শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আরডি ও লতা।

পঞ্চমের বাংলা আধুনিক গানের সম্ভারের অবতারণা করতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক দশক। কখনও স্বপন চক্রবর্তী, কখনও গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, আবার কখনও বা পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শচীন ভৌমিক অথবা মুকুল দত্তের লেখায় সুর বসিয়ে অগুন্তি চিরনবীন গানের জন্ম দিয়েছেন পঞ্চম। সেই সব গানের মধ্যে কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে বাবা শচীন দেব বর্মণের জীবৎকালেই। পুত্রের প্রতিভা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন বইকি? গানগুলির ক্ষেত্রে পুত্রের সাফল্য এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা তাঁকে বিশেষ ভাবে গর্বিত করে তুলেছিল।

একাংশের কথায়, পরিচিত মহলে পুত্র টুবলুকে নিয়ে রীতিমত আলোচনা করতে শোনা যেতো তাঁকে। কিন্তু তা মোটেই তাঁর পুত্রের উপস্থিতিতে নয়। তবু নানা সূত্রে সেই খবর পঞ্চমের কানে ঠিকই পৌঁছত, যা তাঁকে যারপরনাই অনুপ্রেরণা যোগাত। বাবার কাছ থেকে নিজের প্রশংসার কথা, সেটি প্রত্যক্ষভাবেই হোক অথবা পরোক্ষভাবে, শুনতে কারই না ভালো লাগে। পঞ্চমেরও ভালো লাগতো। উদ্বুদ্ধও হতেন। সেগুলিই ছিল তাঁর প্রেরণার উৎস।
ধরা যাক ‘আমার মালতী লতা কি আবেশে দোলে’ গানটি। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে এই বাংলা গানটি আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আবার, একই সুর ব্যবহার করে পঞ্চম ‘হামারে তুমহারে’ ছবির ‘হাম আউর তুম থে সাথী’ গানটি তৈরি করেছেন। গাইয়েছেন কিশোর কুমারকে দিয়ে। একই সুর। কিন্তু গানের ভাষা এবং বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ আলাদা। আলাদা গায়ক গায়িকাও। দুটি ক্ষেত্রে সুরের প্রভাবও ভিন্ন। বাংলা গানটিতে অনুভূত হয় যুবতী মনে লাগা প্রথম প্রেমের ছোঁয়া। আর কিশোরের গাওয়া হিন্দি ছবির গানটি আপাদমস্তক গভীর এক বিরহে মোড়া। এখানেই সুরকারের কৃতিত্ব। একই সুরের কাঠামোকে আনন্দ এবং দুঃখ, দুই আবহেই একই পারদর্শিতায় ব্যবহার করতে গেলে নিছক প্রতিভার থেকেও বোধহয় আরও অন্য কিছুর প্রয়োজন হয়। যদি জিজ্ঞেস করেন সেটি কি, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা কঠিন। কিন্তু সেটি এমন কিছু, যেটি পরমেশ্বর হাতে গোনা কিছু ক্ষণজন্মাকে উপহার হিসেবে দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন। যেটি সারা জীবনের অধ্যাবসায় দিয়েও অর্জন করা অসম্ভব।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬২: বুক ভরা মোর কান্না দিয়ে দিলাম চিঠি লিখে…

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ

‘সন্ধ্যা বেলায় তুমি আমি বসে আছি দুজনে’। আশা ভোঁসলের গাওয়া এই গানটির আবেদন যে ঠিক কতখানি, সেটি আমি বলব না। আপনারাই না হয় বলুন। এই গান ভরা যৌবনেও যেমন মনে দোলা দিয়ে যায়, তেমনই প্রৌঢ়ত্যে পৌঁছে যাওয়া কাউকে মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা জীবনের প্রেমের কিছু সুখানুভূতি। গানের সুর যদি কোনও বিশেষ অনুভূতিকে উসকেই না দিতে পারল, তবে সেই সুরের সার্থকতা কোথায়?

পঞ্চমের নিজের গাওয়া ‘বলো কি আছে গো তোমারই আঁখিতে’ গানটি তাঁর রাগ রাগিণীর প্রতি সুগভীর দখলের একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র। সুরের বিন্যাসটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। গানটি তো সেই অর্থে বেশ কয়েক দশক আগের। কিন্তু এটির জনপ্রিয়তা একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। এখনও নবাগত সংগীতশিল্পীরা এই গানটি গাইবার চেষ্টা করেন। গানটি থেকে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন। গানটিকে নিয়ে গবেষণা চলে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬২: ক্রৌঞ্চবধের বিষাদ কী ছেয়ে আছে রামায়ণের প্রেক্ষাপট?

আশার গাওয়া সেই বিখ্যাত গান, ‘ফুলে গন্ধ নেই, সে তো ভাবতেও পারি না’।গানটিতে গায়িকার কণ্ঠের মিষ্টতা এবং সুরকারের সুরের মিষ্টতা, দুইয়ের মধ্যে যেনো চলে এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। সারা গানটি জুড়ে। ইন্টারলুডগুলিকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন। লক্ষ্য করুন ফিলার গুলিকেও। এই গানটি আজও বাংলা সংগীতের অসীম আকাশে একটি ধ্রুবতারা হয়ে রয়ে গিয়েছে।

পঞ্চমের নিজের গাওয়া ‘কি হবে আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে’ গানটিতে প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের এক নিদারুণ অভিমান এবং প্রেমিক মনের বেদনা, এই দুই-ই সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কি অসাধারণ মেলোডি। তার সঙ্গে পঞ্চমের প্যাথোস মাখানো কণ্ঠের অভিব্যক্তি। বিশেষ করে অন্তরাগুলিতে। এই গান ভোলার নয়।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৫: কথার কথা মা নয়—সত্য জননী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা: কাঁকড়া, গরান ও গেঁওয়া

পুজো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা কিশোরকণ্ঠের উপহার ‘আকাশ কেন ডাকে মন ছুটি চায়’ গানটি কানে এলে ‘মন’ বোধহয় সত্যিই ছুটি চায়। এ যেন মনের এক ন্যায্য আবদার। সেই আবদার মেটাতে আমরা বাধ্য। যেমন গৌরীবাবুর লেখা, তেমনই পঞ্চমের মেলোডি। কিশোর কুমার যথারীতি অপ্রতিরোধ্য। কোনও এক অজানা কারণে মনে তৈরি হয় একটি খুশির আবেশ।

‘তুমি কত যে দূরে, কোথা যে হারিয়ে গেলে’ গানটির মেলোডি বাংলার, তথা সারা ভারতের শ্রোতাদের মনে যে চিরস্থায়ী পদচিহ্ন রেখে গিয়েছে, সেটিকে মুছে ফেলে কার সাধ্য। সারা ভারতবর্ষের কথা এই কারণেই বলছি কারণ, পঞ্চম এই একই মেলোডি হিন্দি ছবি ‘সাগর’ এর জলপরী থিমের জন্য ব্যবহার করেছিলেন। যে দৃশ্যে নায়ক ঋষি কাপুর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন একটি জলাশয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা নায়িকা ডিম্পল কাপাডিয়ার দিকে। ট্রামপেট এবং ইলেকট্রিক লিড গিটারে বেজে চলে ইন্ট্রো। আর তারপরই আরম্ভ হয় পঞ্চমের সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া উপস্থাপনা। সঙ্গে বাস গিটারের গাম্ভীর্য।

অন্তিম অংশে কোরাসের মূর্ছনা। এ যেন সেই গুপি-বাঘার গানের মতো। প্রায় সাড়ে পাঁচ মিনিট ধরে কোনও এক অদৃশ্য জাদুর বলে আমরা বাকরুদ্ধ এবং গতিরুদ্ধ হয়ে পরি। একটি ঘোরের মধ্যে চলে যাই আমরা। গানটি শেষ হয়ে গেলেও সেই ঘোর কিছুতেই যেনো কাটতে চায় না। রেশটি থেকে যায় তারপরেও। বেশ কিছুক্ষণ।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content