শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি।

 

বিচ্ছেদ

বিনয়কান্তি সেদিন প্রায় সারাটা দিন স্বর্ণময়ীর ঘর থেকে বের হননি। ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছেন। নার্সরা ক্ষণে ক্ষণে ওষুধ দিয়েছেন। খাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। আজ প্রায় ৩-৪ দিন স্বর্ণময়ী কিছু খাননি। ড্রিপ চলছে। চিকিৎসকরা রাইসটিউব দেওয়ার কথা ভাবছেন। বিনয়কান্তি শুনেছেন, কিন্তু হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি। আজ সকাল থেকেই বিনয়ের মনটা বড় অস্থির। স্বর্ণময়ীর ঘর ছেড়ে স্নান করতে যাওয়ার কথা ভাবেননি। আজ বিনয়কান্তিও কিছুই খাননি। সুরঙ্গমা দু-তিনবার এসে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। বিনয়কান্তি নিঃশব্দে শুনেছেন, সুরঙ্গমার কথা শেষ হতে হাতটা সামান্য তুলে না বলেছেন। বিনয়কান্তির অমত খুবই স্পষ্ট। চিরটাকাল। দু’বার বলবার দরকার হয় না। আজ তারকবাবু এসেছিলেন। অনেকক্ষণ বসেছিলেন বিনয়কান্তির সঙ্গে, স্বর্ণময়ীর ঘরে। স্বর্ণময়ীর ঘরে গিয়ে বসার জন্য বাইরের জুতো খুলে পা ধুয়ে হাত ধুয়ে তারপর সে ঘরে ঢুকতে হয়। বিনয়কান্তি ছাড়া তারকবাবু বা সুরঙ্গমা কখনও সখনও সে ঘরে যান।
বড় ডাক্তার দেখতে এলে তখন ফুলকাকা মা স্বর্ণময়ীর ঘরে ঢোকেন, বাকি সময়টা বাবার সঙ্গে লাইব্রেরি ঘরেই কাটান। ফুলকাকা এখন ভীষণ চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। কখনও সখনও তরুণকান্তির স্টুডিয়ো ঘরে গিয়ে বসেন। বাকি সময়টা বেশ সন্তর্পণে থাকেন। কোনওভাবেই ন’কাকিমা সুজাতা বা প্রণয়কান্তির মুখোমুখি হতে চান না ফুলকাকা। সন্ধে থেকে অনেকটা রাত পর্যন্ত আমাদের ঘরগুলোয় মা বা আমার সঙ্গে গল্প করে কাটান। আর হ্যাঁ, মাঝেমধ্যেই সময় পেলে সানন্দার ক্লিনিকে চলে যান।

বাবা একটা কথা প্রায় বলতেন। অদ্ভুত কথা। বলতেন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কিসে বলো তো? এ প্রশ্নের খুব চেনা উত্তর আসতো। অভাব দুর্ভাগ্য অঙ্গহানি বা মৃত্যু। বাবা বলতেন না। কেন না, সেটাও সবিস্তারে বুঝিয়ে বলতেন। অভাব নিজের চেষ্টা দিয়ে সক্ষমতা দিয়ে কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা যায়। নিজের দুর্ভাগ্যকে মানুষ নিজেই জয় করতে পারে। অঙ্গহানিজনিত অক্ষমতা যে কাটিয়ে ওঠা যায়, তার প্রমাণ ভুরিভুরি। আর মৃত্যু মানে তো পরিসমাপ্তি। তারপর তো আশা-আকাঙ্ক্ষা চাওয়াপাওয়া এসব থাকে না। তাহলে মানুষ সবচেয়ে ভয় পায় কিসে? বিশ্বাসঘাতকতায়। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা।
আরও পড়ুন:

দুই বাংলার উপন্যাস: ৩য় খণ্ড, পর্ব-১৪: ঠাকুমা স্বর্ণময়ীকে আবার বসুন্ধরা ভিলায় ফিরিয়ে আনা হল

চলো যাই ঘুরে আসি: চলো যাই ঘুরে আসি: সুইৎজারল্যান্ডে পাহাড়-ঘেরা বাতিজ্বলা সেই স্টেশনের নামটি ছিল সোল্লেরমিউলি

পশুপাখি একবার বিশ্বাস অর্জন করলে সেই বিশ্বাস ভাঙ্গে না। সে নির্ভরতা চিরকালীন। সে পারস্পরিক সম্পর্ক শাশ্বত। মানুষের ক্ষেত্রেও মানুষই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে আবার মানুষই সামান্য প্রাপ্তির লোভে সেই বিশ্বাস ভঙ্গ করে। সম্পর্ককে বিক্রি করে দিতে এতটুকু লজ্জা পায় না। তাই খুব কাছের কাউকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াটা ভয়ংকর আতঙ্কের। গুণী মানুষেরা অনেকবার বলেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো হল পাপ। কিছুটা কালিমা লিপ্ত জলে গোটা সমুদ্রের জল নষ্ট হয়ে যায় না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জিইয়ে রাখতে বন্ধুত্ব বা ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখতে এ সব কথা সত্যিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিশ্বাস জিনিসটা কাচের মতো সুকঠিন কিন্তু ভঙ্গুর। একবার ভাঙলে জোড়া হয়তো দেওয়া যায় সেই মেরামতি নিষ্কলুষ থাকে না। জোর করে জোড়ার দাগটা কিছুতেই মিলিয়ে দেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

বাড়ির নানারকম উত্থানপতনের মধ্যে সানন্দা আর অর্কপ্রভের মধ্যের বিবাহবিচ্ছেদের কথা ফুলকাকাকে আগে জানানো হয়নি। কিন্তু মা কীরা কাকিমার কাছে কিছু গোপন করেননি। কীরাকাকিমা সবটুকুই জানতেন। একদিন সানন্দা যখন বসুন্ধরা ভিলায় তখন কীরা কাকিমা ফোন করেছিলেন। সানন্দা আছে জেনে বহুক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও কীরা কাকিমা ফুলকাকাকে এসব নিয়ে কিছুই জানাননি। ওদের দু’জনকে দেখে আমার এক একসময় মনে হয় ঠিক বিবাহ বিচ্ছিন্ন হননি। দাম্পত্যের বিরতি নিয়েছেন ওঁরা কাকিমা আর ফুলকাকার মধ্যে কাগুজে বিচ্ছেদ হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা হয়নি। সেটা আমি জানতে চাইও না। আমি মনেপ্রাণে চাই সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে কীরা কাকিমা ফুলকাকা যেন আবার নিজেদের মনের দূরত্ব ঘুচিয়ে আগের মতো আবার কাছাকাছি ফিরে আসেন। কোনও একটা স্টাডিতে দেখা গিয়েছে, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বিবাহ-বিচ্ছিন্ন দম্পতি পরে নিজেদের বিবাহবিচ্ছেদকে জীবনের ভুল সিদ্ধান্তকে বলে মনে করেন। প্রায় দশ থেকে পনেরো শতাংশ বিবাহ-বিচ্ছিন্ন দম্পতি নিজেদের ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে আবার স্বাভাবিক দাম্পত্যে ফিরে আসেন। এমনটা ঘটবে কিনা জানি না কিন্তু আমি বা শ্রীতমা খুব খুশি হবো। আমার মা-বাবা আমার বোন সানন্দাও ভীষণ আনন্দ পাবে। দাদু ঠাকুমা… দাদু খুশি হবেন নিশ্চিত। কিন্তু ঠাকুমা স্বর্ণময়ী সব জাগতিক মোহ-মায়া টপকে গিয়েছেন। তিনি সজ্ঞানে জানতে পারলে ভীষণ খুশি হতেন। কীরা কাকিমা মেমসাহেব সেটা মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারটা মানতে পারেননি স্বর্ণময়ী।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

সারাদিন সঙ্গে সঙ্গে থেকেও আজীবনের সঙ্গী স্বর্ণময়ীকে ধরে রাখতে পারেননি বিনয়কান্তি দত্ত। ভোর রাতে একটুক্ষণ চোখ লেগে গিয়েছিল সারাটা রাত ঠাকুমার বিছানার পাশে ঠাকুমার হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বসেছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের কর্ণধার বিকেডি ওরফে বিনয়কান্তি দত্ত! যে হাত ধরে বিনয় জীবনের অনেক লড়াই জিতেছেন সেই হাত ধরে থেকেই বিনয় এ লড়াই হেরে গেলেন। ভোররাতেই কখন যে স্বর্ণ হাত ছাড়িয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন বিনয়কান্তি বুঝতেও পারেননি। আচমকা কী মনে হতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আচমকা একটা অজানা আশঙ্কা। স্বর্ণর হাতটা অস্বাভাবিক সাদাটে স্বর্ণ ভীষণ ফরসা কিন্তু তার শরীরের একটা গোলাপি লাবণ্য ছিল। এই সেদিন অসুস্থ হবার আগে পর্যন্ত। কিন্তু এখন সে ফ্যাটফ্যাটে সাদা স্বর্ণর হাতের গোলাপী আঙুলগুলো কেমন যেন সবজে নীল রঙের এমন কেন হবে বিনয়কান্তি গলায় যেন শব্দ নেই। বহু চেষ্টা করেও গলা থেকে কোন শব্দবের হচ্ছে না। আচমকা জোর করে চিৎকার করে উঠলেন বিনয়কান্তি—
—সিস্টার সিস্টার!
—চলবে।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com

Skip to content