প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ। ত্রিপুরা।
১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি ত্রিপুরা পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। সে সময় ত্রিপুরা রাষ্ট্রপতির শাসনাধীন ছিল। সেদিন আগরতলায় অসম রাইফেলস ময়দানে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক বিশাল জনসভায় ত্রিপুরাকে পূর্ণ রাজ্যের ঘোষণা দেন। রাজ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দাবিতে রাজ আমল থেকেই যে আন্দোলন চলছিল ত্রিপুরার ভারতভুক্তির পর পর্যায়ক্রমে রাজ্যবাসী তার সুফল পেতে থাকেন। প্রথমে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের জন্য আঞ্চলিক পরিষদ, পরে বিধানসভা এবং সর্বশেষে ত্রিপুরাকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে তার পূর্ণতা ঘটে।
পূর্ণ রাজ্য ঘোষণার পরই রাজ্যে ভোটের দামামা বেজে উঠে। পূর্ণ রাজ্য ত্রিপুরার বিধানসভার সদস্য সংখ্যা হয় ৬০। অর্থাৎ আগের চেয়ে দ্বিগুণ। রাজনৈতিক তৎপরতাও বেশি। প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল কংগ্রেস এবং সিপিএম পুরোদমে আসরে নেমে পড়ে। বলাই বাহুল্য, পূর্ণ রাজ্যোত্তর বিধানসভার ভোট এক পৃথক মাত্রা পায় সে বার। বাহাত্তরের নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেস শিবিরের নেতৃত্বে ছিলেন সুখময় সেনগুপ্ত।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৯: একাত্তরে ত্রিপুরা, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন
১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর বিরাগভাজন হয়ে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের ক্ষমতা থেকে ছিটকে যাবার পর স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর তেমন কোনও ভূমিকা থাকার কথা ছিল না। বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। সুখময়বাবু দ্রুত সেই স্থান পূরণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চিফ কমিশনারের শাসনকালে সুখময় সেনগুপ্ত পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই হিসেবে সুখময়বাবু রাজ্য প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেক আগে থেকেই।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত। ত্রিপুরা।
এক সময় আঞ্চলিক পরিষদে প্রশাসনিক ক্ষমতার কর্তৃত্ব নিয়ে শচীন্দ্র লাল সিংহ ও সুখময় সেনগুপ্তের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং দিনে দিনে তা তীব্র আকার ধারণ করে। সুখময়বাবু তখন জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে ত্রিপুরা কংগ্রেস নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। কেউ কেউ এমনটাও বলেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেসের প্রভাবে সেদিন ত্রিপুরা কংগ্রেস নামে পৃথক একটি দল গঠনে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সুখময়বাবু। তবে ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে ত্রিপুরা কংগ্রেস শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় কংগ্রেসে সুখময়বাবুর প্রত্যাবর্তন ঘটে। শচীন্দ্রলাল সিংহ ক্ষমতা থেকে ছিটকে যাবার পর নেতৃত্বে উঠে আসেন সুখময়বাবু। পূর্ণ রাজ্যোত্তর ত্রিপুরার প্রথম ভোটে তিনিই কান্ডারী, দলকে বিজয়ী করে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬২: বুক ভরা মোর কান্না দিয়ে দিলাম চিঠি লিখে…
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ
১৯৭২ সাল্র ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। কংগ্রেসের পক্ষে অবশ্য এই জয় প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ বাংলাদেশ যুদ্ধে সাফল্যের পর ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। স্বাভাবিক ভাবেই ইন্দিরার দল কংগ্রেস ভোটে তার ফসল কুড়োবে। বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪১টি আসন এবং সিপিএম ১৮টি, সিপিআই ১টি। ইন্দিরার নামে তখন ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ শ্লোগান, যুদ্ধ বিজয় এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ত্রিপুরাবাসীও আবেগ তাড়িত! কিন্তু এ রকম অবস্থাতেও সিপিএম’র ১৮টি আসন লাভকে তাদের পক্ষে এক বড় ধরণের সাফল্যই বলতে হবে। সেই তুলনায় ৪১ জন দলীয় বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত যে নিরাপদ নন তা সরকার চালাতে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্যই এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুখময়বাবু বলেছিলেন যে, তিনি সুপারির উপর বসে আছেন।
ত্রিপুরা বিধানসভা।
রাজ্য বিধানসভায় তখন অনেক নতুন মুখ। কারণ বিধানসভার আসন সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। কংগ্রেস এবং সরকারি ক্ষমতার শীর্ষে দীর্ঘদিন শচীন্দ্রলাল সিংহ থাকার পর এবার সুখময়বাবু। কিন্তু দলে তাঁর বিশ্বস্ত অনুগামীর সংখ্যা শচীন্দ্র সিংহের তুলনায় কম ছিল বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। কংগ্রেসের বিধায়কদের অনেকেই মন্ত্রী হতে চান, সুখময়বাবুর পক্ষে যা পূরণ করা সম্ভব ছিল না। এইভাবে কংগ্রেস পরিষদীয় দলে ক্রমেই সুখময়বাবুর বিরোধীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ঘরে বাইরে তখন মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল প্রতিপক্ষ। সিপিএম-এর বিধায়কদের সংখ্যা মোটেই নগণ্য নয়। সর্বোপরি নৃপেন চক্রবর্তীর মতো মানুষ বিরোধী দলনেতা।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?
প্রতিটি ইস্যুতেই সুখময়বাবুকে প্রবল বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হতো। ত্রিপুরার আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও তখন মোটেই সুখকর ছিল না। গ্রাম-পাহাড়ে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। স্হানীয় কাগজে প্রায়ই অনাহার মৃত্যুর সংবাদ বের হতো। খরা, বন্যায় মানুষ ছিলেন দিশেহারা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুখময়বাবুর সরকার যতটা তৎপর ছিলেন সম্ভবত সে তুলনায় তার বেশি তৎপরতা ছিল বিরোধীদের দমনে। সিপিএম অবশ্য নানা ইস্যুতে তখন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কংগ্রেসের সুখময়বাবুর বিরোধীরা প্রকাশ্যে না হোক, অন্তত ভিতরে ভিতরে বিরোধীদের আন্দোলনের সাফল্যই কামনা করতেন।
তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা নৃপেন চক্রবর্তী।
সুখময়বাবুর রাজত্বকালে ত্রিপুরায় সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছিল। বিরোধীদল প্রভাবিত কর্মচারী সংগঠনের মিছিল-মিটিং-এ উত্তাল হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরা। কর্মচারীরা লাগাতর ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। বিরোধীদল যেমন কর্মচারীদের আন্দোলনকে মদত দিতে থাকে, তেমনই কংগ্রেসের সুখময়বাবুর বিরোধীরাও চাইছিলেন কর্মচারীদের আন্দোলন যেন সার্বিক সাফল্য লাভ করে এবং সুখময়বাবুর নেতৃত্বাধীন সরকার সংকটের মুখে পড়ে। —চলবে।
ত্রিপুরা তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে পান্নালাল রায় এক সুপরিচিত নাম। ১৯৫৪ সালে ত্রিপুরার কৈলাসহরে জন্ম। প্রায় চার দশক যাবত তিনি নিয়মিত লেখালেখি করছেন। আগরতলা ও কলকাতার বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে ইতিমধ্যে তার ৪০টিরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরা-সহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের ইতিহাস ভিত্তিক তার বিভিন্ন গ্রন্থ মননশীল পাঠকদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়ও সে-সব উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সম্পর্ক, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক রচনা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ব্যতিক্রমী রচনা আবার কখনও স্থানীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ সমূহের বিষয়বস্তু। সহজ সরল গদ্যে জটিল বিষয়ের উপস্থাপনই তাঁর কলমের বৈশিষ্ট্য।