বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমা।

শ্রীমার বড়ভাই প্রসন্নের প্রথম স্ত্রী রামপ্রিয়া প্রায় ভুগত, সে খুব দুর্বল ছিল। তার দুই মেয়ে নলিনী ও সুশীলা মা সারদার কাছেই বেশি থাকত। শেষে রামপ্রিয়া দুদিনের ওলাওঠায় দেহ রাখে। তারপর প্রসন্ন দ্বিতীয় স্ত্রী নয়বছরের সুবাসিনীকে ঘরে আনে। সুবাসিনীকে বিয়ের পরই প্রসন্ন ভিটে আলাদা করার জন্য সারদা মায়ের কাছে প্রস্তাব রাখে। স্বামী সারদানন্দ সব ব্যবস্থা করেন, যা প্রসঙ্গক্রমে আগেই বলা হয়েছে। এই সময়ের একটি ঘটনার কথা বলা যাক। ভিটে, জমির বন্দোবস্তের জন্য শরৎ মহারাজ গোলাপমা, যোগীনমা ও কানাই নামের একজন ব্রহ্মচারীকে নিয়ে যখন জয়রামবাটি আসেন, তখন ছিল বসন্তকাল। তিনি দেখেন যে শ্রীমা আঁকশি দিয়ে পেড়ে কচি নিমপাতা জড়ো করে রাখছেন।
শরৎ মহারাজ শ্রীমাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতেই মা সারদা বলেন, ‘এসেছ বাবা শরৎ। তোমার জন্যই নিমপাতা পাড়ছি, তুমি খাওয়ার সময় প্রথমপাতে তেতো নিমবেগুন খেতে ভালবাস, জানি’। শ্রীমা সকলকে এবার বললেন, ‘জল খেয়ে সবাই একটু জিরিয়ে নিয়ে স্নান কোরো’। পুকুরের জল শুকিয়ে গিয়েছে। তাই মাছ আনার জন্য ভাই বরদাকে তিনি কোতুলপুর পাঠিয়েছিলেন। এই সময় বড়ভাইজি নলিনী আর নতুনবৌ সুবাসিনীকে ডেকে বলেন যে, সকলের জন্য দাওয়ায় মাদুর পেতে দিতে। সকলে কলকাতা থেকে তেতেপুড়ে এসেছে। একবার মনসাপুজো উপলক্ষ করে জয়রামবাটিতে বলরাম বাড়ুজ্যের মা শ্রীমার পরিবারের সকলকে খাইয়েছিলেন। সে রাতে আর কেউই রান্না করতে চাইল না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৮: ছবি আঁকতে আঁকতে অবনীন্দ্রনাথ টান দিতেন গড়গড়ায়, চিবোতেন পান

সুবাসিনী বলেন যে, নলিনী বলে, একটিন মুড়ি হলেই সকলের হয়ে যাবে। একবেলা রান্না নাই বা হল। সুবাসিনী দু’সের চালের ভাত বসিয়ে দিলেন আর সকলে তাই খেল। পরদিন তরকারি কুটতে বসে শ্রীমা বললেন, ‘নলিনী, তুই রান্তে বারণ করেছিলি, বউ রাঁধলে, একটিন মুড়ি বেঁচে গেল। তা নাহলে, কাল মুড়ি ভেজে গেছে, আজ আবার মৃগেন্দ্র বিশ্বাসের মাকে ডাকতে হত’। তারপরই মা সারদা বললেন, ‘জ্যেষ্ঠ কি কনিষ্ঠ, যে বোঝে সেই হৃষ্ট’। সুবাসিনী আর ইন্দুমতী দু’জনেরই অল্প বয়স বলে মা সারদা তাদের খুব স্নেহ করতেন। তাই নিয়ে আবার শ্রীমার ছোট ভাজ সুরবালার মাথা খারাপ হলে তাঁকে কথা শোনাতেন।

এ বিষয়ে বরদার স্ত্রী ইন্দুমতী বলেন যে, পাগলী অর্থাৎ রাধুর মা এক এক সময় শ্রীমাকে বলত, ‘তোমার অনেক ভাজ আছে, তাদের ছেলে একটি লাওগে যাও, তুমি কি আমার ছেলেকেই নেবে বলে জন্মেছিলে’? বৈশাখমাসের এক দুপুরবেলায় সকলে খেতে বসেছে। শ্রীমা সবার পাতে ভাত বেড়ে দিয়েছেন আর সুবাসিনী থালাগুলো ধরে দিল। সেদিন মণীন্দ্রবাবুর মা, ইন্দুমতী, নলিনী, সুশীলা ও রাধুর সঙ্গে শ্রীমাও খেতে বসলেন। মা সারদা যখন তাঁর পাতের প্রসাদ সকলকে দিলেন, তখন সেই প্রসাদে আবাঠার গন্ধ পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

সকলে সুবাসিনীকে দোষারোপ করে বললে, ‘তুমি বোধ হয় আবাঠা মেখেচ’। সুবাসিনীর মাথা শুঁকেও অনেকে দেখল। সুবাসিনী পরে বলেছেন যে, আবাঠা তখন তাদের ঘরেও ছিল না। সেদিন শ্রীমার ভাল করে খাওয়া হল না। পরের দিন কামারপুকুর থেকে ঠাকুরের ভাইপো শিবু এল। তাকে দেখে শ্রীমা জানতে চান সে কি করে এল। শিবু বলে, ‘কাল রাতে স্বপ্নে দেখলুম একজন বলচেন, এ বার তোর মাকে গাছের পাকা আম দিলিনি? যা, দিয়ে আয়। তাই আজ তোমার জন্যে গাছের পাকা আম নিয়ে এসেচি। তা নাহলে দুদিন পরে আসতুম’। শুনে ভানুপিসি বললেন যে, ঠাকুর তাকে বলেছেন, আম নিয়ে যেতে। শ্রীমা একথা শুনে ভানুপিসিকে ধমক দেন। খাওয়া-দাওয়ার পর শিবুর ফেরার সময় মা সারদা তার হাতে সীতা চাল, ছোলার ডাল, আলু, কুমড়ো প্রভৃতি দিয়ে বলেন মা শীতলার ভোগ দিতে। তারপর বলেন, ‘কাল আমি কোথাও কিছু দেখলুমনি, খাবারে আবাঠার গন্ধ পেলুম’। তিনি প্রতি বৈশাখে মা শীতলা আর রঘুবীরের জন্য ভোগ পাঠাতেন।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

একবার শ্রীমা দশ-পনের দিনের জন্য কামারপুকুরে ছিলেন। সেসময় সুবাসিনী একটি মেয়ের হাত দিয়ে পদ্মফুল ও মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন। তখন শ্রীমা বলেছিলেন, ‘এ সংসারে কেউ আমাকে তত্ত্ব করে না, এই একটিই করে’। কামারপুকুরে যাবার সময় মা সারদা তার কাছে পনেরটি গিনি রেখে গিয়েছিলেন।

শ্রীমা রোজ চারবার দাঁতে গুল দিতেন। নারকেলপাতা ও দোক্তা পুড়িয়ে এই গুল তৈরি করা হত। তিনি তখন কলকাতায়, তাঁর জন্য এক ডিবে গুল তৈরি করে সুবাসিনী স্বামী প্রসন্নের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেন। ফিরে আসার পর শ্রীমা সুবাসিনীকে বলেছিলেন যে, সে যে গুল পাঠিয়েছিল, সবাই তার সুখ্যাতি করেছিল। শ্রীমা তখন তাঁর নতুনবাড়ীতে আছেন, একদিন রান্না করে সুবাসিনী তাঁকে প্রণাম করতে গিয়েছেন। মা সারদা বললেন, ‘রান্না হল বৌ, কি কি রাঁধলে? জল খেয়েছ’? তিনি সুবাসিনীর হাতে জলখাবার প্রসাদ দিলেন। তারপর তাকে বললেন, ‘ইন্দু বলে, “ঠাকুরঝি, তুমি আলাদা থাকবে, হরিনাম করবে আর একসের চাল রাঁধবে। তোমার কেন ঝঞ্ঝাট পোয়ানো?” ওদের হল চার চাল, আমার হল ঘোল চাল’। সুবাসিনী আর প্রসন্নের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে কমলা আর ছোট বিমলা।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: ভৃত্য যদি কোনও অপরাধ করেন, তার দণ্ড প্রভুকেই পেতে হয়

জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন একবার ছোট মেয়ে বিমলার পা ফুলে জ্বর হয়। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বৈকুণ্ঠ মহারাজ দেখে বলেন যে, ধাত নেই। সুবাসিনী শ্রীমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মা সারদার পায়ের ধুলো জলে মিশিয়ে মেয়ের মুখে দিলে। শ্রীমা বিমলার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আর জগদ্ধাত্রী প্রতিমার সামনে অশ্রুসজল হয়ে বললেন, ‘কাল তোমার পুজো হবে মা, বড়বৌ হাউ হাউ করে কাঁদবে’? সেই রাতে মেয়ের জ্ঞান ফিরে আসে। সুবাসিনী বলেন যে, গঙ্গারাম কখন কখন শ্রীমাকে বলত, ‘মা, পড় পড়’। আর শ্রীমা বলতেন, ‘ওরে, এ সংসারে আমাকে কেউ পড়তে বলেনি, মায়ের সংসারে কেবল দেহি দেহি করে, তুই আমাকে পড়তে বলচিস’। তিনি সুবাসিনীকে বলেছিলেন যে, সতের সঙ্গে থাকবে, সতের সঙ্গে ব্যবহার করলে কোন আঘাত হবে না। ‘তুমি সকলকে যত্ন করবে। যত্ন কল্লে বনের পশু সেও বশ হয়’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content