শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমা।
ভগবান অবতীর্ণ হন ভক্তের জন্য। তিনি আসেন, অপূর্ব লীলা করেন। তাঁর জীবনধারণ, সাধারণ মানুষের মতো। কিন্তু সাধন-ভজন লোকাতীত। লোক কল্যাণার্থে তিনি আনন্দ করেন, আনন্দ দেন। আবার চলেও যান। দেখিয়ে যান নতুন পথ। যাঁরা বুঝতে পারেন, ধরতে পারেন, তাঁরা ধন্য হন। এ তো তাঁর অপূর্বতা। শ্রীমায়ের স্বরূপ প্রসঙ্গ আসলে ঠাকুর অনেক ক্ষেত্রে চেপে যেতেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাই মজা করে বলতেন, ‘ছাই ছাপা বিড়ালের মত’।
নলিনী দিদি শ্রীশ্রী মাকে জিজ্ঞাসা করছেন, “পিসিমা লোকের কত ধ্যান, জপ হয় শুনি, আমার কিছু হয় না কেন? তোমার সঙ্গে এতদিন যে রইলাম কই আমার কি হলো?” শ্রীমা বলছেন, “ওদের হবে না কেন? খুব হবে। ওদের এত ভক্তি বিশ্বাস! বিশ্বাস ভক্তি চাই, তবে হবে। তোদের কি তা আছে?” নলিনী দিদি আবার জিজ্ঞেস করছেন, “আচ্ছা পিসিমা, লোকে যে তোমাকে অন্তর্যামী বলে, সত্যিই কি তুমি অন্তর্যামী? আচ্ছা, আমার মনে কি আছে বলতে পারো?” মা একটু হাসলেন। আবার নলিনীদিদি শক্ত করে ধরলেন। তখন মা বললেন, “ওরা বলে ভক্তিতে।” তারপর বললেন, “আমি কি মা? ঠাকুরই সব। তোমরা ঠাকুরের কাছে এই বলো (হাত জোড় করে ঠাকুরকে প্রণাম করলেন) আমার ‘আমিত্ব’ যেন না আসে।”
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬১: ভক্তি পথের পথিক আর ভক্তি লাভ এক নয়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪১: সুন্দরবনে বাঘে-মানুষে সংঘাত
নিরভিমান আর অহংকার শূন্যতার সমাবেশ। তিনিই এ জগতের পালন করছেন অথচ জীব কে, কি করে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হতে হয় তা শেখাচ্ছেন। মাতৃরূপ ধারণ করে, প্রকৃত মা হতে শেখাচ্ছেন।
মা ধরা ছোঁয়া সহজে দিতে চান না। আর আমাদের অহংকার ভরা মন। তাঁকে কী করে বুঝবো। তাঁকে বোঝার ক্ষমতা কোথায়। মায়ের বিশেষত্ব হল, মায়ের ভিতর অহংকার বিন্দুমাত্র ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “আমি ও আমার অজ্ঞান।” অহংকার শূন্যতা এ পর্যায়ে ছিল যে, তিনি ‘আমি’ বলতে পারতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত কোনও ইচ্ছে ছিল না। যা ছিল সর্বাত্মক ঈশ্বরের। ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রকাশিত হত। তিনি বলতেন, “হে ঈশ্বর তুমিই সব করছো। তুমিই আমার আপনার লোক। আর তোমার এই সমস্ত ঘরবাড়ি, পরিবার, আত্মীয় বন্ধু, সমস্ত জগৎ সব তোমার! এর নাম জ্ঞান। আর, আমি সব করছি, আমি কর্তা, আমার পরিবার, ঘরবাড়ি, ছেলেপুলে, বন্ধু, বিষয় এর নাম অজ্ঞান।”
মা ধরা ছোঁয়া সহজে দিতে চান না। আর আমাদের অহংকার ভরা মন। তাঁকে কী করে বুঝবো। তাঁকে বোঝার ক্ষমতা কোথায়। মায়ের বিশেষত্ব হল, মায়ের ভিতর অহংকার বিন্দুমাত্র ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “আমি ও আমার অজ্ঞান।” অহংকার শূন্যতা এ পর্যায়ে ছিল যে, তিনি ‘আমি’ বলতে পারতেন না। তাঁর ব্যক্তিগত কোনও ইচ্ছে ছিল না। যা ছিল সর্বাত্মক ঈশ্বরের। ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে প্রকাশিত হত। তিনি বলতেন, “হে ঈশ্বর তুমিই সব করছো। তুমিই আমার আপনার লোক। আর তোমার এই সমস্ত ঘরবাড়ি, পরিবার, আত্মীয় বন্ধু, সমস্ত জগৎ সব তোমার! এর নাম জ্ঞান। আর, আমি সব করছি, আমি কর্তা, আমার পরিবার, ঘরবাড়ি, ছেলেপুলে, বন্ধু, বিষয় এর নাম অজ্ঞান।”
আরও পড়ুন:
ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই
অহংকারনাশ সহজে হয় না। যতক্ষণ আমি বোধ আছে অহংকারও আছে। তাই অহংকার যাতে মাথা তুলতে না পারে তার সহজ পথ নির্দেশ করলেন। “তাই তাঁর পাদপদ্মে যাতে ভক্তি হয়, যাতে তিনিই আমার বলে ভালোবাসা হয় তাই করাই ভালো। সংসার দেখছ দু’দিনের জন্য আর এতে কিছুই নেই।”
বিচার এনে সংসারে অনাসক্ত হয়ে কী করে থাকা যায় তা বোঝানোর জন্য তিনি বলছেন, ভক্তেরা আপনারা লোক, তাদের জন্য কাজের বন্ধন না আসে তাই মনে ত্যাগ করতে ঠাকুর বলছেন। “উপরে থাকার চাইতে নিচে থাকা কি ভালো নয়! নীচের জমিতে জল জমে, উঁচু জমি থেকে জল গড়িয়ে চলে আসে।” অহংকারে মত্ত জীবের দম্ভের মাথা উপরেই থাকে। যার যে অহংকার মাথা নিচু করতে দেয় না, তার ভক্তির জলে জমে না; আর বিশ্বাসের চাষও হয় না।
বিচার এনে সংসারে অনাসক্ত হয়ে কী করে থাকা যায় তা বোঝানোর জন্য তিনি বলছেন, ভক্তেরা আপনারা লোক, তাদের জন্য কাজের বন্ধন না আসে তাই মনে ত্যাগ করতে ঠাকুর বলছেন। “উপরে থাকার চাইতে নিচে থাকা কি ভালো নয়! নীচের জমিতে জল জমে, উঁচু জমি থেকে জল গড়িয়ে চলে আসে।” অহংকারে মত্ত জীবের দম্ভের মাথা উপরেই থাকে। যার যে অহংকার মাথা নিচু করতে দেয় না, তার ভক্তির জলে জমে না; আর বিশ্বাসের চাষও হয় না।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৯: বিপরীত পরিস্থিতিতে পালিয়ে যাওয়াটাও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকার উপায়
শ্রীরামকৃষ্ণকে কেউ অবতার বললে তিনি বলতেন, এরা অবতারের বুঝে কি, যে অবতার বলে? তিনি সেই অহংকার যাতে না আসে, কত ভাবে তাঁকে সাধনায় পরিণত করা যায় তা দেখবার জন্য তাঁর চেষ্টার শেষ নাই। তিনি প্রার্থনা করে দেখাচ্ছেন, “ও রাম! ও রাম! আমি ভজনহীন, সাধনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীন—আমি ক্রিয়াহীন! ও রাম শরণাগত! ও রাম শরণাগত! দেহ সুখ চাইনে রাম! লোকমান্য চাইলে রাম! অষ্টসিদ্ধি চাইনি রাম। শতসিদ্ধি চাইনে রাম। শরণাগত! শরণাগত! কেবল এই করো—যেন তোমার শ্রীপাদপদ্মে শুদ্ধা ভক্তি হয়। আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ হই না! রাম। ও রাম শরনাগত!”
জীবের মঙ্গল সাধনের জন্য সাধারণ মানুষের মতো প্রার্থনা কী করে করলে ভক্তের অহংকারনাশ হয়, তা উত্তম বৈদ্য ঠিক জানেন।—চলবে।
জীবের মঙ্গল সাধনের জন্য সাধারণ মানুষের মতো প্রার্থনা কী করে করলে ভক্তের অহংকারনাশ হয়, তা উত্তম বৈদ্য ঠিক জানেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।