ছোটদের সঙ্গে।
শিশুকে সুন্দর সুরক্ষিত একটি পৃথিবী দেবার অঙ্গীকার লিখিত ও অলিখিত ভাবে সবার ওপরই বর্তায়। কিন্তু কীভাবে দিনের পর দিন আমাদের পরিবেশ শিশুর প্রতিকূল হয়ে উঠছে সে খবর জানলে শিউরে উঠতে হয়। শিশু পাচার রুখতে কাজ করছেন নূপুর ঘোষ। কীভাবে শিশু পাচারকারীরা ভারত জুড়ে সক্রিয় থাকে তার নানা দৃষ্টান্ত শুনছিলাম ওর কাছে। অল্প বয়েসের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি এদের জালে পরে।
মায়ের সঙ্গে মতের মিল হল না। ছোট্ট মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। অভিমানে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবে ট্রেনে চেপে বসল। ছোট্ট মাথায় ভবিষ্যতের বিপদের চিন্তা নেই। শিয়ালদা নেমে প্লাটফর্মে বসে আছে। এ সব জায়গায় ভিড়ে মিশে থাকে সুযোগ সন্ধানীরা। হাবভাব দেখেই বুঝে যায়। পাশে বসে ভাব জমায়। মিষ্টি জল খেতে দেয়। তারপর সকালে ঘুম ভেঙে মেয়েটি নিজেকে এক অচেনা ঘরে আবিষ্কার করে। সেখান থেকে অন্য আরেক জায়গায়। সেখানে আরও একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। নেপাল থেকে আসা। এতক্ষণে দু’ জনে বুঝতে পেরেছে যে তারা খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছে। কোনও এক ফাঁকে দরজা খোলা পেয়ে দু’জনে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৯: পুর-হিতায় সংস্থিতা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!
রাস্তায় কোনও একজনের সহায়তায় মধ্যমগ্রামের মেয়েটি বাড়িতে ফোন করে। কিন্তু ততক্ষণে তারা ধরা পরে গিয়েছে আবার। মেয়ে দুটিকে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে দূরে রাজস্থানের এক প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওই ফোনের সূত্র ধরে গোয়েন্দা পৌঁছে যায় দুষ্কৃতীদের কাছে। শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করা হয় অসমের এক গ্রাম থেকে। ইতিমধ্যে অনেক অত্যাচার হয়েছে তাদের ওপর। উদ্ধারের পর কিছুদিন তাদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা চলে। আবার বাড়িতে আগের মতো তাদের প্রতিষ্ঠা পেতে অনেক দিন লাগে।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও: পূর্বোত্তরে ইতিহাস ঐতিহ্যে হাতি
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ
এ সব গল্পের মতো লাগছিল শুনতে। এটি একটি ঘটনা। এমন ঘটনা কত ঘটে চলেছে। নানা ভাবে নানা জায়গায় চলছে চাইল্ড ট্রাফিকিং। একেবারে রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে সারাক্ষণ এ উদ্ধার কাজে ব্রতী রয়েছেন নূপুর। তার মতে, “এ রকম অবস্থা প্রতিরোধ করার জন্য শুধু বাবা-মাকেই সতর্ক থাকতে হবে এমনটি যথেষ্ট নয়। দরকার শিশুদের সচেতন করে তোলা ।আত্মরক্ষার পাঠ দেওয়া।” পথ শিশুদের জন্য নূপুর ব্যবস্থা করেছেন কারাটে শেখার। এছাড়া সচেতনতা শিবিরের। সেখানে গুড টাচ, ব্যাড টাচ, কোনও অচেনা লোকের দেওয়া খাবার না খাওয়া, অপরিচিত লোকের প্রলোভনে না পড়া—এসব নিয়ে শেখানো হয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি
দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সহজে প্রলোভনের শিকার হয়। তাদের সচেতন করা খুব কঠিন কাজ। তাদের বাবা-মাকেও বোঝাতে হয়। এ জন্য নূপুর তাদের স্কুলে আনার ব্যবস্থা করছেন। পড়াশুনো, ছবি আঁকা, আত্মরক্ষার পাঠ সবই একটু করে দেওয়া হয়। সাফল্য মিলেছে। অনেকেরই জীবনের মোড় ঘুরেছে। আত্মরক্ষা ও সচেতনতা—এ দুই পাঠেই রয়েছে এ ব্যাধির মুক্তি। আমরাও এই সচেতনতার পাঠ দেওয়ার কাজে সামিল হতে পারি। সমাজে শিশুকে সুরক্ষিত রাখার দায়বদ্ধতা সকলের। আসুন, আমরা কবির মতো বলি—
“…প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।”
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।”
* ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।