শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অরু দত্ত।

একটা মজা ছিল। উনিশ শতকে মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয় থেকে পড়ুয়া মেয়েদের গতিবিধি সব নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরুষরা। এও পুরুষতন্ত্রের এক আশ্চর্য প্রকাশ। কেউ কেউ আবার স্ত্রী স্বাধীনতাকে নিজের মতো সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করতেন। যেমন ‘পরিচারিকা’ পত্রিকার কার্তিক ১২৮৭ বঙ্গাব্দে কোনও এক পুরুষ লেখক স্ত্রী স্বাধীনতার এক অভিনব ব্যাখ্যা করেছিলেন।

‘পুরুষদিগের সহবাসে যথা প্রবৃত্তি, অধিক প্রকাশ্যভাবে রাজপথে গমনাগমন করা স্ত্রী স্বাধীনতা নহে।
প্রকাশ্যস্থলে বক্তৃতা করা স্ত্রীস্বাধীনতা নহে।
অনিষ্টকারী অনীতিপূর্ণ নাটক নভেল ইত্যাদি পাঠ করা স্ত্রীস্বাধীনতা নহে।
অসচ্চরিত্র পুরুষদিগের সম্মুখে যাওয়া স্ত্রীস্বাধীনতা নহে।
স্ত্রীস্বাধীনতা কী?
উপযুক্ত সজ্ঞান উপার্জন করা।
স্বাধীনভাবে সাধু লোকেদের সহিত মিলিত হইয়া ঈশ্বরোপাসনা করা—।
সময় বিশেষে দেশভ্রমণ এবং বায়ুসেবন করা।’
খুব দুঃখের সঙ্গে জানাই, একালেও অনেকেই স্ত্রীস্বাধীনতা বলতে এইই বোঝেন। সে যাই হোক আজকের সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে আলোচনা করব অরুদত্তকে নিয়ে। উনিশ শতকের মহিলা কবিদের মধ্যে অন্যতম। এর আগে আমরা আলোচনা করেছি তাঁর বোন তরু দত্তকে নিয়ে। দুই বোনের একত্রে সাহিত্যসাধনার কথা আমরা জানি। তবে অরু দত্তের কবি হিসেবে আলাদা অস্তিত্ব ছিল। সেই দিক থেকে আজকের আলোচনার কেন্দ্রে রইল কবি অরু দত্ত।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৪: অপরাজিতা রাধারাণী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

একটা সময় ইংরাজি আর ফরাসী সাহিত্যে অরু দত্তের নাম উচ্চারিত হত। অরু দত্তের কবি প্রতিভার অন্তরালে তাঁর বাবা গোবিন্দ চন্দ্র দত্তের প্রভাব ছিল। যদিও সাহিত্যিক হিসেবে তরু দত্তের খ্যাতি বেশি ছিল। তবু অরু দত্ত কবি হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখেন। অরু দত্তের আয়ু ছিল মাত্র কুড়ি বছর। কলকাতার বাড়িতে অরু দত্তের জন্ম ও মৃত্যু! মাঝের সময় কেটেছে বিদেশে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব তাঁর মনন ও মনের গড়নে এক আধুনিকতার প্রভাব ফেলেছিল। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ইউরোপীয় সাহিত্য সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করেছিলেন অরু দত্ত। তাঁর ও তরু দত্তের যৌথ সাহিত্যের মধ্যে তাঁর নাম অনেক সময় হারিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

অরু দত্তের কবিতায় রোম্যান্টিক বিষাদ লক্ষ করা যায়—
When back the well loved shall return/to her who pines though once so dear/The spring from its abundant turn/shall scatter blossoms far and near/I watch I wait —in vain in vain, /The loved and lost comes not again…’ (Romance of Nina)। অরু দত্ত বোনের সঙ্গে সাহিত্য রচনা করতেন। তাঁদের ইউরোপের ব্রন্টি বোনেদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অরু দত্তের লেখায় তাঁদের তশৈশবের কথা ইছে। কলকাতার রামবাগানের বাড়ি, ঠাকুর্দা নীলমনি দত্ত এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারৈর কথা ছড়িয়ে রয়েছে।

তখনকার দিনে মেয়েদের অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়াই একটা বিতর্কের বিষয় ছিল। সেইখানে অরু দত্তের ইংরেজি ও ফরাসী লেখার দক্ষতা সত্যই প্রশংসনীয়। সেই আমলে দুটি নারী যখন সংসার বিবাহ প্রণয় ও সন্তানপালনের ঊর্ধ্বে নিজেকে কল্পনা করতে পারতেন না, সেই সময় দুই নারী, দুই বোন সাহিত্য চর্চা ও পঠনপাঠন করছেন — এইটি সত্যিই প্রশংসনীয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

অরু দত্তের জন্ম হয়েছিল ১৮৫৪ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর। তরু দত্তের জীবন অভিশপ্ত গান্ধর্বীর মতো ছিল। তিনি নিজেই লিখেছিলেন—May love defend thee from Oblivion’s curse!’ এই শব্দগুচ্ছ যেন haunting phrase! তাঁর সাহিত্যকীর্তি যশের শিখর স্পর্শ করেনি। বোনের লেখার সহকারী হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। তবু ঊনবিংশ শতকের নারী স্বাধীনতায় অরু দত্ত এক উল্লেখযোগ্য নাম। অরু দত্ত অভিজাত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা দু’জনেই শিক্ষিত এবং মেয়েদের শিক্ষা বিষয় সচেতন ছিলেন। তাঁদের পরিবারের অনেকেই সাহিত্য রচনা করেছেন এবং বই প্রকাশিত করেছেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৩: এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

অরু দত্তের যখন ছয় বছর বয়স, তখন তাঁর পরিবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এই ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হিন্দুধর্মের বাঁধনমুক্ত হয়ে তাঁরা সাহিত্য রচনা করা ও শিক্ষালাভের স্বাধীনতা পেয়েছেন। তাঁর মা সাহিত্য অনুবাদ করতেন। অরুর গৃহশিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাও তাঁর বাবা তাঁদের তিন ভাই বোনকে লেখাপড়া করাতেন। অরু সম্পর্কে তাঁর বাবা লিখেছিলেন, ‘beauty of our home’। অরুর জীবনের প্রথম আঘাত তাঁর বড়দাদার অকাল মৃত্যু। তখন দুঃখ ভুলতেই বোন অরুর সঙ্গে সাহিত্য সাধনায় ডুব দেন তিনি। ফরাসী সাহিত্য পাঠও তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভাকে বিকশিত করে। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সূত্রে তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় আরো।

তরু দত্তের লেখা ‘A sheaf Gleaned in French Fields’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সেখানে মাত্র আটটি কবিতা অরু দত্তের লেখা। অল্প লেখা, কিন্তু গভীর। তাঁর লেখা উনিশ শতকের সম্পদ। অত্যন্ত রোম্যান্টিক ভঙ্গিতে কাল্পনিক এক প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি—I wait and weep /But where art thou!’ অরু দত্তের জীবনে কোনও প্রেম ছিল কীনা জানা নেই। তবে কবিতায় এই ব্যাকুলতা লক্ষ করার মতো। একজন কবির এই রোম্যান্টিক প্যাথোস তাঁর অসাধারণ কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দেয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৭: মুখোমুখি প্রথমবার /২

অথচ মৃত্যুর আঘাত এই ক্ষণজন্মা কবিকে স্তব্ধ করে দেয়। কথা ছিল তরু দত্তের লেখা একটি উপন্যাসে ছবি আঁকবেন অরু। কিন্তু মৃত্যুর অতর্কিত আক্রমণে সব এলোমেলো হয়ে গেল। রমেশচন্দ্র স্ট্রিটের পুরনো বাড়ি ধরে রাখতে পারল না অরু দত্তের মতো প্রতিভাকে। কলকাতার মানিকতলা সিমেট্রিতে আজও রয়েছে অরু দত্তের সমাধি— পৃথিবীর এক বহুভাষাবিদ কবির নীরব শয়ান।—চলবে।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content