রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আজ পুজো। ঠাকুরের পুজো। ভালোবেসে সখী নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে, একদা বলেছিলেন তিনি। তো তাঁর আত্মজনেরা তা লিখেছেন। আসলে পৃথিবীর ইতিহাসে মহামানব, যুগপুরুষ, অবতার কিংবা মনীষীরা খুব বেশি আসেন না। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি, তখন তাঁরা আসেন। তবে সে কোটিতে গুটি। অপকম্মের ফুল জমতে জমতে পাথর হয়ে যায় যখন, তখন তাঁরা আসতেন। পুরাকালে এঁদের আবির্ভাব নিয়মিত ছিল। তারপর দেখা গেল, সকলেই পোটেনশিয়াল মহামানব। সকলেই সব জানেন, সব পারেন। এই করে করে সমাজ হিরণ্ময় হিরোদের পেতে শুরু করল। তার ফাঁকে ফাঁকেও কেউ কেউ এলেন, দেখলেন, অনায়াসে জয় করলেন ধর্মে অর্থে কামে মোক্ষে।
পুরাণবিদ কলিযুগের ধর্মাধর্মের বিচার করেন। হিস্টোরিয়ান লাভালাভ আর অর্থ অনর্থের তত্ত্বকে প্রাচীন থেকে আধুনিক হয়ে উত্তরাধুনিকের উত্তরোত্তর পরিবর্তনের মানদণ্ডে মাপেন। জন্মজর্জর মৃত্যুকঠিন ধরণীর ধূলিতলে মানুষের অবিশ্রান্ত আনাগোনা, তারপর অপরাহ্নে নুয়ে পড়া।
আজকের পৃথিবী ঋষি, যুগাবতারদের কথা শোনে। এঁরা ক্লিষ্ট মর্ত্যলোকে কিছু অলকার বার্তা জানিয়ে যান। এই করে করে মানুষ দেবতা হয়, এই করে করে তার অলৌকিক শক্তি নিয়ে কৃপাময়, মহাকরুণাঘন হয়ে ওঠা, ‘বাদ’ বা ‘ইজমের’ চাপে তখন বাদ পড়ে যায়, চাপা পড়ে যায় অনেককিছু।
আজকের পৃথিবী ঋষি, যুগাবতারদের কথা শোনে। এঁরা ক্লিষ্ট মর্ত্যলোকে কিছু অলকার বার্তা জানিয়ে যান। এই করে করে মানুষ দেবতা হয়, এই করে করে তার অলৌকিক শক্তি নিয়ে কৃপাময়, মহাকরুণাঘন হয়ে ওঠা, ‘বাদ’ বা ‘ইজমের’ চাপে তখন বাদ পড়ে যায়, চাপা পড়ে যায় অনেককিছু।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩২: কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার
আধুনিক বিশ্ব বহু ক্ষণজন্মা মনীষীদের দেখেছে, হয়তো দেখছে। তাঁরা দোষ-গুণে আক্রান্ত মানুষ হয়েও সিদ্ধ হন, খ্যাতকীর্তি হন, পুজো পান, মর্মর মূর্তিতে শোভিত হন, আবার মূল্যায়িত-প্রচারিত-পণ্যায়িত হন না, অস্তমিত হন; ব্যক্তিপুজোর দুনিয়ায় এটিই আইন।
রবীন্দ্রনাথ মনীষী? ঠাকুর? যুগপুরুষ? রবীন্দ্ররচনাবলীতেই তাঁর সর্বস্ব আটকে গিয়েছে? আকাশ পানে কাহার তরে হাত বাড়ানো কোনও শাপগ্রস্ত যক্ষের অকৃত্রিম আনন্দমগ্ন কল্পনাই কেবল রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ মানেই জীবত্কালে ছায়াতরু কিংবা পারিজাত হয়ে ওঠা? রবীন্দ্রনাথ মানেই পৃথিবী থেকে দু’ আঙুল উপরে চলা একটা দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা তাত্ত্বিক দর্শন?
রবীন্দ্রনাথ মনীষী? ঠাকুর? যুগপুরুষ? রবীন্দ্ররচনাবলীতেই তাঁর সর্বস্ব আটকে গিয়েছে? আকাশ পানে কাহার তরে হাত বাড়ানো কোনও শাপগ্রস্ত যক্ষের অকৃত্রিম আনন্দমগ্ন কল্পনাই কেবল রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ মানেই জীবত্কালে ছায়াতরু কিংবা পারিজাত হয়ে ওঠা? রবীন্দ্রনাথ মানেই পৃথিবী থেকে দু’ আঙুল উপরে চলা একটা দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা তাত্ত্বিক দর্শন?
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন
হ্যাঁ, অথবা না। তিনি প্রখ্যাত আবার অজ্ঞাত-ও। তিনি প্রত্যক্ষদৃশ্য জগতের মতোই সত্য অথচ একটা মিথ্যে মায়ার অদ্ভুত পাকে পাকে আচ্ছন্ন গুরুদেব। দোষ-গুণ, মান-অপমান, জন্ম-মৃত্যুর ভালো-মন্দ তাঁকে ছুঁয়ে গেছে অবিরাম। পুণ্যশ্লোক হয়ে ওঠাতে তাঁর সার্থকতা নয়, জনপ্রবাহকে ছুঁয়ে সেই মহাপ্রবাহে লীন হওয়াতেই তাঁর কালজয়। মহীরুহ হয়েও তাই টাইটানিক নয়, সোনার তরীতেই তাঁকে পাওয়া যাবে বেশি।
দিনে দিনে মহাদানের যোগ্য হয়ে ওঠা, অবিশ্বাস্য ভাঙা-গড়া আর পরিণতির মাঝে, জীবন-মরণের সীমায় দাঁড়ানো এক বাউল কি রবীন্দ্রনাথ? আসলে তাঁর হাতে ধরা হাসির ফুলের হার আর একতারা, পায়ে লেগে থাকা মাটির গন্ধ দেখেও তিনি কি আর কী নন এই বোঝা না বোঝার বিস্ময়টা আজও জেগে আছে বলেই…।
দিনে দিনে মহাদানের যোগ্য হয়ে ওঠা, অবিশ্বাস্য ভাঙা-গড়া আর পরিণতির মাঝে, জীবন-মরণের সীমায় দাঁড়ানো এক বাউল কি রবীন্দ্রনাথ? আসলে তাঁর হাতে ধরা হাসির ফুলের হার আর একতারা, পায়ে লেগে থাকা মাটির গন্ধ দেখেও তিনি কি আর কী নন এই বোঝা না বোঝার বিস্ময়টা আজও জেগে আছে বলেই…।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
এর মাঝে মানুষ আরও চিনে ফেলেছে নিজেকে, তার মর্ত্যলোককে, মানুষের নখদর্পণের বাইরে বোধহয় আর কণামাত্র ভূমি আর বিস্ময়বোধের অবশেষ থেকে যায়নি। যুদ্ধ লেগেছে অন্তরে, অন্দরে, বাইরে দূরে, শান্তির আলোয়, অশান্তির তাপে পৃথিবী আকণ্ঠ ডুবে আছে। তবু, মূল্যায়ন, পুনর্মূল্যায়ন—একটি বা অনেক অনেক সমীক্ষাও তাঁকে চিনতে পেরেছে কি?
পারেনি বলেই আজও বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তিনি মহামানবের চরণধ্বনি শোনেন, জানেন অচলায়তন থেকে তাসের দেশ ভেঙে পড়ার প্রকম্পিত অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, হেমন্তের অভিশম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি অতিক্রম করে করে যিনি বসন্তের সবুজে অক্লেশে মিশিয়ে দেন নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে যূথীগন্ধের অশান্ত সমীর, বসন্তের মাতাল সমীরণের জ্যোৎস্নারাতে “আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে” ভাবা সেই প্রাণকে বহু বাসনায় প্রাণপণে বুঝে উঠেও, পারা যায় না।
পারেনি বলেই আজও বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তিনি মহামানবের চরণধ্বনি শোনেন, জানেন অচলায়তন থেকে তাসের দেশ ভেঙে পড়ার প্রকম্পিত অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, হেমন্তের অভিশম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি অতিক্রম করে করে যিনি বসন্তের সবুজে অক্লেশে মিশিয়ে দেন নিদারুণ বিচ্ছেদের নিশীথে যূথীগন্ধের অশান্ত সমীর, বসন্তের মাতাল সমীরণের জ্যোৎস্নারাতে “আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে” ভাবা সেই প্রাণকে বহু বাসনায় প্রাণপণে বুঝে উঠেও, পারা যায় না।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২২: সরলাদেবী, এক পণ্ডিত মানুষ
এই না পারাটাই তাঁর জয়, বঞ্চনা যাঁকে বাঁচিয়ে রাখে, অতি ইচ্ছার সঙ্কটমুক্তির গান যাঁর জীবনবেদ, কাব্যলক্ষ্মী আর মানসসুন্দরীর সুদূরের আহ্বান আর ‘তোমার’ জয়কেই ‘আমার’ জয় বলে যিনি জানেন সেই ছকভাঙা তাঁকেই আমরা চিরনতুনের পঁচিশে বৈশাখে প্রশস্তি, পুজো, আলখাল্লা, দাড়ি, নোবেল আর বিশ্বমানবতার ছাঁচে ফেলি, কিন্তু মূর্তিটা বের করতে পারি কই?
এই না পারাটাই তো এতোটা বছর পরেও তাঁকে ভুলতে দেয় না, বারে বারে প্রতিবছর সেই মরীচিকা হাতছানি দেবে আর, আমরা ঝড়ের রাতে সুদূর নদীর পারে, গহন বনের ধারে, গভীর অন্ধকার পার হতে হতে আশ্বস্ত হবো, “জানি, বন্ধু, জানি— তোমার আছে তো হাতখানি।”
এই না পারাটাই তো এতোটা বছর পরেও তাঁকে ভুলতে দেয় না, বারে বারে প্রতিবছর সেই মরীচিকা হাতছানি দেবে আর, আমরা ঝড়ের রাতে সুদূর নদীর পারে, গহন বনের ধারে, গভীর অন্ধকার পার হতে হতে আশ্বস্ত হবো, “জানি, বন্ধু, জানি— তোমার আছে তো হাতখানি।”
* লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানেও একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, করছেন অলংকরণ।