রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অপরাজিতা রাধারাণী।

সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগে সকলকে সুস্বাগতম। আজ বলব এক এমন মহিলা সাহিত্যিকের কথা, যাঁকে বলা চলে ‘Beauty with brain’! রাধারাণী জন্মের পর তাঁর ঠাকুমা রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে এই নাম দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্নেহধন্যা ছিলেন রাধারাণী দেবী। তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকেও। ১৯২৯ সালে সাহিত্য আর সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান ‘রবিবাসর’ এর জন্ম হয়। সেখানে মহিলা সাহিত্যিকের প্রবেশাধিকার নিয়ে নামজাদা পুরুষ সাহিত্যিক মহলে বেশ আলোচনা হয়। একমাত্র শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনও পুরুষ লেখক রাধারাণীকে সাহিত্যিক বিতর্কে গ্রহণযোগ্য বলে মনেই করেন নি। রবীন্দ্রনাথ গররাজি হলেও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। রাধারাণী দেবী অভিমানী মানুষ। এরপর অনেক আহ্বানেও আর সাড়া দেননি রাধারাণী। তবে নিজের সাহিত্যকর্ম অব্যাহত রেখেছিলেন আজীবন।
রাধারাণী দেবী বিপ্লবের অন্য নাম। অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে লিখতেন তিনি। কবিতা বেশি লিখলেও গদ্যেও স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল তাঁর। ১৯০৩ সালের ৩০ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম এই মহিলা কবির। বাবা আশুতোষ ঘোষ ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট এবং রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। মায়ের নাম নারায়ণী দেবী। কোচবিহারে রাধারাণী দেবীর শৈশবযাপন। ছবিরউন্নিসা গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণহয়েছিলেন। এরপর সংস্কৃত, ফরাসী, ইংরেজি ভাষায় নিজেই দক্ষতা অর্জন করেন।

রাধারাণী দেবী বাড়িতে বসেই প্রবাসী, শিশু, মৌচাক, সন্দেশ, সোপান, ভারতবর্ষ ইত্যাদি পত্রিকা পড়তেন। তাঁ নিজের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘মানসী ও মর্মবাণী’ পত্রিকায়। তেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। রাধারাণীর মায়ের নির্দেশে রাধারাণীর কঠিন বৈধব্যজীবন শুরু হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

শোনা যায়, সাদা শাড়ি, হবিষ্যান্ন, চুল ছেঁটে দেওয়ার মতো কঠোর বৈধব্যজীবন যাপন করতে হয় তাঁকে। সেই জায়গা থেকে রাধারাণীর লেখকজীবন, পুনর্বিবাহ এবং বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বে উত্তরণ— সত্যই গল্পের মতো। তাঁর গর্ভধারিণী যেখানে সামাজিক কুসংস্কার অতিক্রম করতে পারেননি, রাধারাণীর শাশুড়ি সেখানে পাড়ওয়ালা শাড়ি, সোনার গয়না, হাতে কলম ধরিয়ে রাধারাণীকে নবজন্ম দিলেন। বিধবা পুত্রবধকে লেখালিখির অবসর তৈরি করে দিয়েছিলেন রাধারাণীর শাশুড়ি। রাধারাণীর পুনর্বিবাহের কথাও তিনিই ভেবেছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

রাধারাণী নিজের জীবনের দক্ষিনের বারান্দা তৈরি করেছিলেন সাহিত্যকেই। রাধারাণী দত্ত নামে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে ভারতবর্ষ, উত্তরা, কল্লোল, ভারতী প্রভৃতি পত্রিকায়। ১৯২৪ সালে তাঁর প্রথম গল্প ‘বিমাতা’ প্রকাশিত হয় মাসিক বসুমতী পত্রিকায়। কল্লোল পত্রিকায় প্রথম প্রবন্ধ পুরুষ প্রকাশিত হয়। এর বছর পাঁচেক পর প্রকাশিত হয় রাধারাণীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লীলাকমল’! ১৯২৭ সালে নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কাব্যদীপালি’র। এই কাব্য পড়ে প্রমথ চৌধুরী সমালোচনা করে বলেন, ‘আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠল না।’ রাধারাণী দেবী এই অভিযোগের প্রতিবাদ করলেন অন্যভাবে।

অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে ব্যক্তিগত গদ্য লেখা শুরু করলেন। তাঁর লেখা সাহিত্যিক মহলে তোলপাড় শুরু করল। এরপর বুকের বীণা, আঙিনার ফুল, পুরবাসিনী, বিচিত্ররূপিনী প্রভৃতি লেখা সকলকে মুগ্ধ করছিল। ছোটদের জন্য লিখেছিলেন নীতি ও গল্প, গল্পের আলপনা। বিয়ের মন্ত্রগুপ্তির বাংলা অনুবাদ করে লেখেন ‘মিলনের মন্ত্রমালা’। এছাড়াও বারোয়ারি উপন্যাস লিখেছেন। ভুবনমোহিনী স্বর্নপদক, লীলা পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার সব পেয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন তিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

একটি মজার ঘটনা! নিজেই নিজে বই উৎসর্গ করেছিলেন রাধারাণী। খুব বড় কথক ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা অনেক গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর গোটা জীবন ছিল নাটক নবেলে মোড়া। লেখার অন্তরালে ছিল সংগ্রামী চিন্তা। নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে আলাপ সাহিত্য আলোচনার সূত্রেই। একত্রে সাহিত্য চর্চা করতে করতে তাঁরা জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠেন। তাঁদের প্রণয়ঘটিত বিয়ে। পুনর্বিবাহে দুই পক্ষের অভিভাবকদের পূর্ণ সম্মতি ছিল। তবু রাধারাণী দেবী আত্মসম্প্রদান করেছিলেন। আসলে প্রথম বিবাহে তাঁর গোত্রান্তর হয়ে গিয়েছিল। এরপর সব নিয়মনীতি মেনে নিজেকেই নিজে সম্প্রদান করেন রাধারাণী। তারপর শুরু হয় নরেন্দ্র দেব আর রাধারাণীর ভালোবাসার সংসার। তিনি রত্নগর্ভা। নবনীতা দেবসেন তাঁর যশস্বী সন্তান। তাঁদের আমলে কংগ্রেস অধিবেশনে ডিভোর্স নিয়ে বিতর্কসভা বসেছিল। ভিভোর্সের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন করেছিলেন রাধারাণী।
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

রবীন্দ্রনাথ অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে লেখা রাধারাণীর লেখা পড়ে ভেবেছিলেন পুরুষ সাহিত্যিকের লেখা। শরৎচন্দ্রের খুব স্নেহধন্যা ছিলেন এই মহিলা সাহিত্যিক। নবনীতার নাম শরৎচন্দ্র রেখেছিলেন অনুরাধা। রাধারাণী মেয়েকে মনের মতো করে মানুষ করেছিলেন তিনি। খুব আধুনিক মা ছিলেন রাধারাণী। জীবনকে দুইহাতে গ্রহণ করার মন্ত্র নবনীতা পেয়েছিলেন রাধারাণীর থেকেই। শোনা যায় কস্তুরীমৃগের নাভীর গন্ধ নিয়ে কোমার থেকে কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলেছিলেন রাধারাণী।পরিজনদের দেখে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি, বিশ শতকের এক দাপুটে সাহিত্যিক।—চলবে।
* * ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content