মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ শুধু নন, যে ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে সব থেকে বেশি তিনি ভালোবাসতেন, সেই অবনীন্দ্রনাথও ছিলেন স্কুল পালানো ছেলে। স্কুল তো নয়, যেন এক বন্দিশালা, সারাক্ষণই চোখরাঙানি, শাসনের বাড়াবাড়ি! কখনও কখনও মাস্টারমশায়রা বড় নির্মম হয়ে উঠতেন, হৃদয়হীনভাবে মারধর করতেন। একটুও দয়া-মায়া ছিল না। একদিন সামান্য কারণে অবনীন্দ্রনাথকে প্রহার করেছিলেন স্কুলের মাস্টারমশায়। পিতা গুণেন্দ্রনাথের কাছে এ খবর পৌঁছনোর পর তিনি যথেষ্ট উত্তেজিত হয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই বন্ধ হল অবনীন্দ্রনাথের স্কুলে যাওয়া। সেই থেকে তাঁর স্কুল-ভীতি।

স্কুল অবনীন্দ্রনাথের পিছু ছাড়েনি। ডাক এসেছে আর্ট স্কুল থেকে। ছেলেদের পড়াবেন, ছবি আঁকা শেখাবেন —এ তো এক দারুণ সুযোগ! না, এমনভাবে তিনি ভাবেননি। পুলকিত নয়, বিচলিত হয়েছেন। তবে তাঁর ধ্যানধারণা, ভাবনা শেষ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। তিনি হয়ে ওঠেন শিল্প-শিক্ষক। এর আড়ালে ছিলেন ই.বি. হ্যাভেল। তখন তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টের অধ্যক্ষ। এই দায়িত্ব নিয়ে তিনি একটু অবাকই হয়েছিলেন, আর্ট স্কুলে ভারতীয় শিল্পচর্চা নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। বিলিতি আর্ট নিয়ে যত আগ্রহ। ভিনদেশী এই সাহেব ভারতীয় শিল্পকলা সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ঠিক করলেন, ভারতীয় শিল্পকলার পুনরুদ্ধার করবেন। পুরনো ছবি, মূর্তি, স্থাপত্য — ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা শিল্পসামগ্রী সংগ্রহ করতে হবে।
এই সংগ্রহ-অভিযান করতে গিয়েই পরিচয় হয় মি. ব্লান্টের সঙ্গে। ব্লান্ট ছিলেন অন্য ধরনের, রুচিবোধের সঙ্গে তাঁর জীবন-জীবিকাকে ঠিক মেলানো যেত না। আমদানি রপ্তানির কারবারি, অথচ আর্টের সমঝদার, শিল্পরসিক। প্রায়ই সকালের দিকে সাইকেলে চড়ে চলে আসতেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে। পাশে বসে ঠায় দেখতেন ছবি-আঁকা। করতেন গল্পগাছা। সাহেবটিকে অবনীন্দ্রনাথ যথেষ্ট খাতির করতেন। ব্লান্টের মুখেই হ্যাভেল শুনেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের কথা। তাঁর কাজের পরিসর কতদূর বিস্তৃত, সে সংবাদ ব্লান্টের মুখে শুনে হ্যাভেল জানতে পেরেছিলেন। জানার পর অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। কয়েক দিনের মধ্যেই অবনীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে চলে এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

জোড়াসাঁকোয় এসে হ্যাভেল-সাহেবের আনন্দ আর ধরে না। তিনি ঠিক যা খুঁজছিলেন, তা-ই যেন পেয়েছেন। অবনীন্দ্রনাথকে তাঁর চাই-ই। আর্ট স্কুলটিকে মনের মতো করে সাজাতে চান তিনি। অবনীন্দ্রনাথের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব নয়। জোড়াসাঁকোয় এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলে শুধুই মুগ্ধতা। সীমাহীন ভালোলাগা। অবনীন্দ্রনাথকে কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন হ্যাভেল সাহেব। অবনীন্দ্রনাথকে তখুনি তিনি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আনন্দে উচ্ছ্বাসে বলেছিলেন, ‘আর কিছু নয়, আপনি শুধু ইন্ডিয়ান আর্ট শেখাবেন। আপনি রাজি তো?’

অবনীন্দ্রনাথ এমন আমন্ত্রণের জন্য তৈরি ছিলেন না। অপ্রত্যাশিত ও অভাবনীয়। কিছুই বললেন না তিনি। নানাভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। হ্যাভেল-সাহেব ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন, অনুরোধের পর অনুরোধ। শেষে অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি মাকে জিজ্ঞাসা না করে কিছুই বলতে পারব না, কিছুই করতে পারব না।’

সৌদামিনী দেবী।

অবনীন্দ্রনাথ সব খুলে বললেন মাকে। সৌদামিনী দেবী কিছুতেই রাজি হলেন না। অবন তাঁর ঘরকুনো ছেলে, এলোমেলো, কখনও রুটিন মেনে চলেন না। চলেন আপন খেয়ালে, নিজের মেজাজমর্জিতে। মায়ের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ খেলে যায়। দশটা-পাঁচটা অফিস করতে আদরের অবন পারবে তো! ছেলে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে কী হবে!

মায়ের মুখে উৎসাহব্যঞ্জক কথা না শুনে অবনীন্দ্রনাথের অবশ্য খারাপ লাগেনি। তাঁর নিজেরও অনেক দ্বিধা-সংশয়। নিয়ম মেনে চাকরি তিনি করতে পারবেন না। এসব ভেবে অবনীন্দ্রনাথ শেষে জানিয়ে দিলেন, মা রাজি নন।

সাহেব নাছোড়বান্দা। নিজে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। বললেন, কোনও অসুবিধা হবে না। সব ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। বাঁধাধরা কোনও নিয়ম থাকবে না। অবনীন্দ্রনাথ যখন খুশি যাবেন, যখন খুশি ফিরবেন। সাহেবের মুখে এসব শুনে আশ্বস্ত হলেন মা। ছেলেকে ছাড়তে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

হ্যাবেল সাহেব কথা বলছিলেন মা সৌদামিনী দেবীর সঙ্গে, অদূরেই দাঁড়িয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথের মুখে তখন এমন এক আর্জি, যে আর্জির জন্য সাহেব অন্তত প্রস্তুত ছিলেন না।

কী সেই আর্জি, গড়গড়ায় তামাক খাওয়া আর পান খাওয়া যে অভ্যেস, সে কথা সাহেবকে জানালেন অবনীন্দ্রনাথ। আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন গড়াগড়া আর পান — ওই দুটি না হলে কাজ করতে পারবেন না তিনি।

সাহেব মন দিয়ে সব শুনলেন। তাঁর মুখে হাসির রেখা খেলে গেল। আবারও জানালেন, কোনও অসুবিধা হবে না। তাঁর জন্য একজন বেহারা থাকবে। যা বলবেন, সব করে দেবে।

নন্দলাল বসু।

শুনে অবনীন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হলেন, নিশ্চিন্ত হলেন। যোগ দিলেন চাকরিতে। আর্ট স্কুলের তিনতলায়, দক্ষিণ-খোলা একটি ঘরে আরামকেদারায় বসতেন তিনি। শুরু করলেন ভারতীয় চিত্রকলার ক্লাস। প্রথমদিকে তাঁর ভারতীয় চিত্রকলার ক্লাসে একেবারেই ছাত্র থাকত না। অবনীন্দ্রনাথ ক্লাসের সময় ছবি আঁকতেন, কখনও-বা আর্ট স্কুলের মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখতেন। মাটির বাসন, পাথরের মূর্তি, ব্রোঞ্জের মূর্তি, পুরনো ছবি—এমন কত কী!

আর্ট স্কুলে অবনীন্দ্রনাথ যে ছবি আঁকা শেখাচ্ছেন, পড়াচ্ছেন — এ খবর দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে ছাত্র বাড়তে থাকে। প্রথমে আসেন নন্দলাল বসু। পরে আরও কেউ কেউ। ক্রমান্বয়ে সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার, শৈলেন দে ও সমরেন্দ্র গুপ্ত। অবনীন্দ্রনাথ তাঁদের বলতেন, ‘পঞ্চপান্ডব’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

ছাত্র এলো আরও। দু’জন মুসলমান ছাত্র, এমনকি এলো এক মাদ্রাজি ছাত্রও। নিবিষ্ট হয়ে সকলে শিখতে থাকে ভারতীয় চিত্রকলার কৌশল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কালে বাংলার গভর্নর হয়ে এসেছিলেন লর্ড কারমাইকেল। শিল্পরসিক মানুষ তিনি। প্রায়ই আসতেন জোড়াসাঁকোয়। এই সময় হঠাৎই হ্যাভেল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শেষে ফিরে যান ইংল্যান্ডে। এ সময় অস্থায়ী প্রিন্সিপাল হিসেবে আর্ট স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মিস্টার পার্সি ব্রাউনের ওপর। অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর কোনওকালেই বনিবনা ছিল না। সে সময় অবনীন্দ্রনাথ মুসৌরি যাবেন বলে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। শেষ মুহূর্তে ছুটি মঞ্জুর হল না তাঁর। পার্সি ব্রাউন থাকবেন না। তাঁর অনুপস্থিতিতে অবনীন্দ্রনাথকে নিতে হবে প্রিন্সিপালের দায় দায়িত্ব, কর্তৃপক্ষ এমনই জানিয়ে ছিল। অবনীন্দ্রনাথ তাঁদের কথায় কান করেননি। দু’কথা শুনিয়ে সেদিনই চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। স্কুল-কর্তৃপক্ষ পড়েছিল মহাবিপদে।

অসিতকুমার হালদার।

অবনীন্দ্রনাথ ছাড়া ভারতীয় চিত্রকলা শেখাবেন কে! নন্দলালরা আর্ট স্কুল ছেড়ে জোড়াসাঁকোয় এসে শিল্পগুরুর কাছে কাজ শিখতে শুরু করলেন। সারাক্ষণই জোড়াসাঁকোয় ছাত্রদের আনাগোনা চলতে থাকত। দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় ছাত্রদের ভিড় লেগেই থাকত। সব ছাত্রই আর্ট স্কুলের।

ছাত্রদের উপস্থিতিতে জোড়াসাঁকোয় শিল্পচর্চার ধুম লাগল। বাড়ির সাজসজ্জাও পাল্টে গেল। দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হল ভারতীয় পদ্ধতিতে আঁকা ছবি। ইতালিয়ান মার্বেল মূর্তির জায়গায় বসল পাথরের মূর্তি, ব্রোঞ্জের মূর্তি। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রদের সাহায্য নিয়ে বাড়ির চেহারাই পাল্টে দিয়েছিলেন।

কেমন চলছে শিল্পচর্চা, তা দেখতে অবনীন্দ্রনাথের সাহেব-বন্ধুরা শনি-রবিবার নিয়ম করে জোড়াসাঁকোয় আসতেন। চলত আলাপ-আলোচনা, আপ্যায়নেরও ঘাটতি হত না। দেওয়া হত গরম নিমকি, সঙ্গে চা। সেদ্ধ কড়াইশুঁটি দিয়ে খাওয়া হত চিঁড়ে-ভাজা। অবনীন্দ্রনাথের হাতে তৈরি হল বেশ কয়েকজন নতুন শিল্পী। ভারতীয় শিল্পকলাকে তাঁরাই করেছিলেন পুনরাবিষ্কার।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content