এক সরস শিশুসাহিত্যিক। উপেন্দ্রকিশোরের মনটা তিনি সত্যি পেয়েছিলেন।
পুণ্যলতার শিশুসাহিত্যগুলি ছোটদের অমূল্য ভাণ্ডার।পুণ্যলতা এক সরস শিশুসাহিত্যিক। উপেন্দ্রকিশোরের মনটা তিনি সত্যি পেয়েছিলেন।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।