ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।
ফিরে আসি ফেয়ারব্যাঙ্কসের কথায়। পরের দিন আমার চাকরির ইন্টারভিউ। কাজেই খুব বেশি ঘুরে বেড়ানো যাবে না ওই দিন। তাই শহরের আশপাশেই টুকটাক ঘুরতে লাগলাম ওই ট্রাকে করে। যেখানেই যাই, যে দিকেই যাই ফিরে ফিরে আসে সেই চেনা নদীটা। আমার দেখে বেশ মজা লাগলো। সেদিনই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে ফেয়ারব্যাঙ্কস নিয়ে একটা গল্প লিখবো, যার নাম দেব ‘চেনা নদী অচেনা শহর’।
একটু সন্ধে হতেই ওই চেনা নদীর ধারে ধারে দু’ তিনটে রেস্তরাঁ খুঁজে বের করে সেগুলোর প্রত্যেকটায় অল্প অল্প করে খেয়ে সেদিনের নৈশভোজ সারা গেল। তখন অগাস্টের মাঝেমাঝি। মানে সব সময়েই দিন। তবুও বেশ ঠান্ডা। গায়ে একটা মাঝারি মাপের, মানে খুব মোটাও না আবার খুব পাতলাও না, এরকম একটা শীতবস্ত্র চাপিয়ে রাখতে হচ্ছে। হালকা মেঘলা আবহাওয়া। শিরশির করে হওয়া দিচ্ছে নদীর ধারে, গোটা শহরেই। নৈশভোজের পরে আমি হেঁটে ঘুরতে লাগলাম নদীর ধারে ধারেই। যে জায়গাটায় হাঁটছিলাম সেটা শহরের একটু বাইরের দিক।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩৩: আলাস্কাই আমার হাতের সামনে থাকা অন্ধের যষ্টি
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯১: এক আলমারি বই : রাণুর বিয়েতে কবির উপহার
নদীর ওপাশটা বেশ ঘন বনভূমি। সেখানে চিরহরিৎ কনিফার আর পর্ণমোচী বার্চ এবং অ্যাস্পেন, সবকিছুরই সমান সমারোহ। তার সামনেটায় বড় করে পাথর কেটে সেগুলোকে ইংরেজি হরফের মতো বানিয়ে লেখা আছে ‘লাভ আলাস্কা’। নদীর উল্টো পাড়ে মানে যেখানে আমি এখন রয়েছে সেই জায়গাটায় নৌকো নামানোর জন্য একটা ঢাল করা আছে। সান বাঁধানো জায়গাটায় ‘লাভ আলাস্কা’ লেখার দিকে চেয়ে এক জায়গায় চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম, একটুখানি পায়চারি করলাম এদিক থেকে ওদিক।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৫: বসু পরিবার-এ উত্তমকুমার দিনভর একটি শব্দই রিহার্সাল করেছিলেন, কোনটি?
একটু পিছনেই একটা রাস্তা আছে, যেটা দিয়ে সোজা চলে গেলে বিমান বন্দরে পৌঁছনো যায়। কিন্তু সেখান দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে কচিৎ-কদাচিত। গাড়ির শব্দ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে ক্ষীণ ভাবে। সেটা ছাড়া কোথাও কোনও সভ্য জগতের শব্দ নেই। শুধুই নদীর কলকলানি। তার সঙ্গে এসে মিশছে কিছু নাম না জানা পাখির মধুর কলতান। তবে সবটাই যে শ্রুতিমধুর তা নয়। সঙ্গে এসে মিশছে কিছু র্যা ভেন, মিউগাল এবং বল্ড ঈগলের কর্কশ আওয়াজ। সব মিলিয়ে কেমন যেন এক রহস্যময় সৌন্দর্য। তার ওপরে সেদিনের ওই মেঘলা মেঘলা আবহাওয়া। সেটা যেন ওই রহস্যকে আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
নদীর দিকে অনেকক্ষণ একটানা চেয়ে থাকতে থাকতে আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে শুরু করল। একটা দিবাস্বপ্নের মধ্যে চলে গেলাম আমি। মনে হচ্ছিল আমি যেন ওই চেনা নদীর স্রোতে সময়ের উল্টোদিকে ভেসে চলেছি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি রাশিয়া-আলাস্কা সংযোগকারী বেরিংস্ট্রেটের সরু স্থলভূমিটা, যেটা বহু যুগ আগেই উত্তর মহাসাগরের তলায় ডুবে গিয়েছে। সেই স্থলভূমিটা আবার মহাসাগর ফুঁড়ে মাথা তুলে উঠে দাঁড়িয়েছে। আর সেটা পেরিয়ে আমি হেঁটে চলেছি কোনও এক আলাস্কান এস্কিমো যাযাবর গোষ্ঠীর সঙ্গে।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।