বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


যযাতি নাটকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

“The world has never before had as much drama as today. Radio, films, television and video inundate us with drama. But while these forms can engage or even enrage the audience, in none of them can the viewer’s response alter the artistic event itself.” —Girish Karnad.

নাটকীয়তার স্পর্শ বর্জিত ইতরেতর প্রাণিদের মধ্যে তাই শোকেও সংযত, দলবদ্ধভাব দেখা যায়। মানবকুলের জন্য অবশ্য মহাকবি ভাস দিয়েছিলেন অন্য রকম বিধান—”…যদ্ বিমুচ্যেহ বাষ্পম্ /প্রাপ্তানৃণ্যা যাতি বুদ্ধিং প্রসাদম্।।”

শোকে, দুঃখে যত চোখের জল পড়বে, বুদ্ধি তত নির্মল হবে। চোখের জলের আশ্রয় নিতে কখনও নিজের মাকে গিরিশ দেখেননি। পূর্ব বিবাহের এক সন্তান সহ পুনর্বিবাহে চার সন্তানের জননী পেশায় নার্স তাঁর মা কৃষ্ণাবাই ও চিকিৎসক বাবা রঘুনাথ কারনাড সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ না হয়েও নাটক, থিয়েটারের প্রতি ছিল উৎসাহ, উদ্দীপনা। সেই উৎসাহ, উদ্দীপনা ক্রমশ তাঁদের তৃতীয় সন্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল।
১৯৩৮ সালের ১৯ মে মহারাষ্ট্রের মাথেরনে জন্মগ্রহণের পর তাঁর বাবার বদলির চাকরির কারণে ক্রমশ তাঁরা বম্বে প্রেসিডেন্সির সিরসি থেকে যখন পাকাপাকি ভাবে কর্ণাটকের ধারওয়ারে এসে থাকতে শুরু করেন তখন গিরিশের বয়স মাত্র চোদ্দো। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। চিত্রপুর সারস্বত ব্রাহ্মণ বংশের কারনাড পরিবারের ছেলে গিরিশের কাছে তখন নাটক, থিয়েটার মানে মা, বাবার সঙ্গে প্রদীপের আলোয় দেখা ভ্রাম্যমান নাটকমণ্ডলীর অভিনয় আর না হয় তাঁর প্রিয়, পরিচিত দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের যক্ষগান। এই অভিনয়শৈলী তাঁকে পরবর্তী জীবন জুড়ে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়েছিল। কর্ণাটকের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে এই নাট্যধারা চলে আসছে। মূলত হিন্দু ও জৈন ধ্রুপদী মহাকাব্য ও প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারী এই উপস্থাপনা সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়ায়। এই শৈলীর গানগুলি শাস্ত্রীয় গান নয় এবং এতে আবহ সঙ্গীতের প্রাধান্য সবসময় বেশি থাকে।
আরও পড়ুন:

মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত পরিবারের মতো তিনিও স্কুল জীবনের শেষে ১৯৫৮ সালে ধারওয়াড়ের কর্ণাটক আর্টস কলেজ থেকে অঙ্ক ও রাশিবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হয়ে রোডস স্কলার (১৯৬০-১৯৬৩) হিসেবে অক্সফোর্ডে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অক্সফোর্ডের ঝকঝকে ছাত্রটির মুকুটে সেইসময় অক্সফোর্ড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (১৯৬০-১৯৬৩) হওয়ার পালকটিও যুক্ত হয়। এত কিছুর পরও ইংল্যান্ডে থাকার সময় কিছুতেই নিজের অবচেতনকে অস্বীকার করতে পারছিলেন না। ছোট বয়স থেকে প্রদীপের আলোয় দেখা অর্ধপরিচিত মহাকাব্যিক, পৌরাণিক চরিত্রগুলিকে তাঁর নিজের জীবনে সংযোজন, বিয়োজন ও একাত্ম করে নেওয়ার জন্য শুরু করেন ভারতরত্ন চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী রচিত রামায়ণ এবং মহাভারতের গভীর অনুশীলন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনার পাশাপাশি সৃষ্টি করেন পাণ্ডবদের পূর্বজ যযাতিকে নিয়ে কন্নড় ভাষায় লেখা তাঁর প্রথম নাটক ‘যযাতি’ (১৯৬১), যা ভারতীয় পারিবারিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে ‘যযাতি’ রচনা করে স্বাধীনতা-উত্তর দেশের নাট্যধারায় যিনি জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলিকে পরিবর্তিত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে যথাযথভাবে মেশাতে পেরেছিলেন তিনি অবশ্যই গিরিশ কারনাড। পরবর্তী চার দশক ধরে তিনি তাঁর লেখা, মঞ্চ ও সেলুলয়েড যাপনে মহাকাব্যিক পুরাকথন, ইতিহাস এবং লোককাহিনিকে বারংবার আশ্রয় করেছিলেন। তীক্ষ্ণধী তিনি তাঁর এই পুরাকথনমূলক নাটকটির পুনর্মূল্যায়নে বলেছিলেন— “I was excited by the story of Yayati, where a son exchanges his youth with his father’s old age. The situation was both dramatic and tragic. But the question that bothered me even as I was finishing the story was : If the son had been married, what would the wife do? Would she have accepted this unnatural arrangement?”

নাগমণ্ডলার কলাকুশলীরা। ছবি: সংগ্রহীত।

তিনি আরও বলতেন, কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে দিয়ে ওই বয়সে নাটকটির সুষ্ঠু পরিণতি প্রদান করিয়েছিল। সংলাপগুলো যেন তিনি শুনতে পেতেন। নিজের এই সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি যুবা বয়সে পুরুর সঙ্গে এবং পরবর্তী জীবনে যযাতির সঙ্গে একাত্মবোধ করতেন। নাটকটির হিন্দি সংস্করণটির ক্ষেত্রে পরিচালক সত্যদেব দুবে অমরিশ পুরীকে দিয়ে মূল চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। অত্যন্ত সফল নাটকটি বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।

দার্শনিক কৃষ্ণমূর্তির অনুগামী গিরিশ ব্যক্তিমানুষকে তাঁর ভাগ্যনির্মাতা হিসেবে এবং ভারতীয় কর্মবাদের প্রাধান্য অস্বীকার করতেন। কন্নড় ভাষায় রচিত তাঁর নাটকগুলো অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ইংরেজিতে এবং অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা থেকে বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, চেন্নাইতে ১৯৬৩-৭০ সাল পর্যন্ত কাজ করার পর লেখালেখিকে পাকাপাকি ভাবে জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি বেছে নেন। প্রথম জীবনে রচিত তাঁর তিনটি নাটক ‘যযাতি’ (১৯৬১), ‘তুঘলক’ (১৯৬৪) এবং ‘হয়বদন’ (১৯৭১) তাঁকে অপার সাফল্য এনে দিয়েছিল। ‘তুঘলক’ স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের হতাশাজনক অবস্থাকে তুলে ধরেছিল। ‘ন্যাশেনাল স্কুল অব ড্রামা’র সৌজন্যে পরিচালক ইব্রাহিম আলকাজী নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মনোহর সিং।

লন্ডনে (১৯৮২) ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যালেও নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। ‘হয়বদন’-এর মূল গল্প নেওয়া হয়েছিল থমাস ম্যান রচিত ‘দ্য ট্রান্সপোসড হেডস’ (১৯৪০) থেকে, তবে উপমহাদেশের গল্পসাহিত্যে (কথাসরিৎসাগরে) এর মূল সুর সুপ্রাচীন কাল থেকেই ধ্বনিত হয়ে এসেছে। সেই প্রথম ছোটবেলায় দেখা, শোনা যক্ষগান গিরিশ তাঁর নিজের সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। পরে এটি জার্মান ভাষায় মঞ্চস্থ করা হলে এর পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিজয় মেহতা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

নট ও নাট্যকার তিনি তাঁর মাতৃভাষায় (কন্নড়) রচিত নাটকগুলোর ইংরেজি অনুবাদ নিজেই করেছিলেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর (১৯৮৭-৮৮) এবং ফুলব্রাইট স্কলার-ইন-রেসিডেন্স হিসেবে কাজ করার সময় একদিকে যেমন ‘ভরতনাট্যশাস্ত্র’ পড়ে শেষ করেছিলেন অন্যদিকে রচনা করেছিলেন তাঁর বন্ধু সিএম নইমের অনুপ্রেরণায় বিখ্যাত নাটক ‘নাগমণ্ডলা'(১৯৮৮)।

সেই সময় ভরতনাট্যশাস্ত্র পড়ার অনন্য অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেছিলেন—“(it) enable me to give myself time to read Bharat’s “Natya Sastra” in detail, clarify my thoughts on classical Indian theatre and poetics by giving a course on the subject for two quarters…”

তাঁর গুরু, মেন্টর এ. কে. রামানুজনের কাছে শোনা দুটি কিংবদন্তিকে আশ্রয় করে ‘নাগমণ্ডলা’ নাটকটি গিরিশ রচনা করেছিলেন। উচ্চবিত্ত এক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হওয়া, ভালোবাসাহীন, কর্তব্যরত রানির (মুখ্য চরিত্র) পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে আপোষের কাহিনী ছিল ‘নাগমণ্ডলা’। নারীমানস, মুক্তি, প্রবৃত্তির প্রকাশে তিনি সবসময় নিজের কাজকে হাতিয়ার করেছেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পুত্রসন্তানসহ তাঁর বিধবা মায়ের পুনর্বিবাহকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে গিরিশ খুব উল্লেখযোগ্য মনে করতেন। তাঁর মায়ের নির্ভিক সামাজিকজীবন যাপন তাঁকে বরাবর সাহস যুগিয়েছিল। আমেরিকার মিনিয়াপোলিসের গাথরে প্রেক্ষাগৃহে (Guthrie Theatre) ইংরেজিতে প্রথম ‘নাগমণ্ডলা’ মঞ্চস্থ হয়। ১৯৮৯ সালে তাঁর এই কৃতি তাঁকে কর্ণাটক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এনে দেয়।

মন্থন' ছবিতে গিরিশ কারনাড এবং স্মিতা পাতিল। ছবি: সংগ্রহীত।

গিরিশ কারনাডের মৃত্যুর পর পিতৃস্মরণে তাঁর পুত্র রঘু ও কন্যা রাধা বলেছিলেন— “যে বই আমাদের তিনি বারংবার পড়তে বলতেন সেটি ছিল ব্যাসের মহাভারত”। গিরিশের দ্বিতীয় যে নাটকে মহাভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় সেটি ছিল ‘অগ্নি মাত্তু মালে'(১৯৯৫) অথবা ‘The fire and the Rain”. নাটকটির মূল কাহিনিকে অনুসরণ করে পরবর্তীতে হিন্দি ছবি ‘অগ্নি বর্ষা ‘ মুক্তি পেয়েছিল এবং বাংলায় ‘অগ্নি জল’ মঞ্চস্থ হত। প্রাক মহাভারতকালীন সমাজ, সামাজিক স্তরে বৈদিক সাহিত্য, সভ্যতার প্রভাব স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল নাটকটির পরতে পরতে।এই নাটকের গভীরতা, বৌদ্ধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশেষ চিন্তাচেতনা এবং একাধিক জটিল সম্পর্কের সমীকরণ ও তার শাব্দিক, আনুভূতিক প্রকাশ একে ভারতীয় ভাষায় রচিত, অনূদিত, সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকের মর্যাদা দিয়েছে।

নব্য ভারতে জন্মানো, পরিশীলিত শিক্ষা ও চেতনাসম্পন্ন, কন্নড়, তামিল, মালয়ালম, হিন্দি, ইংরেজি ও সংস্কৃতে সাবলীল একজন মানুষ কেন বারবার নিজস্ব রচনা, শিল্পের পরিসরে হিন্দু মিথ গুলিকে আশ্রয় করতেন? এই সমালোচনার জবাবে ১৯৯৯ সালে দ্য সানডে হেরাল্ডকে (The Sunday Herald) দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে গিরিশ কারনাড বলেছিলেন— “আমরা ধরেই নিই পৌরাণিক পালা মানে হয় রাম নয় কৃষ্ণ এবং ভক্তি আশ্রিত, কিন্তু পুরাণ মানে আরও অনেক কিছু, অনেক বিস্ময়কর গল্প যেখানে ঐশ্বরিক যোগ কিছু নেই। বেদের আখ্যান একরকম, উপনিষদের আখ্যান অন্যরকম…. জোর করে আমি কখনও পুরনোর ধাঁচে নতুনকে ঢালার চেষ্টা করি না, যদি পুরা কথনের উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমি সমকালীন চেতনা রাখতে পারি তাহলে অনায়াসে সেটি এ যুগের হয়ে ওঠে”।

মূল মহাভারতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁর কাছে যখন বিবিসি থেকে “Art that shook the world” সিরিজের জন্য মহাভারতের উপর একটা পর্ব লিখে প্রস্তুত করতে বলা হয় তখন তিনি তাঁদের মহাভারতের গভীরতা ও বিশালতা বোঝাতে সিরিজের নাম বদলে “Art that created the world” করতে বলেন। ‘মা নিষাদ’এর মতো একাঙ্ক নাটক দিয়ে গিরিশের যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটি শেষ হয়েছিল ‘রাক্ষস তঙ্গারি’র (২০১৮) রচনার মাধ্যমে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৪: দীনেন গুপ্তের আগে ‘দেবী চৌধুরাণী’ করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়

নিজের কাজকে বৃহত্তর দর্শকগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৭০ সাল থেকে সিনেমাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে শুরু করেন। সিনেমার ছাত্র না হয়েও তিনি সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লেখা, পরিচালনা এবং অভিনয়ে নিজস্ব ঘরানার সৃষ্টি করেন। ‘সংস্কার'(১৯৭০) ছবিতে তিনি প্রথম চিত্রনাট্য লেখেন এবং অভিনয় করেন। এই ছবি তাঁকে শ্রেষ্ঠ কন্নড় ছবির জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। বিভি করন্থের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘বংশবৃক্ষে’র (১৯৭১) জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। পঁয়ত্রিশ বছরের অভিনয় জীবনে তাঁর অভিনীত বহু ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। এরমধ্যে ‘কাড়ু’ (১৯৭৩), ‘তব্বালিয়ু নিনাদে মগানে’ (হিন্দিতে গোধূলি ১৯৭৭), ‘ওন্দানন্দু কলাদাল্লি'(১৯৭৮), ‘উৎসব'(১৯৮৪) এবং ‘কনরু হেগ্গাদিতি’ (১৯৯৯) ছিল অন্যতম। দেশের আর্ট ছবির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত গিরিশ তাঁর অভিনয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় করেছিলেন ‘নিশান্ত'(১৯৭৫) ও ‘মন্থন'(১৯৭৬)-এ।

তাঁর অভিনয়ে ছিল নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ছাপ, নব্য ভারতের নব্য যুবা পুরুষের, যুবা মানসের অবস্থার প্রকাশে তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯৯০ সালের পর থেকে হিন্দি ছবিতে অভিনয় কমিয়ে দিলেও পরিচালক নাগেশ কুক্কুনুড়ের ‘ইকবাল’ (২০০৫) এবং ‘ডোর’ (২০০৫) ছবিতে তাঁর অভিনয় জনপ্রিয় হয়। এছাড়াও ‘এক থা টাইগার ‘(২০০৫) এবং ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়'(২০১৭) এর মতো আদ্যন্ত বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর অভিনয়ও সমান আকর্ষণীয় ছিল। দূরদর্শনে ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে আরকে নারায়ণের ‘মালগুড়ি ডেইজ’ (Malgudi days)-এ স্বামীর বাবার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আজও আশি-নব্বইয়ের দশকের প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। এছাড়াও সায়েন্স ফিকশন সিরিজ ‘ইন্দ্রধনুষ'(১৯৮৯) এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ‘টার্নিং পয়েন্ট’-এ তাঁর সঞ্চালনা বহু সঞ্চালককে অনুপ্রাণিত করেছিল।

১৯৯৮ সালে কন্নড় সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছবি: সংগ্রহীত।

সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য রাজ্যোৎসব পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অকাডেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, কন্নড় সাহিত্য পরিষৎ পুরস্কার, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার এবং কালিদাস সম্মানে সম্মানিত তাঁকে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি যখন ২০১২ সালে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে মেনে নিলেও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে মেনে নেননি, বলেছিলেন—“Rabindranath Tagore was a great poet but not playwright…he is there, he is okay and credit we should give to him is that when there was theatre, drama was trying to come up, he tried to write some very decent and very interesting plays but that’s all there is”.

২০১৯ সালের জুন মাসে গিরিশ কারনাড জটিল রোগভোগের পর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা রেখে চলে গেলেও নাট্যকার কালিদাস, শূদ্রকের অনুরাগী তিনি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, স্পষ্টবক্তা, অসাম্প্রদায়িক, উদার মনের অধিকারী তিনি তাঁর সমসাময়িক বাদল সরকার, ধরমবীর ভারতী, মোহন রাকেশ, এবং বিজয় তেন্ডুলকরের সঙ্গে দেশে যে নাট্যধারা, নাট্য-আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা নব্য ভারতের চিন্তা চেতনাকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিল ও ভবিষ্যতেও করবে।
* লেখিকা পরিচিতি: ড. বিদিশা মিশ্র বিগত পনেরো বছর ধরে সরকারি কলেজে, বর্তমানে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বিষয়— সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী বিদিশা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল —বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাস। তাঁর এই গবেষণা ২০২১ সালে কর্ণাটকের আইএনএসসি পাবলিশিং হাউস থেকে ‘দ্য কাব্যবিলাস অফ চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য — এ ক্রিটিক্যাল স্টাডি’ শিরোণামে প্রকাশিত হয়। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্র প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর তত্ত্বাবধানে একাধিক স্কলার গবেষণারত। বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম ও অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি গুরুজি বিপ্লব মুখোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানী ক্লাসিক্যাল শিক্ষারতা। ভ্রমণপিপাসু বিদিশা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরেছেন, সেইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

Skip to content