রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীমা।

মা সারদার ছোটকাকা নীলমাধব ছিলেন অকৃতদার। বৃদ্ধ বয়সে তিনি তাঁর আদরের সারুর কাছেই থাকতে চাইতেন। শ্রীমাও তাঁকে নিজের কাছে রেখে স্বয়ং পরিচর্যা করতেন। সেই সময়ে আম, ম্যাঙ্গোষ্টিন প্রভৃতি ফলাদি অসময়ে বেশি দাম দিয়ে কেনা হত। শ্রীমা অতি সামান্য ফল নিজের জন্য রেখে বাকি সব তাঁর খুড়োকে খেতে দিতেন। কেউ আপত্তি জানালে শ্রীমা বলতেন, ‘আমরা এখনও অনেক দিন পৃথিবীতে থাকব, অনেক খাবার সময় হবে। কিন্তু খুড়ো আর ক’দিন? ওর তো হয়ে এসেচে, ওর বাসনা শেষ করিয়ে দেওয়াই ভাল’।

কলকাতায় থাকার সময় শ্রীমা তাঁর পায়ের বাত ও ম্যালেরিয়া হয়েছিল বলে একদিন অন্তর গঙ্গা স্নানে যেতেন। বাগবাজারের বাড়িতে থাকার সময়ে তিনি প্রথমদিকে পালকিতে করে গণেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে স্নান করতে যেতেন। পরে নিবেদিতার বিদ্যালয়ের গাড়িতে যাতায়াত করতেন। মাঝেমধ্যে ওই গাড়িতে করেই অথবা ললিত চাটুজ্যের গাড়িতে তাঁকে আলিপুর মিউজিয়াম, গড়ের মাঠ প্রভৃতি জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হত। পরবর্তিকালে শ্রীমা যখন বাগবাজারে তাঁর নিজের বাড়িতে বাস করতেন, তখন গেলাপমার সঙ্গে হেঁটে গঙ্গায় যেতেন।
শ্রীমার মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবীর এখন বয়স হয়েছে। তাঁর ছেলেরা সবাই না হলেও মোটামুটি কাছাকাছিই থাকে। তবু নিয়মিত কেউ খবর রাখে না। ধানের গোলায় তাঁর ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ধান পড়ে আছে ওই পর্যন্ত। কিন্তু শাক-ভাতের সঙ্গে নুনও যে লাগে, তার ব্যবস্থা নেই। অনেকদিন মেয়েকে না দেখে জয়রামবাটি থেকে তিনি মেয়ের অবস্থা অনুমান করেন, মা তো! কিন্তু অভাবের সংসারে ছেলেদের নিজ-নিজ সংসার নিয়ে তাঁর জেরবার অবস্থা। তবু শ্যামাসুন্দরী শীতের শেষে মেয়ের খোঁজ নিতে একবার কালীকুমারকে পাঠান।

মা সারদা ভাইকে দিয়ে বলে পাঠান যে বেঁচে থাকলে পরে যাবেন। পরে দু-একদিনের জন্য জয়রামবাটি গিয়েছিলেন শ্রীমা। তাঁর ভাসুরপো রামলাল ঠাকুরের তিরোভাবের পর মার প্রতি আর তেমন খেয়াল রাখতেন না। তাছাড়া নিজের ভাইকে মা ফিরিয়ে দেওয়ায় ও তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী দেবীকে দেখার ইচ্ছে হওয়ায় তিনি দেশে যান। সেখান থেকে কামারপুকুর ফিরে এসে দেখেন যে, তাঁর ভাসুরপো রামলাল দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যাবার আগে বাড়িঘর থেকে গৃহদেবতা রঘুবীরের থান পর্যন্ত আলাদা করে দিয়ে গেছে। নিজেদের ভাগে তালা লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। শুধু কাকার ভাগের একখানি ঘর মা সারদার জন্য রেখে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

এমনকি, জমির ধান-চালও ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে। যেটুকু চাল আছে, তাতে আর কদিন চলবে ভেবে কপর্দকহীন সারদা মা শঙ্কিত হলেন। যে সর্বদা তাঁর সঙ্গে থাকত, যাদের জুড়িকে ঠাকুর বলতেন ‘শুক-সারি’, সেই লক্ষ্মীও এখন যেন কেমন হয়ে গেছে। শ্রীমার থেকে এখন সে তার দাদা রামলালের কথায় ওঠে-বসে। মার থেকে যেন সে হঠাৎ দূরে সরে গেছে। ভেঙে গেছে ঠাকুরের শুক-সারির বন্ধন।

শ্রীমা এসব দেখে মনে মনে অবাক হন আর কষ্ট পান। ঠাকুর অমৃতলোকে যাত্রার দুবছর অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই এত পরির্বতন ঘটে গেছে মা সারদার জীবনে। জয়রামবাটি তাঁর পিতৃভিটে হলেও এখন তাঁর ভায়েদের সংসার। অভয় কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করলেও মায়ের বাকি ভাইরা প্রত্যেকেই তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাতা শ্যামাসুন্দরী শ্রীমার ভায়েদের সংসারে হয়েছেন ভাগের মা। মা সারদা এখন অসহায় নিঃস্ব বিধবা দিদি। মায়েরও কি ‘দাদার সংসারে তাঁর প্রিয় বিধবা ভানুপিসির অবস্থা মনে পড়েছিল’? তা কে বলতে পারে! কিন্তু সারদা মা জয়রামবাটিতে এলেন অন্য ভূমিকায়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৪: নারী দিবস ও শিবরাত্রি

পিতৃহীন নিজগৃহে ভাইদের সংসারে অবাঞ্ছিত বিধবা বোনের বাড়তি বোঝা হয়ে নয়। আশ্রিতার হীনমন্যতা নিয়েও নয়। সারদা মা এলেন মমতাময়ী মা শ্যামাসুন্দরীর আদরিণী কন্যা রূপে। কৃতজ্ঞ ভাইদের ও তাদের পরিবারের অতি কাঙ্ক্ষিত প্রিয়দিদি হিসেবে। জয়রামবাটিতে গিয়েও সারদা মা কাজ ছাড়া বসে থাকতে পারেন না। বাড়িতে তাঁর ভাজেরা ছাড়াও গোয়ালা, ঘরামি আর জমিতে কাজের লোক থাকলেও শ্রীমা বোঝেন, সারা বাড়িতে যেন লক্ষ্মীশ্রীর অভাব। মা শ্যামাসুন্দরীর বাহান্ন-তিপান্নর কাছাকাছি বয়স হয়েছে, তাই সংসারের সবদিক দেখতে পারেন না।

১৩১২ সালে মা সারদা প্রথমবার বিষ্ণুপুরের পথ ধরে দেশে যান। তখন বিষ্ণুপুর দিয়ে বেঙ্গল-নাগপুর রেলপথ খুলে দেওয়া হয়েছে। ওই বছরই মাঘমাসের প্রথম সপ্তাহে সারদাজননী শ্যামাসুন্দরী দেবী লোকান্তরিত হন। সেদিন সকালে শিরোমণিপুর থেকে জনৈক মহিলা সব্জি বিক্রি করতে এসেছিল। শ্যামাসুন্দরী দেবী তার কাছ থেকে কিছু সব্জি কেনেন। আর জ্ঞাতি সম্পর্কে তাঁর নাতি হয়, এমন কয়েকজন বালকের সঙ্গে তিনি নাচ-গান করে হাস্যচ্ছলে পরিহাসও করেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৫: রবি ঠাকুরের বড় মেয়ে— যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

বালকেরা পিছন থেকে তাঁকে ‘ঠাকুমা’ বলে ডাকাডাকি করতে থাকলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে তাদের বলেন যে, তারা কি বলতে চায়, তাঁর এখন দাঁড়াবার সময় নেই। ‘পোড়ারমুখোরা আমার বেহারা হবি’, একথা বলে তিনি চলে যান। বাড়িতে গিয়ে দেখেন যে, ঢেঁকিতে ধান ভানা হচ্ছে। তিনিও সেই কাজে সাহায্য করতে থাকেন। কাজ শেষ হওয়ার পর শৌচে যান, তারপরই অস্বস্তি বোধ করায় দাওয়ায় শুয়ে পড়েন। সজ্ঞানে কথা বলে বেলা দশটার মধ্যে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ সময়ে নাতিতুল্য ভক্ত আশুতোষ ও আদরের মেয়ে সারুর হাতের গঙ্গাজল চেয়ে খান। তিনি যাবার কালে বলেছিলেন যে, কুমড়োর ঘ্যাঁট খেতে ইচ্ছা করছে। তাই তাঁর শ্রাদ্ধে প্রচুর পরিমাণে কুমড়োর ঘ্যাঁট করা হয়েছিল। এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দ ১৩১২ সালের ১২ মাঘ তাঁর দিনলিপিতে লিখেছিলেন, ‘As you went to Jairambati this morning with purchases for Didima’s Sraddha’. তিনি শ্রাদ্ধের জন্য কলকাতা থেকে তিন গরুর গাড়ি বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন।

অন্তরঙ্গ শিষ্য-সেবক স্বামী যোগানন্দ, প্রিয় ছোট ভাই অভয়, তাঁর ছোটকাকা নীলমাধব এবং গর্ভধারিণী জননীকে হারিয়ে মা সারদা গভীর দুঃখে আর্তনাদ করে ক্রন্দন করেছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content