ছবি: প্রতীকী।
মিত্রভেদ
সেই বানরদের এই সব ব্যর্থ প্রয়াস দেখে সেই সূচীমুখ পাখিটি তাদের বলল, তোমরা তো দেখছি সকলেই মূর্খের মতন কাজকর্ম করছো। এইগুলো তো অগ্নিকণা নয়, এগুলো হল লাল গুঞ্জাফল। তাই এগুলো দিয়ে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করাটা একেবারেই বৃথা। এইটা দিয়ে তোমারা শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। বরং গভীর বনের মধ্যে যাও, সেখানে কোনও গুহা বা পাহাড়ের আড়াল খোঁজ করো গিয়ে। এখনও মেঘের গর্জন যা চেহারা দেখছি তাতে তো বৃষ্টি আরও অনেক সময় ধরে চলবে বলেই মনে হয়।
ব্যাপারটা হল বার বার কোনও একটা কাজ করতে গিয়ে যে ব্যক্তি অসফল হয়েছে কিংবা যে জুয়াড়ি খেলায় হেরে গিয়েছে তাদের দুজনের মানসিক অবস্থাটা সেই সময়ে একই রকম থাকে। সেই সময় তাদের ভালো চেয়ে তখনই কিছু বলতে নেই। বুদ্ধিমান লোকেরা সেই সময়ে তাদের কোনও উপদেশ দেয় না। শুধু কি তাই? পণ্ডিতেরা আরও বলেছেন, যে ব্যক্তির পেশা শিকার করা, যার বহু পরিশ্রম ব্যর্থ হয়েছে, যে মূর্খ কিংবা মদ-পাশা প্রভৃতি কোনও না কোনও ব্যসনে আসক্ত—তার সঙ্গে বার্তালাপ করাটাই বোকামি। তাতে শুধু বক্তাকে অপমানিতই হতে হয় কেবল—ভালো কথা তাদের কানে ঢোকে না।
আলাপযতি যো মূঢঃ স গচ্ছতি পরাভবম্।। (মিত্রভেদ ৪১৯)
সেই নির্বুদ্ধি বানরগুলো সূচীমুখ পাখিটিকে এভাবে অপমান করলেও পাখিটি কিন্তু নাছোড়বান্দা। বারে বারে সে ও বানরগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে মনে করিয়ে দিতে লাগলো যে এ ভাবে আগুন জ্বলে না, তারা বৃথা পরিশ্রম করছে। এতে কোনও লাভ হবে না।
এইভাবে পাখিটি যখন কোনও ভাবেই চুপ করছিল না, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃথা পরিশ্রমে ব্যর্থ হতে হতে সেই বানরদলগুলো তার উপর ভীষণভাবে রেগে গেল। সেই সময়ে, সেই দলের মধ্যে থেকে একটা অতিকায় বানর বেরিয়ে এসে সেই গাছে উঠে সূচীমুখ পাখিটির ডানাদুটো ধরে নামিয়ে একটা শক্ত পাথরের উপর পিটিয়ে পিটিয়ে তাকে হত্যা করল।
১৭ কাহিনি সমাপ্ত
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৭: মূর্খকে উপদেশ দিলে সেটা তার রাগের কারণ হয়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা
পযঃপানং ভুজঙ্গানাং কেবলং বিষবর্ধনম্।। (ঐ, ৪২০)
সাপকে যেমন দুধকলা খাওয়ালেও সে পোষ মানে না; সেগুলো শুধু তাদের বিষবৃদ্ধিই কারণ হয় মাত্র। ঠিক তেমনই উপদেশ মূর্খদের শান্ত করে না। বরং উপদেশ দিলে মূর্খরা রেগে যায়। তাই তোমার মতন মূর্খদের কোনও উপদেশ না দেওয়াই উচিত। লোকে ঠিকই বলে—
পশ্য বানরমূর্খেণ সুগৃহী নির্গৃহীকৃতঃ।। (ঐ, ৪২১)
যাকে তাকে উপদেশ দিতে নেই একেবারেই; দেখো না! উপদেশ দেওয়ার জন্যই তো সেই উত্তম-গৃহস্থ পাখিটি, যে ঘর বানিয়ে নিশ্চিন্তে গাছে বাস করতো, একটা মূর্খ বানর কেমন করে তাকে গৃহহীন করে দিয়েছিল।
দমনক বলল— এ ঘটনাটা আবার কেমন— “কথমেতৎ?
করটক তখন বলতে শুরু করল।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫২: দেশহিতৈষী মা সারদা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?
১৮: এক চড়ুই-দম্পতি আর বানরের গল্প
কোনও এক গভীর বনে এক বিশাল শমীবৃক্ষ ছিল। তার ছায়াঘন বিশাল শাখায় এক চড়ুই-দম্পতি বাস করতো। তারা বেশ সুখেই সেই শমীবৃক্ষের শাখায় বাস করতো। ক্রমে একদিন হেমন্তকাল উপস্থিত হল। মেঘবর্ষণও শুরু হল মৃদু মন্দ ছন্দে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির তেজ বাড়তে শুরু করল আর ঠিক সেই সময়েই কোথা থেকে এক দলছুট বানর ঠান্ডায় জলে ভিজে কাঁপতে এসে সেই শমীবৃক্ষের নিচে এসে উপস্থিত হল। ঠান্ডায় তার দাঁতে দাঁতে তখন কাঁপুনি লেগে যাচ্ছে। গাছের উপর থেকে সেই বানরটিকে দেখে খুবই মায়া হলো স্ত্রী-চড়ুইটির। সে বলল, তোমার তো ভাই হাত-পা আছে; হাবে-ভাবে তো একেবারেই তুমি মানুষেরই মতন। তাহলে এইরকম ঠাণ্ডায় বৃষ্টির মধ্যে এভাবে কেন কষ্ট পাচ্ছো? ওরে মূর্খ! একটা ঘর বানাতে পারো না? আমাদের তো তোমার মতন হাত-পা নেই। তাও দেখো ঘর বানিয়ে একটা মাথা গোঁজার জায়গা তো অন্তত আমরা তৈরি করতে পেরেছি।
স্ত্রী-চড়ুইটির মুখে একথা শুনে সেই বানরটি ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল, ওরে অধম! মুখটা এ বার একটু বন্ধ কর; মৌনব্রত অবলম্বন কর। ধাষ্টামোটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে মজা করবার সাহস হয় কী করে?
মনে মনে সে চিন্তা করলো, দূরাচারী এই ধূর্ত পাখিটা নিজেকে পণ্ডিত মনে করে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। একে শায়েস্তা করাটা দরকার।
স্ত্রী-চড়ুইটিকে বলল— ওহে বোকা! আমাকে নিয়ে তোর এতো চিন্তা করবার কিছু নেই।
শাস্ত্রে বলে—
প্রোক্তং শ্রদ্ধাবিহীনস্য অরণ্যরুদিতোপমম্।। (ঐ, ৪২৪)
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি
স্ত্রী-চড়ুইটি সেই অরণ্যেই রোদন করছিল। ফলে তার ফলও হলো বিপরীত। যে মুহূর্তে সে আবার সেই বানরটিকে উপদেশ দিতে গেলো সেই বানরটি শমীবৃক্ষে উঠে সেই চড়ুই-দম্পতির বাসাটা গাছের থেকে মাটিতে ফেলে খণ্ডবিখণ্ড করে দিল।
১৮শ কাহিনি সমাপ্ত
করটক বলল, এই জন্যেই আমি বলেছিলাম উপদেশ দেওয়াটা সব সময়ে উচিত নয়।
এই প্রসঙ্গে একটা ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। আপনারা হয়তো জানেন যে পঞ্চতন্ত্র প্রাচীন ভারতের অন্যতম একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ছিল। ইরাণে সাসানীয় সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সম্রাট প্রথম খশরু [Khosrow I Anushirvan (531 – 579 CE)] , যিনি পরম্পরাগতভাবে যেখানে অনুশির্বন্ নামে পরিচিত ছিলেন তাঁর আদেশে ইরাণীয় চিকিত্সক বুর্জোঁয়ে ভারতবর্ষ থেকে ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চতন্ত্রকে নিয়ে গিয়েছিলেন ইরাণ। সেখানে সেই অনুশির্বন্ রাজার উজির ব্যুজুর্গ মেহের্ (Wuzrg Mihr) তাকে অনুবাদ করেন এবং অনুবাদের পর তার নাম রাখেন (Kariraak Ud Damanak) ‘কারিরাক উদ্ দামানাক’, কারণ পঞ্চতন্ত্রের মিত্রভেদ অংশের প্রথম তন্ত্রের নায়ক হচ্ছে করটক ও দমনক নামের দুই শেয়াল।
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৯: মহাভারতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য আখ্যান-উপাখ্যান, তেমনই একটি সম্বরণ ও তপতীর কাহিনি
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১৭: নৃপেনবাবুকে বহিষ্কার, ইতিহাসের করুণ পরিণতি
আল্ মুকাফ্ফা যখন এই গল্পগুলিকে অনুবাদ করতে শুরু করেন তখন এই গল্পগুলি তাকে স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব অনুপ্রেরিত করেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হল সেই সময়ে বাগদাদের খালিফা আল্ মানসুরের কিছু কাকারা মিলে আল্ মানসুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন রিভল্ট (Revolt)। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত হয় না এবং তখন তারা একটি ‘মাফি নামা’ সংক্রান্ত চিঠি পাঠায় খালিফা আল্ মানসুরের কাছে আর সেই চিঠিটা তারা লেখায় আল্ মুকাফ্ফাকে দিয়ে। আর আগেই বলেছি যে আল্ মুকাফ্ফা পঞ্চতন্ত্রের এই গল্পগুলি পড়ে আগে থেকেই পঞ্চতন্ত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।
উনি সেখানে লিখেছেন, এইসব রাজনৈতিক অভ্যূত্থানগুলোকে ভুলে একসঙ্গে চলা প্রয়োজন, তাঁদের মাফ করা প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্ মানসুর সেই চিঠি পড়ে রেগে যান এবং আল্ মুকাফ্ফাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে দেয়। সেই কথায় বলে না অতিজ্ঞান কখনও কখন জীবনে কুপ্রভাবও ফেলতে পারে। আল্ মুকাফ্ফার তাই হয়েছিল। এই পঞ্চতন্ত্রের জন্য তাঁকে প্রাণ দিতে হল। সত্যি কথা বলতে জ্ঞানকে কোথায় প্রয়োগ করতে হয় আর কোথায় প্রয়োগ করতে হয় না সে বিষয়েও বহু কাহিনি পঞ্চতন্ত্রের মধ্যেই আছে। এই সূচীমুখ পক্ষী কিংবা চড়ুই-দম্পতি আর বানরের গল্পগুলো আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে কোথায় কোথায় জ্ঞান প্রয়োগ করা উচিত নয়। আল্ মুকাফ্ফা সেই কাহিনিগুলোকে হয়তো ‘মাফিনামা’ বয়ান তৈরি করবার সময়ে ভুলে গিয়েছিলেন।—চলবে।