ছবি: প্রতীকী।
বনবাসের পথে, সারথি সুমন্ত্রকে আশ্বস্ত করে রামের এবার বন্ধুবর নিষাদরাজ গুহর কাছে বিদায় নেবার পালা। গুহকে জানালেন, স্বজনের সান্নিধ্যে বনবাস যথাযথ নয়। বিধিমতে আশ্রমবাস এখন তাঁর কর্তব্য। তাই পিতা, সীতা ও লক্ষ্মণের কল্যাণে নিয়মানুসারে তপস্বিজনের ভূষণ জটাধারী হয়ে অরণ্যে গমন করবেন। তাই বটগাছের ক্ষীর নিয়ে এস। জটাং কৃত্বা গমিষ্যামি ন্যগ্রোধক্ষীরমানয়। গুহ সত্বর বটক্ষীর এনে দিলেন। প্রস্তুত হল দু’ভায়ের জটা। চীরবসন ও জটায় সজ্জিত রামলক্ষ্মণ ঋষিতুল্য শোভা ধারণ করলেন। বৈখানস ঋষিদের ব্রত, বানপ্রস্ত ধর্ম অবলম্বন করে রাম সাহায্যকারী গুহকে বললেন, গুহর যেন সৈন্যবল, কোষ, দুর্গ ও জনপদবিষয়ে কোন ভ্রান্তি না হয়। কারণ,রাজ্যরক্ষা দুষ্কর কাজ। গুহর কাছে বিদায় নিয়ে উদ্বেগহীন রাম,সস্ত্রীক, ভাই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। গঙ্গাতীরে নৌকা প্রস্তুত।রামের নির্দেশানুসারে লক্ষ্মণ সীতাদেবীকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে আরোহণ করলেন।
শেষে নৌকায় আরোহী হলেন রাম। নিষাদরাজ গুহ তাঁর জ্ঞাতিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। রাম নৌযাত্রার সূচনায় হিতকামনায়, ক্ষত্রিয়োচিত বেদমন্ত্র জপ করতে লাগলেন। লক্ষ্মণ ও সীতা প্রফুল্লমনে আচমন করে নদীর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলেন। সুমন্ত্র ও গুহকে বিদায় জানিয়ে নাবিকদের নৌচালনার আদেশ দিলেন। কর্ণধারের সাহায্যে নাবিকদের চালনায় দ্রুতবেগে ছুটে চলল। নৌকা মাঝগঙ্গায় উপস্থিত হলে, কৃতাঞ্জলি হয়ে বৈদেহী সীতা, নদীর কাছে প্রার্থনা জানালেন, জ্ঞানী রাজা দশরথের পিতৃ আজ্ঞা পালনকারী পুত্রকে দেবী গঙ্গা যেন রক্ষা করেন। কথা দিলেন, বনবাসান্তে চোদ্দ বছর পরে ভায়ের সঙ্গে রাম ফিরে আসবেন যখন,তখন তিনি সানন্দচিত্তে দেবী গঙ্গার পূজা করবেন। ত্রিপথগামিনী ব্রহ্মলোক পরিব্যাপ্ত করে বিরাজমানা গঙ্গা এই পৃথিবীতে সাগরভার্যারূপে দৃশ্যমানা, হে শোভনে, দেবী গঙ্গাকে প্রণতি নিবেদন করি ও তাঁর স্তুতি করি। পুরুষোত্তম রাম ভালয় ভালয় ফিরে এসে রাজ্যলাভ করুন। সা ত্বাং দেবি নমস্যামি প্রশংসামি চ শোভনে।প্রাপ্তরাজ্যে নরব্যাঘ্রে শিবেন পুনরাগতে।।
শেষে নৌকায় আরোহী হলেন রাম। নিষাদরাজ গুহ তাঁর জ্ঞাতিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। রাম নৌযাত্রার সূচনায় হিতকামনায়, ক্ষত্রিয়োচিত বেদমন্ত্র জপ করতে লাগলেন। লক্ষ্মণ ও সীতা প্রফুল্লমনে আচমন করে নদীর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করলেন। সুমন্ত্র ও গুহকে বিদায় জানিয়ে নাবিকদের নৌচালনার আদেশ দিলেন। কর্ণধারের সাহায্যে নাবিকদের চালনায় দ্রুতবেগে ছুটে চলল। নৌকা মাঝগঙ্গায় উপস্থিত হলে, কৃতাঞ্জলি হয়ে বৈদেহী সীতা, নদীর কাছে প্রার্থনা জানালেন, জ্ঞানী রাজা দশরথের পিতৃ আজ্ঞা পালনকারী পুত্রকে দেবী গঙ্গা যেন রক্ষা করেন। কথা দিলেন, বনবাসান্তে চোদ্দ বছর পরে ভায়ের সঙ্গে রাম ফিরে আসবেন যখন,তখন তিনি সানন্দচিত্তে দেবী গঙ্গার পূজা করবেন। ত্রিপথগামিনী ব্রহ্মলোক পরিব্যাপ্ত করে বিরাজমানা গঙ্গা এই পৃথিবীতে সাগরভার্যারূপে দৃশ্যমানা, হে শোভনে, দেবী গঙ্গাকে প্রণতি নিবেদন করি ও তাঁর স্তুতি করি। পুরুষোত্তম রাম ভালয় ভালয় ফিরে এসে রাজ্যলাভ করুন। সা ত্বাং দেবি নমস্যামি প্রশংসামি চ শোভনে।প্রাপ্তরাজ্যে নরব্যাঘ্রে শিবেন পুনরাগতে।।
সীতা অঙ্গীকার করলেন, গঙ্গার আনন্দের জন্যে তখন তিনি ব্রাহ্মণদের শত সহস্র গরু, বস্ত্র ও উৎকৃষ্ট অন্ন দান করবেন। পুরীতে আবার ফিরে এসে সুরাপূর্ণ কলস, পলান্ন দিয়ে তিনি দেবী গঙ্গার প্রীতি সম্পাদন করবেন। তীরবর্তী দেবস্থান, তীর্থ ও পুণ্যক্ষেত্রে পূজা দেবেন। হে পাপনাশিনি গঙ্গা, নিষ্পাপ, মহাবাহু, রাম, আমায় ও লক্ষ্মণ ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বনবাস থেকে ফিরে আসুন। পুনরেব মহাবাহুর্ময়া ভ্রাত্রা চ সঙ্গতঃ। অযোধ্যাং বনবাসাত্তু প্রবিশত্বনঘোঽনঘে।। অনিন্দিতা সীতা এই ভাবে গঙ্গার সঙ্গে আলাপচারিতায় রত হয়ে অবিলম্বে পৌঁছে গেলেন গঙ্গার দক্ষিণতীরে। পুরুষোত্তম রাম সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে নৌকা ছেড়ে রওনা দিলেন দক্ষিণ অভিমুখে। রাম লক্ষ্মণকে বললেন, জনবহুল বা জনহীন যে কোনও স্থানে, বিশেষভাবে এই বিজন বনে রক্ষাকার্যে আমাদের তৎপর থাকতে হবে। তুমি অগ্রসর হও,দেবী সীতা তোমার অনুগমন করুন, তোমাদের খেয়াল রেখে আমি বরং পিছন থেকে তোমাদের দুজনকে অনুসরণ করি। এখন আমাদের একে অপরকে রক্ষা করতে হবে। অগ্রত গচ্ছ সৌমিত্রে সীতা ত্বামনুগচ্ছতু।। পৃষ্ঠতোঽনুগমিষ্যামি সীতাং ত্বাঞ্চানুপালয়ন্। অন্যোন্যস্য হি নো রক্ষা কর্ত্তব্যা পুরুষর্ষভ।।
এখনও পর্যন্ত দুষ্কর কোন কাজ করতে হয়নি। এখন থেকে সীতা, বিদেহনন্দিনী বনবাসের কষ্ট ভোগ উপলব্ধি করতে পারবেন। এই লোকালয়বর্জিত স্থান, খেত ও উপবনহীন, সমভূমি যেখানে বিরল, সব জায়গা গভীর গর্তে ভরা অরণ্য, এখন তিনি সেখানে প্রবেশ করবেন। রামের নির্দেশানুসারে সকলে এগিয়ে চললেন। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় সুমন্ত্র রামের দিকে অপলকে চেয়ে রইলেন। দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন যখন রাম, সুমন্ত্র ব্যথিতহৃদয়ে, কাঁদতে শুরু করলেন। লোকপালতুল্য প্রভাবশালী মহান বরদ রাম, মহানদী গঙ্গা অতিক্রম করে কিছুদূর এগিয়ে শস্যসমৃদ্ধ বৎসদেশে অচিরেই প্রবেশ করলেন। সেখানে দুই ভাই মিলে ঋষ্য, পৃষত, রুরু ও বরাহ এই চার রকমের হরিণ বধ করলেন। ক্ষুধায় কাতর তাঁরা, হরিণের মাংসে উদরপূর্তি করে সন্ধ্যায় আশ্রয়ের জন্যে এক বনস্পতির কাছে গেলেন।
এখনও পর্যন্ত দুষ্কর কোন কাজ করতে হয়নি। এখন থেকে সীতা, বিদেহনন্দিনী বনবাসের কষ্ট ভোগ উপলব্ধি করতে পারবেন। এই লোকালয়বর্জিত স্থান, খেত ও উপবনহীন, সমভূমি যেখানে বিরল, সব জায়গা গভীর গর্তে ভরা অরণ্য, এখন তিনি সেখানে প্রবেশ করবেন। রামের নির্দেশানুসারে সকলে এগিয়ে চললেন। যতদূর পর্যন্ত দেখা যায় সুমন্ত্র রামের দিকে অপলকে চেয়ে রইলেন। দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন যখন রাম, সুমন্ত্র ব্যথিতহৃদয়ে, কাঁদতে শুরু করলেন। লোকপালতুল্য প্রভাবশালী মহান বরদ রাম, মহানদী গঙ্গা অতিক্রম করে কিছুদূর এগিয়ে শস্যসমৃদ্ধ বৎসদেশে অচিরেই প্রবেশ করলেন। সেখানে দুই ভাই মিলে ঋষ্য, পৃষত, রুরু ও বরাহ এই চার রকমের হরিণ বধ করলেন। ক্ষুধায় কাতর তাঁরা, হরিণের মাংসে উদরপূর্তি করে সন্ধ্যায় আশ্রয়ের জন্যে এক বনস্পতির কাছে গেলেন।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
মহীরুহতলে সান্ধ্য কর্তব্য সমাপন করে, আনন্দদানে অগ্রগণ্য রাম, লক্ষ্মণকে অভয় দিয়ে বললেন, জনপদের বাইরে সুমন্ত্রহীন আজ প্রথম রাত্রিযাপন। সেই কারণে উদ্বেগের কোন কারণ নেই।আজ থেকে আলস্যহীন তন্দ্রাহীন বিনিদ্র রাত্রিযাপন শুরু হল। কারণ দেবী সীতার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দু’জনার। জাগর্ত্তব্যমতন্দ্রিভ্যামদ্যপ্রভৃতি রাত্রিষু। যোগক্ষেমৌ হি সীতায়া বর্ত্তেতে লক্ষ্মণাবয়োঃ।। তিনি স্বয়ং, সংগৃহীত যা কিছু সামগ্রী দিয়ে শয্যা প্রস্তুত করলেন। সেই শয্যায় শয়ন করেই কেটে যাবে রাত। যাঁর মহা মূল্যবান শয্যায় শয়নের অভ্যাস,আজ মাটিতে বসে তিনি মনের আশঙ্কা প্রকাশ করলেন লক্ষ্মণের কাছে। রাজা দশরথ নিশ্চয়ই কষ্টে শয়ন করেছেন। রাজ্যলাভে সফলমনোরথ দেবী কৈকেয়ী সন্তুষ্ট হয়েছেন।
ভরতকে দেখে তিনি মহারাজের প্রাণহানি করবেন না হয়তো। অসহায় এবং বৃদ্ধ রাজার পাশে রাম স্বয়ং নেই, কামের বশীভূত রাজা, কৈকেয়ীর বশংবদ, তিনি আর কীই বা করবেন? রাজার এই বিপন্ন অবস্থা ও বিভ্রান্ত বুদ্ধি এই দুইয়ে মিলে রামের উপলব্ধি—অর্থ ও ধর্মের সঙ্গে তুলনায় কামই প্রধান। পিতার সমালোচনায় মুখর রাম। তাঁর মতে, কে এমন মূঢ় ব্যক্তি আছেন যিনি পত্নীর কারণে আমার তুল্য অনুগত পুত্রকে ত্যাগ করতে পারেন? কো হ্যবিদ্বানপি পুমান্ প্রমদায়াঃ কৃতে ত্যজেৎ। ছন্দানুবর্ত্তিনং পুত্রং তাতো মামিব লক্ষ্মণ।। কৈকেয়ীপুত্র ভরতই সস্ত্রীক সুখী মানুষ, যিনি একাকী অধিরাজতুল্য এই স্ফীত সাম্রাজ্য ভোগ করবেন। ভরত একচ্ছত্র রাজ্যসুখ ভোগ করবেন। কারণ, পিতা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, রাম নিজে অরণ্যবাসী হয়েছেন। যিনি ধর্ম ও অর্থ পরিত্যাগ করে শুধু কামনার বশবর্তী হন দ্রুত, তাঁর দশা হয় ঠিক ওই রাজা দশরথের মতো। রাজা দশরথের মৃত্যু, রামের প্রব্রজ্যা, ভরতের রাজ্যলাভ—এই সবকিছুর জন্যেই দেবী কৈকেয়ীর আবির্ভাব।
ভরতকে দেখে তিনি মহারাজের প্রাণহানি করবেন না হয়তো। অসহায় এবং বৃদ্ধ রাজার পাশে রাম স্বয়ং নেই, কামের বশীভূত রাজা, কৈকেয়ীর বশংবদ, তিনি আর কীই বা করবেন? রাজার এই বিপন্ন অবস্থা ও বিভ্রান্ত বুদ্ধি এই দুইয়ে মিলে রামের উপলব্ধি—অর্থ ও ধর্মের সঙ্গে তুলনায় কামই প্রধান। পিতার সমালোচনায় মুখর রাম। তাঁর মতে, কে এমন মূঢ় ব্যক্তি আছেন যিনি পত্নীর কারণে আমার তুল্য অনুগত পুত্রকে ত্যাগ করতে পারেন? কো হ্যবিদ্বানপি পুমান্ প্রমদায়াঃ কৃতে ত্যজেৎ। ছন্দানুবর্ত্তিনং পুত্রং তাতো মামিব লক্ষ্মণ।। কৈকেয়ীপুত্র ভরতই সস্ত্রীক সুখী মানুষ, যিনি একাকী অধিরাজতুল্য এই স্ফীত সাম্রাজ্য ভোগ করবেন। ভরত একচ্ছত্র রাজ্যসুখ ভোগ করবেন। কারণ, পিতা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, রাম নিজে অরণ্যবাসী হয়েছেন। যিনি ধর্ম ও অর্থ পরিত্যাগ করে শুধু কামনার বশবর্তী হন দ্রুত, তাঁর দশা হয় ঠিক ওই রাজা দশরথের মতো। রাজা দশরথের মৃত্যু, রামের প্রব্রজ্যা, ভরতের রাজ্যলাভ—এই সবকিছুর জন্যেই দেবী কৈকেয়ীর আবির্ভাব।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?
ইদানীং সৌভাগ্যজনিত মত্ততায় তিনি রামের কারণেই দেবী কৌশল্যা ও সুমিত্রাকে হেনস্থা করতে পারেন। তাই শুধুমাত্র এই কারণেই দেবী সুমিত্রা কষ্ট পাবেন। তাই হে লক্ষ্মণ, এখনই এখান থেকেই অযোধ্যায় ফিরে যাও। অযোধ্যানিত এব ত্বং কালে প্রবিশ লক্ষ্মণ।
রাম গভীর প্রত্যয়ে বললেন তিনি একাকী সস্ত্রীক দণ্ডকবনে যাবেন। মা কৌশল্যা যে একেবারে অসহায়, অনাথা রমণী তিনি, লক্ষ্মণকে পেয়ে সনাথা হবেন। লক্ষ্মণের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন রাম—হে ধর্মজ্ঞ, নীচকাজে যাঁর রুচি, সেই দেবী কৈকেয়ী, বিদ্বেষবশে অন্যায় আচরণ করতে পারেন।তিনি আমাদের দুজনের মাকে বিষ পর্যন্ত দিতে পারেন। ক্ষুদ্রকর্ম্মা হি কৈকেয়ী দ্বেষাদন্যায়মাচরেৎ।পরিদদ্যাদ্ধি ধর্ম্মজ্ঞ গরং তে মম মাতরম্।। গভীর পরিতাপে বলে উঠলেন রাম, জন্মান্তরে জননী নিশ্চয়ই বহু নারীর পুত্রবিচ্ছেদের কারণ ছিলেন, সেই জন্যেই তাঁর আজ এই দশা। নিজেকে ধিক্কার দিলেন রাম এই বলে যে,দেবী কৌশল্যা,লালন পালন করে, কষ্ট করে বড় করে তুললেন পুত্রকে, আর ছি ছি, তিনি কিনা মায়ের এই শ্রমের ফললাভের সময়ে বিদায় নিলেন। হে সুমিত্রানন্দন, আমি যেমন মাকে অন্তহীন দুঃখ দিলাম কোন মা যেন এমন দুঃখদায়ক পুত্রের জন্ম না দেয় মা স্ম সীমন্তিনী কাচিজ্জনয়েৎ পুত্রমীদৃশম্। সৌমিত্রে যোঽহমম্বায়া দদ্মি শোকমনন্তকম্।।
রাম মনে করেন সেই পোষা শুকপাখীটিরও রামের তুলনায় মায়ের প্রতি বেশী ভালবাসা আছে। কারণ, শোনা যায়, সেও শুককে বলে, “যাও শত্রুর পায়েতে দংশন কর।” শুক পাদমরের্দ্দশ। দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাম। তিনি পুত্র হয়ে শোকাকুলা হতভাগিনী মায়ের কী উপকার করলেন? মা যে পুত্র থাকা সত্ত্বেও পুত্রহীনার তুল্যা। মায়ের মন্দভাগ্য, তাই তিনি পুত্রবিচ্ছেদে পরম দুঃখার্ত অবস্থায় শোকসাগরে শায়িতা। ক্ষোভে দুঃখে কাতর রাম। লক্ষ্মণের কাছে তাঁর প্রবল মনোবেদনা ব্যক্ত করলেন।
রাম গভীর প্রত্যয়ে বললেন তিনি একাকী সস্ত্রীক দণ্ডকবনে যাবেন। মা কৌশল্যা যে একেবারে অসহায়, অনাথা রমণী তিনি, লক্ষ্মণকে পেয়ে সনাথা হবেন। লক্ষ্মণের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন রাম—হে ধর্মজ্ঞ, নীচকাজে যাঁর রুচি, সেই দেবী কৈকেয়ী, বিদ্বেষবশে অন্যায় আচরণ করতে পারেন।তিনি আমাদের দুজনের মাকে বিষ পর্যন্ত দিতে পারেন। ক্ষুদ্রকর্ম্মা হি কৈকেয়ী দ্বেষাদন্যায়মাচরেৎ।পরিদদ্যাদ্ধি ধর্ম্মজ্ঞ গরং তে মম মাতরম্।। গভীর পরিতাপে বলে উঠলেন রাম, জন্মান্তরে জননী নিশ্চয়ই বহু নারীর পুত্রবিচ্ছেদের কারণ ছিলেন, সেই জন্যেই তাঁর আজ এই দশা। নিজেকে ধিক্কার দিলেন রাম এই বলে যে,দেবী কৌশল্যা,লালন পালন করে, কষ্ট করে বড় করে তুললেন পুত্রকে, আর ছি ছি, তিনি কিনা মায়ের এই শ্রমের ফললাভের সময়ে বিদায় নিলেন। হে সুমিত্রানন্দন, আমি যেমন মাকে অন্তহীন দুঃখ দিলাম কোন মা যেন এমন দুঃখদায়ক পুত্রের জন্ম না দেয় মা স্ম সীমন্তিনী কাচিজ্জনয়েৎ পুত্রমীদৃশম্। সৌমিত্রে যোঽহমম্বায়া দদ্মি শোকমনন্তকম্।।
রাম মনে করেন সেই পোষা শুকপাখীটিরও রামের তুলনায় মায়ের প্রতি বেশী ভালবাসা আছে। কারণ, শোনা যায়, সেও শুককে বলে, “যাও শত্রুর পায়েতে দংশন কর।” শুক পাদমরের্দ্দশ। দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাম। তিনি পুত্র হয়ে শোকাকুলা হতভাগিনী মায়ের কী উপকার করলেন? মা যে পুত্র থাকা সত্ত্বেও পুত্রহীনার তুল্যা। মায়ের মন্দভাগ্য, তাই তিনি পুত্রবিচ্ছেদে পরম দুঃখার্ত অবস্থায় শোকসাগরে শায়িতা। ক্ষোভে দুঃখে কাতর রাম। লক্ষ্মণের কাছে তাঁর প্রবল মনোবেদনা ব্যক্ত করলেন।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি
ক্রুদ্ধ রাম একাকী শুধু অযোধ্যা কেন? সমগ্র পৃথিবী বাণের সাহায্যে করায়ত্ত করতে পারেন।তাঁর শৌর্য আজ বিফল। কারণ ওই অধর্মাচরণের ভয়। আর পরলোকের ভয়তো আছেই। তাই তাঁর রাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার ইচ্ছে নেই। অধর্ম্মভয়ভীতশ্চ পরলোকস্য চানঘ।তেন লক্ষ্মণ নাদ্যাহমাত্মানমভিষেচয়ে।। নির্জন অরণ্যে দীনহীনের মতো এমন বহু করুণ বিলাপের পরে চোখভরা জল নিয়ে নীরব হলেন। সেই নিষ্প্রভ আগুন এবং নির্বেগ সমুদ্রের তুল্য রামকে লক্ষ্মণ আশ্বস্ত করলেন। অবশ্যই রামের অভাবে, এখন চাঁদবিহীন রাত্রিসদৃশ হয়েছে ঔজ্জ্বল্যহীন অযোধ্যা নগরী। লক্ষ্মণ কষ্টে উচ্চারণ করলেন, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি যেভাবে পরিতাপ করছেন তার ফলে আমি ও দেবী সীতা দু’জনেই ঘোর বিষাদাক্রান্ত হয়েছি। এ আপনার উচিত কাজ নয়। নৈতদৌপায়িকং রাম যদিদং পরিতপ্যসে। বিষাদয়সি সীতাঞ্চ মাঞ্চৈব পুরুষর্ষভ।।
লক্ষ্মণ সীতা ও তাঁর নিজের জীবনে রামের অপরিহার্য উপস্থিতির গুরত্ব বোঝাবার জন্য বললেন, রামের বিরহে জলহীন মাছের মতো দু’জনের, এক মুহূর্ত বেঁচে থাকাই অসম্ভব। মুহূর্ত্তমপি জীবাবো জলান্মৎস্যাবিবোদ্ধৃতৌ। লক্ষ্মণ পরন্তপ রামকে জানালেন,রাম ব্যতীত পিতা, ভাই শত্রুঘ্ন, মা সুমিত্রা, এমন কি স্বর্গদর্শনেও তাঁর কোনও ইচ্ছাই নেই। কথা শেষ হল। অদূরে রাম ও সীতাকে সুখে অবস্থান করতে দেখে বটগাছের তলে পর্ণশয্যায় শায়িত হলেন লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণ সীতা ও তাঁর নিজের জীবনে রামের অপরিহার্য উপস্থিতির গুরত্ব বোঝাবার জন্য বললেন, রামের বিরহে জলহীন মাছের মতো দু’জনের, এক মুহূর্ত বেঁচে থাকাই অসম্ভব। মুহূর্ত্তমপি জীবাবো জলান্মৎস্যাবিবোদ্ধৃতৌ। লক্ষ্মণ পরন্তপ রামকে জানালেন,রাম ব্যতীত পিতা, ভাই শত্রুঘ্ন, মা সুমিত্রা, এমন কি স্বর্গদর্শনেও তাঁর কোনও ইচ্ছাই নেই। কথা শেষ হল। অদূরে রাম ও সীতাকে সুখে অবস্থান করতে দেখে বটগাছের তলে পর্ণশয্যায় শায়িত হলেন লক্ষ্মণ।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৭: নৃপেনবাবুকে বহিষ্কার, ইতিহাসের করুণ পরিণতি
লক্ষ্মণের অপূর্ব যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে লক্ষ্মণকে, বনবাসের তপস্বীদের যোগ্য সুদীর্ঘ চোদ্দ বছরের বনবাসজীবনে বানপ্রস্থধর্ম সাদরে অনুমোদন করলেন। এর পর থেকে, সেই বিজন বনে,রঘুকুলের সমৃদ্ধির কারণ রাম ও লক্ষ্মণ, যেন পর্বতে বিচরণকারী দুই সিংহসদৃশ হয়ে আর ভীত ও উদ্বিগ্ন বোধ করলেন না।
চোদ্দ বছরের বনবাসজীবনে, রামচন্দ্র, প্রকৃত অর্থেই অরণ্যবাসী তপস্বী হতে চেয়েছেন। নামমাত্র সন্ন্যাসীর ভেক ধারণ করায় তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। ইচ্ছে করলে সেটি অসম্ভব ছিল না। গুহর আতিথেয়তা স্বীকার করেননি। রাজার দুলাল রাত কাটিয়েছেন পর্ণশয্যায় তরুমূলে। দূর্বাদলশ্যাম রাম বটগাছের ক্ষীর নিজের চুলে মেখে জটাধারী হয়েছেন। বনবাসী ঋষির সাজে সেজেছেন। এ সাজে নেই বিলাসিতার ছোঁয়া,আছে শুধু নিজের রাজকীয় মোহমুক্তির গৈরিক ঔদাসীন্য। তাঁর বেশ তপস্বীর কিন্তু পূর্বাশ্রমের অভিজ্ঞতা তাঁর রক্তে। তাই বন্ধুবর গুহকে, রাজোচিত বিভ্রান্তিগুলি অতিক্রমের পরামর্শ দিতে দ্বিধা বোধ করেননি। বন্ধুত্বের ঋণ কী অস্বীকার করা যায়?
নদীপথে রামের নিষ্ক্রমণ। মাতৃসমা গঙ্গা বয়ে নিয়ে চলে একাধারে ভারতীয় লৌকিক ও আধ্যাত্মিক জীবন ও যাপন। নদীর সম্মতির প্রয়োজন। নদীমাতৃক দেশে নদী যে জননী। গঙ্গার কাছে নত হয়েছেন রাম সীতা উভয়েই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বনবাস জীবনের সূচনায়। তরুমূলে শয়ন, বটক্ষীরে সজ্জার বিন্যাস, গঙ্গার উদ্দেশ্যে স্বামী স্ত্রীর প্রণতি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা, এগুলি সবই যেন অপরিসীম শক্তির আধার প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। সরলা সীতা গঙ্গার কাছে নানা প্রতিশ্রুতির অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন, হয়তো পরম্পরাগত চিরন্তন ঐতিহ্যে নদীর কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার ছিল দেবী সীতার এই আচরণে।
চোদ্দ বছরের বনবাসজীবনে, রামচন্দ্র, প্রকৃত অর্থেই অরণ্যবাসী তপস্বী হতে চেয়েছেন। নামমাত্র সন্ন্যাসীর ভেক ধারণ করায় তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। ইচ্ছে করলে সেটি অসম্ভব ছিল না। গুহর আতিথেয়তা স্বীকার করেননি। রাজার দুলাল রাত কাটিয়েছেন পর্ণশয্যায় তরুমূলে। দূর্বাদলশ্যাম রাম বটগাছের ক্ষীর নিজের চুলে মেখে জটাধারী হয়েছেন। বনবাসী ঋষির সাজে সেজেছেন। এ সাজে নেই বিলাসিতার ছোঁয়া,আছে শুধু নিজের রাজকীয় মোহমুক্তির গৈরিক ঔদাসীন্য। তাঁর বেশ তপস্বীর কিন্তু পূর্বাশ্রমের অভিজ্ঞতা তাঁর রক্তে। তাই বন্ধুবর গুহকে, রাজোচিত বিভ্রান্তিগুলি অতিক্রমের পরামর্শ দিতে দ্বিধা বোধ করেননি। বন্ধুত্বের ঋণ কী অস্বীকার করা যায়?
নদীপথে রামের নিষ্ক্রমণ। মাতৃসমা গঙ্গা বয়ে নিয়ে চলে একাধারে ভারতীয় লৌকিক ও আধ্যাত্মিক জীবন ও যাপন। নদীর সম্মতির প্রয়োজন। নদীমাতৃক দেশে নদী যে জননী। গঙ্গার কাছে নত হয়েছেন রাম সীতা উভয়েই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে বনবাস জীবনের সূচনায়। তরুমূলে শয়ন, বটক্ষীরে সজ্জার বিন্যাস, গঙ্গার উদ্দেশ্যে স্বামী স্ত্রীর প্রণতি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা, এগুলি সবই যেন অপরিসীম শক্তির আধার প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। সরলা সীতা গঙ্গার কাছে নানা প্রতিশ্রুতির অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন, হয়তো পরম্পরাগত চিরন্তন ঐতিহ্যে নদীর কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধতা পালনের অঙ্গীকার ছিল দেবী সীতার এই আচরণে।
ছবি: প্রতীকী।
গভীর বিজন বনে স্ত্রীর সুরক্ষায় কতটা যত্নবান রাম,তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তে তিনি তা প্রমাণ করেছেন, যার সঙ্গে ভাবিকালের প্রশাসক রামকে মিলিয়ে নিতে কষ্ট হয়। নির্জন বনে বানপ্রস্থ অবলম্বনে উদার মুক্তমনা রাম ও নির্মম প্রশাসক রাম—দুই জীবনেই দাম্পত্যের বন্ধন ছিল। প্রশাসনিক দায়িত্ববোধের কঠোরতা হয়তো প্রকৃত বিবেকবান প্রশাসককে, নিজের পারিবারিক জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতা ভুলিয়ে দেয়। বিরাট পরিসরে পরিব্যাপ্ত জনজীবন তাঁর কাছে প্রধান হয়ে ওঠে নিশ্চয়ই। প্রশাসক রামের সিদ্ধান্ত তার প্রমাণ।
অভিমানী পুত্র, পিতার সমালোচনা করেছেন মনে গভীর দুঃখ নিয়ে। ধর্ম, অর্থ, কাম তিনটির সমদর্শিতাকে পুরুষার্থের নিয়ামক বলে তিনি মনে করেননি। তাঁর বিবেচনায়, পিতার কামাসক্তির বশে সুন্দরী পত্নী প্রীতিই ধর্মবোধ বিসর্জনের কারণ। অনুগত পুত্রকে ত্যাগ—তিনি মেনে নিতে পারেননি। মনের কোথাও গভীর ক্ষত ছিল, বনবাসজীবনের কঠোর অভিঘাতে সেটিতে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। এমনটাই যে স্বাভাবিক। মানুষের অবদমিত ক্ষোভ,দুঃখ যখন প্রকট হয় তখনই যে সম্পর্কের কাটা ছেঁড়া শুরু হয়। রাম লৌকিক চরিত্র। তাঁর মানবিক স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি,দুঃখদীর্ণ প্রগাঢ় অভিমানবোধ, সবকিছুই তাঁকে সমবেদনার পাত্র করে তুলেছে। তাঁর ঐশ্বরিক ভাবমূর্তি তখন মনে থাকেনি, মনে থেকেছে বিমাতার চক্রান্তের শিকার বঞ্চিত এক রাজকুমারকে।
তাঁর অনুপস্থিতে মায়ের দুর্গতির সম্ভাবনায় ব্যাকুল হয়েছেন রাম। মায়ের প্রাণহানির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন রাম, প্রাণপ্রিয় ভাই লক্ষ্মণকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন। রাম সব দুঃখ উজার করেছেন লক্ষ্মণের কাছে।দুঃখের গভীরে প্রচ্ছন্ন ধর্মবোধ যা বিবেকচেতনা, তাঁর যত নাস্ত্যর্থক চিন্তা সব মুছে দিয়ে আলোকবর্তিকা হয়ে তাঁকে পথ দেখিয়েছে।
বনবাসজীবনের প্রারম্ভিক কঠোরতা রামের পিতৃভক্তি,পিতৃশর্ত পালনের অঙ্গীকার সাময়িকভাবে মুছে দিয়েছিল হয়তো। তিনি দেবতা নন, মানুষ রাম। মানুষই বঞ্চিত হয়ে,জীবনের প্রতিকূলতা মেনে নিতে কষ্ট পান, পিতামাতার সমালোচনায় বিরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধা বোধ করেন না, অবশেষে চোখের জলে ভেসে প্রিয়জনের কাছে মনের যত সংক্ষোভ উজার করে শান্তি পান। জীবনে এমনটাই স্বাভাবিক। তাই অতিমানবের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন পুরুষ রাম,যিনি উত্তম পুরুষের তকমায় ডূষিত হয়ে ‘পুরুষোত্তম’ হন যুগান্তরে,তাঁর অপরিসীম ধর্মবোধের কারণে।—চলবে।
অভিমানী পুত্র, পিতার সমালোচনা করেছেন মনে গভীর দুঃখ নিয়ে। ধর্ম, অর্থ, কাম তিনটির সমদর্শিতাকে পুরুষার্থের নিয়ামক বলে তিনি মনে করেননি। তাঁর বিবেচনায়, পিতার কামাসক্তির বশে সুন্দরী পত্নী প্রীতিই ধর্মবোধ বিসর্জনের কারণ। অনুগত পুত্রকে ত্যাগ—তিনি মেনে নিতে পারেননি। মনের কোথাও গভীর ক্ষত ছিল, বনবাসজীবনের কঠোর অভিঘাতে সেটিতে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। এমনটাই যে স্বাভাবিক। মানুষের অবদমিত ক্ষোভ,দুঃখ যখন প্রকট হয় তখনই যে সম্পর্কের কাটা ছেঁড়া শুরু হয়। রাম লৌকিক চরিত্র। তাঁর মানবিক স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি,দুঃখদীর্ণ প্রগাঢ় অভিমানবোধ, সবকিছুই তাঁকে সমবেদনার পাত্র করে তুলেছে। তাঁর ঐশ্বরিক ভাবমূর্তি তখন মনে থাকেনি, মনে থেকেছে বিমাতার চক্রান্তের শিকার বঞ্চিত এক রাজকুমারকে।
তাঁর অনুপস্থিতে মায়ের দুর্গতির সম্ভাবনায় ব্যাকুল হয়েছেন রাম। মায়ের প্রাণহানির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন রাম, প্রাণপ্রিয় ভাই লক্ষ্মণকে ফিরে যেতে অনুরোধ করেছেন। রাম সব দুঃখ উজার করেছেন লক্ষ্মণের কাছে।দুঃখের গভীরে প্রচ্ছন্ন ধর্মবোধ যা বিবেকচেতনা, তাঁর যত নাস্ত্যর্থক চিন্তা সব মুছে দিয়ে আলোকবর্তিকা হয়ে তাঁকে পথ দেখিয়েছে।
বনবাসজীবনের প্রারম্ভিক কঠোরতা রামের পিতৃভক্তি,পিতৃশর্ত পালনের অঙ্গীকার সাময়িকভাবে মুছে দিয়েছিল হয়তো। তিনি দেবতা নন, মানুষ রাম। মানুষই বঞ্চিত হয়ে,জীবনের প্রতিকূলতা মেনে নিতে কষ্ট পান, পিতামাতার সমালোচনায় বিরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধা বোধ করেন না, অবশেষে চোখের জলে ভেসে প্রিয়জনের কাছে মনের যত সংক্ষোভ উজার করে শান্তি পান। জীবনে এমনটাই স্বাভাবিক। তাই অতিমানবের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন পুরুষ রাম,যিনি উত্তম পুরুষের তকমায় ডূষিত হয়ে ‘পুরুষোত্তম’ হন যুগান্তরে,তাঁর অপরিসীম ধর্মবোধের কারণে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।