বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

উনিশ শতকের বিদূষীদের নিয়ে কথা বলতে বসব আর ইন্দিরাদেবীর প্রসঙ্গ আসবে না? এ হতেই পারে না। ইন্দিরা দেবী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জ্ঞানদানন্দিনীদেবীর সন্তান। বিদ্যা আর শিল্পচেতনা ছিল তাঁর রক্তে। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন ইন্দিরা। ঠাকুরবাড়ির আদরের ‘বিবি।’ ইন্দিরাদেবীর জীবনে তাঁর মায়ের প্রভাব অনস্বীকার্য। উনিশ শতকের আর পাঁচজন মহিলার ভাবনার জগৎ থেকে জ্ঞানদানন্দিনীর ভাবনার পৃথিবী ছিল একেবারে আলাদা। তখনকার দিনে যেমন কন্যা সন্তান বড় হত পাত্রস্থ হবে বলে ইন্দিরাদেবীর বড় হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল সেই আমলে ব্যতিক্রম। বড় যত্নে বড় আদরে লালিত হয়েছিলেন ইন্দিরা। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে গান এবং ভাষাচর্চায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে ভাবনার তরঙ্গ মিলত রবীন্দ্রনাথের। পত্রবিনিময় করতেন ইন্দিরার সঙ্গে। একসময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইন্দিরাদেবী সভা সমিতিতে গান গাইতে, বক্তব্য রাখতে যেতেন। তাঁকে দেখার জন্য সেইসময়কার এলিট তরুণদের ভিড় জমে যেত। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর খুব ইচ্ছে ছিল তাঁর একটি কন্যা সন্তান হোক। সত্যিই ইচ্ছেপূরণ হল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়ের রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। সঙ্গে তাঁর বিদ্যাচর্চা আর সঙ্গীতচর্চার ইতিবৃত্ত। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য এই মেয়েটি ইন্দিরাদেবী।
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মেধা ও আধুনিকতার স্পর্শে আরও দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন ইন্দিরা। উনিশ শতকের প্রাণবন্ত সরস্বতীই ছিলেন তিনি। তখনকার সময় ইন্দিরাদেবীর জীবনের গল্প রূপকথার চেয়ে কম ছিল না। ইন্দিরাকে সত্যিই বলতে পারি সেই রূপকথার রাজকন্যা। সাধারণত্বের কাঠামোয় ফেলা যায় না ইন্দিরাকে। হয়তো তাই রবীন্দ্রনাথ অগুনতি পত্র লিখেছিলেন তাঁর এই আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে। রবীন্দ্রসাহিত্যে ছিন্নপত্রাবলীর অস্তিত্বের অন্তরালে রয়েছেন এই মেয়েটি।

ছোটবেলা থেকেই গান বাজনার আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছিলেন ইন্দিরা। দেশি ও বিলিতি—এই দুই ধরণের গানের প্রতিই তীব্র আকর্ষণ ছিল তাঁর। লরেটো কনভেন্টের শিক্ষা তাঁকে বিলিতি গানের ভক্ত করে তুলেছিলেন। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের অর্গানিসট মিস্টার স্লেটারের কাছে পিয়ানো এবং মানটাজো নামের এক ইতালীয় বেহালা শিক্ষকের কাছে বেহালাও শিখেছিলেন ইন্দিরা। রবি ঠাকুরের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর দুই ছেলেমেয়ের আলাপ হয়েছিল বিদেশের মাটিতে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?

১৮৭৭ সালে জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে বিদেশ গিয়েছিলেন ইন্দিরা ও সুরেন। রবীন্দ্রনাথের বিলেত প্রবাস শুরু হয় ১৮৭৮ সালে। রবীন্দ্রনাথ নিজে তখন গান নিয়ে বেশ মাতোয়ারা। আইরিশ সঙ্গের জন্য একেবারে তৈরি কন্ঠ তাঁর। ছোট্ট ইন্দিরা রবিকাকার সেই গান পরিণত বয়সেও ভোলেননি—’Won’t you tell me molly darling’, ‘Darling you are growing old’, ‘Good bye sweetheart good bye ‘ইত্যাদি আইরিশ মেলোডিগুলি। গানের সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের বড় কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন ছোট্ট ইন্দিরা।

আইরিশ কবি টমাসমুরের গান আর রবি ঠাকুরের কণ্ঠ —দুই মিলিয়ে বড় সুরেলা বন্ধন তৈরি হয়েছিল ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে তাঁর রবিকাকার। ‘সঙ্গীতস্মৃতি’ নামের স্মৃতিচারণায় ইন্দিরাদেবী লিখছেন, ‘রবিকাকা স্বভাবতই ছোট ছেলে ভালোবাসতেন—আমাদের ভাইবোনকে দিয়ে তাঁর হাতে খড়ি হয়। বিলেতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে সেই যে তাঁর ভাব হয়ে গিয়েছিল, সেটা শেষজীবন পর্যন্ত অটুট ছিল। আমরা হেসে কুটিকুটি হতুম। ‘Darling youare growing old’ প্রভৃতি ইংরেজি গান টেনে টেনে গাইতেন, কিন্তু সে সুর স্বরলিপিতে প্রকাশ করা অসম্ভব।’
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রের প্রতি নয়, গানের সুরের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। আদি ব্রাহ্মসমাজে প্রায়ই উপাসনা হত। ইন্দিরা রবি ঠাকুরের গানের সঙ্গে হারমনিয়াম বাজাতেন। ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘আমি রবিকাকার কাছে আলাদা করে বসে কখনো গান শিখেছি বলে মনে পড়ে না। কেবল বাড়িময় হাওয়ায় হাওয়ায় যে গান ভেসে বেড়াত তাই শুনে শুনে শিখেছি।’ ইন্দিরাদেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলি ‘ছিন্নপত্র’ নামে গদ্যসাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। ইন্দিরাদেবী অত ছোট বয়সেও চিঠিগুলির গুরুত্ব বুঝে আলাদা খাতায় সেগুলি টুকে রেখেছিলেন, বলা ভালো সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। ভগ্নহৃদয়, নলিনী ইত্যাদি বইয়ের পাণ্ডুলিপি, ইউরোপযাত্রীর ডায়ারি —সব তাঁর কাছে খসড়া আকারে ছিল। একবার ইন্দিরার জন্মদিনে একটি দোয়াতদানি উপহার দিয়ে তার সঙ্গে কয়েক ছত্র লিখে দিয়েছিলেন, ‘স্নেহ যদি কাছে কাছে রেখে দেওয়া যেত/চোখে যদি দেখা যেত রে/বাজারে জিনিস কিনে নিয়ে এসে/বল দেখি দিত কে তোরে।…’!
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮১: কবির ‘গানের ভাণ্ডারী’ দিনেন্দ্রনাথ বৈষয়িক-কারণে শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন

১৮৭৩ সালে ইন্দিরার জন্ম হয়। ডাকনাম ছিল বিবি। কলকাতা শহরে তাঁর রূপ গুণের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৮৪ সালে সরস্বতী পুজোর দিন রবীন্দ্রনাথ এসেছেন অ্যালবার্ট হলে বক্তৃতা দিতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন ইন্দিরাকে। সবুজপত্রের সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী তখন ছাত্র। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে বন্ধু নারায়ণচন্দ্র শীলের। নারায়ণচন্দ্র পরম উৎসাহে চলেছেন ইন্দিরা দেবীকে দেখতে। প্রমথ চৌধুরীকেও উৎসাহ দিলেন তিনি। কিন্তু এই প্রস্তাবে বেশ রেগে গাছতলায় শুয়ে পড়ে বলেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, ‘পরের বাড়ির খুকি দেখবার লোভ আমার নেই।’ পরে ইন্দিরা দেবী আর প্রমথ চৌধুরীর বিয়ে হয়। সে অন্য এক রূপকথার মতো গল্প।

ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে ইন্দিরাদেবীই প্রথম বিয়ে পাস করেন। ফারসি আর ইংরেজিতে অনার্স ছিল তাঁর। ১৮৯২ সালে বিএ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে পাস করার জন্য পদ্মাবতী স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। ফারসিটাও বেশ ভালো জানতেন ইন্দিরা। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ফারসি ভাষাতেই পত্র বিনিময় করতেন তিনি। প্রবন্ধ লিখতেন প্রবল মুনশিয়ানায়। স্মৃতিকথা, অনুবাদ ও সঙ্গীতচিন্তা —এইসব শাখায় নিরলসভাবে লিখে যেতেন তিনি। ‘বালক’ পত্রিকায় রাস্কিনের ইংরেজি রচনার অনুবাদ দিয়েই অনুবাদ শাখায় হাতেখড়ি হয়েছিল ইন্দিরার। পরে ‘টেলস অফ ফোর ফ্রেন্ডস’ নামে প্রমথ চৌধুরীর ‘চার ইয়ারির কথা’ বইটি অনুবাদ করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। এছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মিলিতভাবে অনুবাদ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী। ফরাসি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদেও বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন ইন্দিরা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৮: পুরীতে ‘নির্জন সৈকতে’র শুটিংয়ে একসঙ্গে চার চারটি শাড়ি পরে হাজির হয়েছিলেন ছায়া দেবী

ইন্দিরার পাণিপ্রার্থীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। এমনই এক ব্যর্থ প্রেমিকের কথা রবীন্দ্রনাথ নাকি একটি গানে লিখে রেখেছিলেন—‘সখি প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে।’ প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ইন্দিরার বিয়েটি বেশ রূপকথার মতো। সে তাঁদের প্রাক বিবাহপর্বের প্রেমপত্রগুলি পড়লেই বোঝা যায়। কর্মবহুল জীবন ছিল ইন্দিরার। বিখ্যাত হবেন বলে কোনো কাজ করেননি। ভালোবেসে সাধনা মনে করে সৃজনশীল কাজ করে গিয়েছেন। ইন্দিরা দেবী নতুন যুগের আধুনিক নারী। সংযম ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রে। বলেছিলেন, ‘সেকালের ধীরা-স্থিরাদের সঙ্গে একালের বীরা হতে হবে, অথবা সেকালের শ্রী ও হ্রীর সঙ্গে একালের ধী মেলাতে হবে—বঙ্কিমবাবু হলে যাকে বলতেন প্রখরে মধুরে মেশা। এই সামঞ্জস্যই নারীজীবনের মূল মন্ত্র।’

রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংরক্ষণের জন্য ইন্দিরার ভূমিকা অপরিসীম। রবি ঠাকুরের জীবনের প্রথম আমলের গান সংগ্রহ করে রেখেছিলেন ইন্দিরা। অগুনতি গানের স্বরলিপি করেছেন ইন্দিরা। সুর, স্বরলিপি, তথ্য ও তত্ত্ব —সবদিকই গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁর সঙ্গীত সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলির যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে । এছাড়াও নারী জাগরণ, মহিলা সমিতিগুলির নানা কাজ তাঁকে করতে হয়েছে। কিছুদিনের জন্য বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন ইন্দিরাদেবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক, বিশ্বভারতীর দেশিকোমত্তমা উপাধি, রবীন্দ্রভারতীর প্রথম ঘোষিত স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন ইন্দিরাদেবী।

ঠাকুরবাড়ির চালচিত্রে যে কোনও মেয়ের প্রতিভাই আলোর রূপ পেয়েছে। ইন্দিরা দেবী নিজেই যেন ছিলেন আলো। তাঁর উপমা ছিলেন তিনি নিজেই। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর যুগলমূর্তি।

ঋণ স্বীকার
রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহ, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content