শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কুমার সাহানি (বাঁ দিকে)। 'মায়া দর্পণ' ছবির পোস্টার (ডান দিকে)।

কাহিনি বৈশিষ্ট্য: অন্যধারার ছবি (১৯৭২)
ভাষা: হিন্দি
প্রযোজনা: এনএফডিসি
কাহিনি: নির্মল ভার্মা
চিত্রনাট্য সংলাপনির্দেশনা : কুমার সাহানি
অভিনয়ে: অদিতি, অনিল পান্ডিয়া, কান্তা ভ্যাস, ইকবালনাথ কউল প্রমুখ
সময়সীমা : ১০৭ মিনিট
দেখা যাবে: ইউটিউবে


প্রায় নিঃশব্দে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন কুমার সাহানি। তাঁর চলচ্চিত্রগুরু প্রিয় শিক্ষক, চলচ্চিত্রকে বিনোদন থেকে এক অন্যতর শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম কারিগর, প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের শহর কলকাতার এক বেসরকারি নার্সিংহোমে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কুমার সাহানি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। পুণে ফিল্ম ইন্সটিউটে কুমার অনেকের মতোই চিত্রভাষাকে যুক্তি-তর্কের গল্পে বদলে দেওয়া প্রতিভা ঋত্বিক ঘটকের কাছে ছবি তৈরির প্রাথমিক পাঠ নেন। আরও যাঁরা এই বিরল শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মণি কউল, আদূর গোপালকৃষ্ণন, সৈয়দ আখতার মির্জা প্রমুখ। এরপর ফরাসি সরকারের বিশেষ বৃত্তি পেয়ে কুমার সাহানি ফ্রান্সে চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই সময় তিনি বিশ্বখ্যাত পরিচালক রবার্ট ব্রেসোঁর সংস্পর্শে আসেন।
দেশে ফিরে কুমার সাহানি ১৯৭২ সালে তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মায়া দর্পণ’ বানান। চিত্র আঙ্গিকের ওপর কুমার সাহানির আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই ‘মায়া দর্পণ’ পরিপূর্ণ ভাবে একটি প্রতীকী ছবি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দর্শক এই ছবিটির কথা প্রায় ভুলে যায়। সম্প্রতি এই ছবিটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রায় ৫০ বছর পরে কুমার সাহানি মায়া দর্পণ ছবিটি আবার সিনেমার চিত্রমোদীদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: কেমন হল তব্বুর ‘খুফিয়া’? বিশাল ভরদ্বাজের স্পাই থ্রিলার জমল কি?

দাঁত তোলার পর আবার দাঁত সেট করছেন? সমস্যা ডেকে আনছেন না তো?

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক পর পরই উত্তর ভারতের কোন একটি ছোট গ্রামে কাহিনির পটভূমি। দেশের রাজনৈতিক সত্তার পূর্ণ প্রকাশের সে মুহূর্তে জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি ঘটছে। সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতায় থেকে যাওয়া সমাজের একসময়ের গণ্যমান্য ধনী মানুষেরা ধীরে ধীরে তাদের গুরুত্ব হারাচ্ছেন। দেশে সমাজতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সর্বস্তরের মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক এমনই একটা সময়ে এই গ্রামের একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেওয়ানজি। তাঁর বিবাহযোগ্যা মেয়ে তরণ। দাদার সংসারে আশ্রিতা বিধবা বোন মানে তরণের পিসি। এই কাহিনীর মূল চরিত্র। দেওয়ানজির স্ত্রী মারা গিয়েছেন বহুদিন। স্ত্রীর মৃত্যুর কারণেই হয়তো সময়ে তরণের বিয়ে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। দেওয়ানজির গুরুত্বহীনতার প্রভাব সংসারের ওপর পড়ে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

তরণের একমাত্র ভাই বাবার সঙ্গে মতানৈক্যের কারণ ঘরছাড়া। সে অসমের চা বাগানে কর্মরত। তার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। উলটে সে বোন তরণকে অসমে ঘুরে যাওয়ার জন্য চিঠি পাঠায়। বাবার কাছে তরণ সে অনুমতি নেওয়ার সাহসটুকু করতে পারে না। এক বিশাল হাভেলিতে তিনটি চরিত্রের দৈনন্দিন জীবনের একাকীত্ব একঘেয়েমি নিয়েই মায়া দর্পণ। এই পরিবারের বাইরের একটি চরিত্র রয়েছে, এই গ্রামে কর্মরত এক যুবক। পেশায় সে রেলরোড ইঞ্জিনিয়ার। তরণের কাছে এই যুবকের সামান্য উপস্থিতিটুকুই তার ছন্দহীন জীবনের একমাত্র উৎসাহ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

আগে আগে দেওয়ানজির কাছে এলাকার লোকজন আসতেন, দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। চা খেতেন। এখন আর কেউ আসেন না। বেতের চেয়ারগুলো উঠোনে খালি পড়ে থাকে। ধুলো জমে। তরণের জীবনের একাকীত্ব এই বাড়িতে দম আটকানো পরিস্থিতি, বিধবা পিসির এই সংসারের যাঁতাকলে আটকে পড়া, সামাজিক গুরুত্বহীনতায় দেওয়ানজির নিজেকে গুটিয়ে ঘরবন্দি করে রাখার বিমূর্ত চিত্রভাবনায় সমৃদ্ধ ‘মায়া দর্পণ’।

১৯৭২ সালের চলচ্চিত্রবোদ্ধা সমালোচকের কেউ কেউ এই ছবিকে ‘গতিহীন’ বলেছিলেন, কেউ বলেছিলেন ছবিতে ইউরোপীয় ছবির তীব্র প্রভাব। কুমার সাহানি রোবার্তো রোসোলিনি এবং রবার্ট ব্রেসোঁর চিত্রভাষায় অনুপ্রাণিত। কুমার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রিয়্যালিস্টিক সিনেমায় ব্রেসোঁর ছবির কাঠিন্য আর রোসোলিনির অর্নামেন্টেশন বা অলংকরণ দুটো সমানভাবে প্রয়োজনীয়।’

মায়া দর্পণে আঙ্গিক, বাস্তবের কাঠিন্যের সঙ্গে সারিয়েলিসমের ফ্যান্টাসি মিলেমিশে এক অন্য চিত্রভাষা সৃষ্টি করে, যা একান্তভাবে কুমার সাহানির নিজস্ব।
* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content