বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪


দেশ মাতাকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে সমগ্র ভারতের সঙ্গে অসমও স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। যাঁদের আত্মবলিদানে আমরা স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণ করতে পেরেছি তাঁদের আমাদের মনে রাখতে হবে। শুধু ইংরেজরাই তো নয়, আরও অনেক বিদেশি শত্রুরা ভারতকে আক্রমণ করেছে। ইতিহাসের বইয়ে সেই সব পর্যায়ক্রমে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া এক সময় দেশের সব প্রদেশেই ভিন্ন ভিন্ন রাজাদের রাজত্ব ছিল। অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল প্রবল। শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য রাজাদের সতর্ক থাকতে হত। দেশ, রাজ্য, নিজের জাতির জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে শিবসাগর জেলার আহোম রাজা গদাপানীর স্ত্রী জয়মতি দেবীর কথা বলতে হয়। লালুক সোলা নিজস্বার্থ রক্ষার জন্য ১৪ বছরের এক ছোট ছেলের রাজ অভিষেক করিয়ে নাম দেন রত্নধ্বজ সিংহ। বয়স কম হওয়ার জন্য তিনি লরা রাজা নামে পরিচিত ছিলেন। সেই লালুক সোলার পরামর্শে, লরা রাজা অন্যান্য রাজা, রাজকুমারদের অঙ্গছেদ কিংবা হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। রাজা গদাপানী ছাড়া সব রাজকুমারদের হত্যা কিংবা অঙ্গছেদ করা হয়েগেছিল। জয়মতী তাঁর দুই ছেলে এবং স্বামীকে রাজ্য এবং প্রজাদের তোহাই দিয়ে নাগা পাহাড়ে আত্মগোপন করতে পাঠান। কারণ, তিনি জীবিত থাকলে তবে না তাঁর রাজ্য এবং প্রজারা থাকবে।

লরা রাজার সিপাহীরা জয়মতীকে বন্দি করে অকথ্য অত্যাচার করে। কিন্তু তিনি সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে অবশেষে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর এই ত্যাগের জন্য অসম তাঁকে মনে রাখবে। শুধুই স্বামী-পুত্রের জন্য তাঁর এই বলিদান ছিল না, আহোম রাজ্যের অস্থির, ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতেই তিনি নিজেকে শত্রুর হাতে তুলে দেন। দেখতে গেলে সতী জয়মতী অসমের প্রথম মহিলা শহীদ। তাই অসমে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই তাঁর বলিদানের কথা উল্লেখ করতে হয়।
আহোম রাজত্বকালে মোঘলরা ১৭ বার অসম আক্রমণের করেও সফল হয়নি। বার্মা আক্রমণের হাত ধরে অসমে বিদেশি রাজের সূত্রপাত ঘটে। তারপর সেই সূত্রধরে ইয়ান্ডাবু সন্ধি হয় এবং ইংরেজরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে অসমে প্রবেশ করে। ১৮৫৮ সালে সমগ্র দেশের সঙ্গে অসমও ইংরেজ শাসনাধীন হয়ে পড়ে। তার পর ধীরে ধীরে উপনিবেশিকতার চাপ অনুভব করে অসমের সাধারণ মানুষ। শুরু হয় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন। ১৮২৮ সালে ধনঞ্জয় বড়গোহাই, এবং গুণধর কুয়ার প্রথম ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সমগ্র ভারতের সঙ্গে অসমেও স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় মণিরাম দেওয়ান, আহোম রাজা কন্দপেশ্বর, পিয়ালী বড়ুয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধাচরণ করেন।

১৯০৫ সালে সমগ্র দেশে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বদেশি আন্দোলনের প্রধান উদ্দ্যেশ ছিল বিদেশি দ্রব্য বর্জন করা। অসমের তেজপুর, বরপেটা, ধুবড়ি, গৌরীপুর, গুয়াহাটি, গোয়ালপাড়া, শিলচর, করিমগঞ্জ এবং আরও অনেক জায়গায় স্বদেশি আন্দোলন ব্যাপক ভাবে সাড়া জাগায়। তরুণরাম ফুকন, নবীন চন্দ্র বারদলই, রোহিনী চৌধরী, মোহম্মদ তায়েবুল্লা এবং আরও অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসেন। ১৯৩০ সালে অসহযোগ আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইংরেজ সরকার এক ফন্দি বের করে। অসমের তৎকালীন শিক্ষা অধিকর্তা কানিংহাম এক নির্দেশনা দেন যে, কোনও ছাত্রছাত্রীদের অবিভাবক কোনও রকম হরতাল, পিকিটিং, কিংবা রাজনৈতিক সভাযাত্রায় অংশ নিতে পারবে না। শুধু তাই নয়, সমস্ত রকম সরকারী অনুশাসনও মেনে চলতে হবে। কিন্তু এ শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই দলে দলে ছেলে-মেয়েরা স্কুল কলেজ ত্যাগ করতে থাকে। আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। অবশেষে সরকার ওই সার্কুলার প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো অন্ধকার, পর্ব ১০: অসমে রবীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

১৯২১ সালে অসমে মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন। গান্ধীজি ২৮ আগস্ট রাত ১০টায় শিলচর শহরে পৌঁছন। গান্ধীজিকে একবার মাত্র চোখের দেখা দেখার জন্য বদরপুর থেকে শিলচর পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশন এবং শিলচর শহরে মানুষ ভিড় করে। তিনি কামিনীকুমার চন্দের বাড়িতে গিয়ে উঠে ছিলেন। সেই সময় একটি আইনি মামলার কাজে কামিনীকুমার চন্দকে চট্টগ্রাম যেতে হয়েছিল। তাঁর ছেলে অরুণকুমার চন্দ তখন গান্ধীজিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

গান্ধীজির আগমন স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ অসহযোগ আন্দোলন এবং অন্যান্য আন্দোলনে যোগ দিতে লাগল। চন্দ্রনাথ শর্মা, নবীনচন্দ্র বড়দলই, তরুণরাম ফুকন, গোপীনাথ বড়দলই আরও অনেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ দত্তর প্রবন্ধ নির্বাচিত প্রবন্দ সংকলনে (বাংলা ও ইংরেজি) গান্ধীজির শিলচর আগমনের বিষদ বিবরণ পাওয়া যায়।

স্বাধীনতা আন্দোলনে শিলচর শহর তথা বরাক উপত্যকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী, জননেতার যেমন আগমন ঘটছে এই বরাক ভূমিতে, তেমনি অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই বরাকের মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। চারণ কবি মুকুন্দ দাস এই শহরে এসে গেয়েছিলেন ‘ভেঙে ফেলো রেশমী চুড়ি বঙ্গ নারী, কভু হাতে পরো না’। স্বাধীনতা সংগ্রামে অসমের বরাক উপত্যকার শ্যামাচরণ দেবের ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো। তাঁকে শিলচরের গন্ধী বলা হত। তিনি স্বদেশি বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে স্কুলটির পুরো নাম দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়। তবে আজ বন্ধনীর মধ্যে লেখা রয়েছে ‘স্বদেশি স্কুল’। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য যাঁদেরকে সরকারি স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল, মূলত তাদের জন্যই ছিল এই স্কুল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

দশভুজা, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!

মাস্টারদা সূর্য সেনও বরাক উপত্যকায় এসেছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলতে। বিপিনচন্দ্র পাল শিলচরের বিখ্যাত দত্ত বাড়িতে এসে বক্তৃতা করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় সেন, কামিনীকুমার চন্দ, অরুণকুমার চন্দ, অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, হুরমত আলি বড় লস্কর, রশিদ আলি, আব্দুল মতলিব মজুমদার— এঁরা ছিলেন সেই সময়ের দেশপ্রেমী গণনেতা। উল্লেখ্য, দেশ ভাগের সময় আব্দুল মতলিব মজুমদারের নেতৃত্বের জন্যই বর্তমান হাইলাকান্দি জেলা ভারতের সীমানার অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লাস কর দত্ত আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে বেরিয়ে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন শিলচর শহরে। আরেক আন্দামান দ্বীপান্তরী হলেন গোপেন রায়। তিনি বাংলাদেশের হবিগঞ্জের বাসিন্দা ছিলেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি উমেদনগর মেল ডাকাতির মামলায় আন্দামানে কারা বরণ করেন। গান্ধীজির নেতৃত্বে গোলটেবিল বৈঠকের শর্ত অনুযায়ী আন্দামানের বন্দিদের এক এক করে মুক্তি দিলে গোপন রায়েরও হাজত বাসের দিন ফুরায়। জেল থেকে তিনি সিলেট ফিরে গেছিলেন। এদিকে শিলচর থেকে অচিন্ত্য ভট্টাচার্য সেদিনই সিলেট পৌঁছে গোপেন রায়কে অনুরোধ করেন শিলচরে এসে রজনৈতিক কাজ করতে। গোপেন রায় অল্প সময়ের জন্য নিজের বাড়িতে গিয়ে শিলচরে চলে যান। সেখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রথমবার শিলচর আসেন ১৯৩৮ সালে। কাছাড় জেলা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়য়নের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুশীল রঞ্জন চক্রবর্তীর কর্মদক্ষতা দেখে তিনি তাঁকে লিখেছিলেন, “work for the present, but prepare for the future.” ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন বেজে গিয়েছিল, তখন নেতাজি ইম্ফলে চলে গেলেন। ১৯৪৪ সালে ৭ এপ্রিল জাপানিজ এয়ার ফোর্স শিলচর রেল স্টেশনকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করেছিল ভুলবশত। তারা কাছাড়ের বরজালেঙ্গ তে বোমা ফেলেছিল। উদ্দেশ্য সফল হলে গোটা অঞ্চলে ইংরেজ শাসকদের মেরুদণ্ড ভেঙে যেত, আর নেতাজি বাংলা হয়ে দিল্লিতে পৌঁছতে পারতেন।

সময়ের হাত ধরে অবশেষে স্বাধীনতা এল। কিন্তু দেশকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে। সিলেটের বেশিরভাগ অংশই চলে গেল বাংলাদেশে। নদীমাতৃক দেশকে নদীই ভাগ করে দিল। এ পারে ভারত, ওপার বাংলাদেশ। দেশ ভাগের প্রভাব গোটা অসম-সহ বরাক উপত্যকার মানুষের জীবনে যথেষ্ট পড়েছিল।

এ প্রতিবেদনে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। আমাদের দেশমাতার কৃতি সন্তানদের নাম আসলে হাজারটি প্রতিবেদনে লিখেও শেষ হবে না। কিন্তু তাঁরা সবাই আমাদের আদর্শ। —চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক, অসম।

Skip to content