রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্র-পত্নী কমলা।
রবীন্দ্রনাথের ‘বড়দা’ দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ। দিনেন্দ্রনাথের পিতা দ্বিপেন্দ্রনাথ। পত্নী সুশীলাকে তিনি হারিয়েছিলেন অকালে। তাঁদের বছর দশকের বিবাহিতজীবন। সুশীলা মারা যাওয়ার পর অল্প সময়ের ব্যবধানে, এক মাস পাঁচ দিন পর দ্বিপেন্দ্রনাথ পুনরায় বিবাহ করেছিলেন। বিবাহ হয়েছিল হেমলতা দেবীর সঙ্গে। দিনেন্দ্রনাথের তখন বছর নয়েক বয়েস। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ভালো গান গাইতেন। পরে অবশ্য নিজের গান নিয়ে যত না বেশি চর্চা করেছেন, তার থেকে অধিক ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে। রবীন্দ্রগানের সুর সংযোজনে, সংরক্ষণে ও প্রচারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁকে বলেছেন, ‘আমার সকল গানের ভাণ্ডারী’।
শুধু গান নয়, দিনেন্দ্রনাথ ভালো অভিনয়ও করতেন। ছেলেবেলাতেই তাঁর অভিনয়চর্চার শুরু। অবনীন্দ্রনাথের লেখায় আছে, দিনেন্দ্রনাথের একটা পোষা ঘোড়া ছিল। সেই ঘোড়া নিয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় তিনি দস্যু বালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সে এক মজার দৃশ্য। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘দিনু তখন ছোট, ওর একটা পোষা ঘোড়া ছিল, সেই ঘোড়ার পিঠে আমাদের লুটের মাল বোঝাই করে দিনু স্টেজে এল। আমরা সব লুটের মাল ভাগ করলুম। একজন আবার গিয়ে ঘোড়াকে একটু ঘাসটাসও খাওয়ালে।’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮০: ঠাকুরবাড়ির ফরাসি-পাচক
এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য
দিনেন্দ্রনাথ একসময় ব্যারিস্টারি পড়তে ওদেশে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাস। ছিলেন আশ্রমের সংগীত-শিক্ষক। গান শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোটোদের ইংরেজিও পড়াতেন, শেখাতেন। আশ্রম-বিদ্যালয়ে শুধু পড়াশোনা নয়, ছিল আনন্দ-লাভের বিবিধ ব্যবস্থা। আনন্দ-আহরণে আশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকরা সদা সক্রিয় ছিলেন। নাটক তো মাঝেমধ্যেই অভিনীত হত। নাটকের রিহার্সাল ঘিরে আনন্দ, দর্শকের সামনে মঞ্চস্থ করে আনন্দ। সেই আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ ছিল না, যাঁদের ছিল, তাঁরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন।
‘শারদোৎসব’ নাটকে দিনেন্দ্রনাথ সেজেছিলেন ‘ঠাকুরদা’। প্রথমে কথা ছিল ঠাকুরদা সাজবেন ক্ষিতিমোহন সেন। পরে তিনি পিছিয়ে যান। পিছিয়ে যাওয়ার কারণ একটাই, এই চরিত্রের কণ্ঠে গান ছিল, গান গাইতে হবে তাঁকে। ক্ষিতিমোহনের ধারণা ছিল তাঁর কণ্ঠে সুর নেই, গান নেই।
‘শারদোৎসব’ নাটকে দিনেন্দ্রনাথ সেজেছিলেন ‘ঠাকুরদা’। প্রথমে কথা ছিল ঠাকুরদা সাজবেন ক্ষিতিমোহন সেন। পরে তিনি পিছিয়ে যান। পিছিয়ে যাওয়ার কারণ একটাই, এই চরিত্রের কণ্ঠে গান ছিল, গান গাইতে হবে তাঁকে। ক্ষিতিমোহনের ধারণা ছিল তাঁর কণ্ঠে সুর নেই, গান নেই।
দিনেন্দ্রনাথ ও কমলা।
দিনেন্দ্রনাথ এই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলেন। বালকদলের সঙ্গে বাউল-সুরে গান ধরেছিলেন তিনি, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা’। শান্তিনিকেতনে ‘রাজা’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন দিনেন্দ্রনাথ। ‘রাজা’-য় সেজেছিলেন পাগল। পাগলের ভূমিকায় কতখানি জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি, সে বর্ণনা আছে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা দেবীর লেখায়। সীতা দেবী লিখেছেন, ‘দিনেন্দ্রনাথ কালিঝুলি মাখিয়া, আলখাল্লার উপর নানা রঙের ন্যাকড়ার ফালি ঝুলাইয়া রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করিলেন। তিনি পাগল সাজিয়াছিলেন। তাঁহার চেহারা দেখিয়া দুই-তিনটি শিশু কাঁদিয়া উঠিল।’
দিনেন্দ্রনাথ এইভাবেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন। সেদিনের অভিনয়ের সাক্ষী ছিলেন আশ্রম-শিক্ষক জীবনময় রায়। তাঁরও মনে হয়েছিল, ‘লম্ফঝম্প নাই, চিৎকার নাই, পাগলামি দেখাইবার দুর্দমনীয় দুশ্চেষ্টা নাই…।’ স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত অভিনয়। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন দিনেন্দ্রনাথ।
দিনেন্দ্রনাথ এইভাবেই চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন। সেদিনের অভিনয়ের সাক্ষী ছিলেন আশ্রম-শিক্ষক জীবনময় রায়। তাঁরও মনে হয়েছিল, ‘লম্ফঝম্প নাই, চিৎকার নাই, পাগলামি দেখাইবার দুর্দমনীয় দুশ্চেষ্টা নাই…।’ স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত অভিনয়। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন দিনেন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১২: সুখলতা রাও— ছোটদের পরী
এটি কোনও বিক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত নয়। কখনো ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় বা ‘ফাল্গুনী’তে, কখনো-বা ‘বিসর্জন’-এ। নাটকে দিনেন্দ্রনাথের চমৎকার অভিনয় বরাবরই উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করত। ‘বিসর্জন’ নাটকে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে, পোশাকে, সংলাপ-উচ্চারণে বড় মানানসই হয়ে উঠেছিলেন। হেমেন্দ্রকুমার রায় ছোটোদের লেখায় বিখ্যাত হলেও বড়দের লেখাতেও প্রথমজীবনে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা ‘ভারতী’তে বহু বড়োদের লেখা লিখেছেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘রঘুপতির ভূমিকায় দিনেন্দ্রনাথের মর্মভেদী দৃষ্টি ও বিপুল দেহই কেবল মানানসই হয়নি, তাঁর অভিনয়ও বেশ উতরে গিয়েছিল।’ ’বিসর্জন-এ রবীন্দ্রনাথ সেজেছিলেন জয়সিংহ। জয়সিংহ সাজা রবীন্দ্রনাথের গায়ের উপর রঘুপতি সাজা দিনেন্দ্রনাথ আছড়ে পড়তেন। বিপুল দেহের অধিকারী দিনুর ভার সইতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কী অবস্থা হত, তা সহজেই অনুমেয়। মজা করে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘দিনু, তুই ভুলে যাস, আমি বেঁচে আছি।’
বিসর্জন নাটকে রবীন্দ্রনাথ।
অভিনয় দেখে উপস্থিত দর্শকরা আনন্দ পায়। যাঁরা অভিনয় করেন, অভিনয় করতে করতে নানান ছোটখাটো ঘটনায় তাঁরাও কম আনন্দ পান না। এমন কত ঘটনাই না ঘটেছে ‘বিসর্জন’ অভিনয়কালে। নাটকে আছে ক্রুদ্ধ রঘুপতির সঙ্গে জয়সিংহের সংলাপ-বিনিময়। সেই সংলাপ বিনিময়ের পর জয়সিংহ গুরুর চরণে নত হয়ে পড়লেন। রঘুপতি সাজা দিনেন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন, জয়সিংহ সাজা রবীন্দ্রনাথ আর উঠতে পারছেন না, উঠতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তখন রঘুপতি জয়সিংহের হাত দুটি ধরে ‘জয়সিংহ, এমনিভাবে অবসাদে নত হয়ে পড়লে চলবে না, ওঠো’ বলে টেনে তুলে দিয়েছিলেন। মঞ্চের বাইরে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘দিনু’কে বলেছিলেন, ‘দিনু, তুই আমাকে রক্ষা করেছিস, না ধরে ওঠালে আমি কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না।’ কবির কথা শুনে দিনেন্দ্রনাথ হেসেছিলেন। হেসে বলেছিলেন, ‘তোমার অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তাই ধরে উঠিয়ে দিলাম।’
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা
যুবকের চরিত্রে অভিনয় করলেও রবীন্দ্রনাথের তখন বয়েস হয়েছে। বাষট্টি বছর বয়সে ঝট করে উঠে পড়ার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। আরও একটি ঘটনার কথা বলা যায়। ঘটনাটি এই ‘বিসর্জন’ অভিনয়কালেই ঘটেছিল। রঘুপতি তখন যথেষ্ট উত্তেজিত, ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ‘বাহুবল রাহুসম ব্রহ্মতেজে গ্ৰাসিবারে চায়’এই কথা বলতে বলতে আকস্মিকই রঘুপতির গলার রুদ্রাক্ষের মালা ছিঁড়ে যায়। কী ঘটে গেল, তা বোঝার আগেই ছিঁড়ে যাওয়া মালার রুদ্রাক্ষ একের পর এক দর্শকদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ। দর্শকরা তো ভীষণ চমকিত! তারাও ধরে নিয়েছিলেন, এটি নাটকেরই অংশ। বিপদে পড়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য যে রঘুপতি সাজা দিনেন্দ্রনাথ এ কাজ করেছেন, নাটক দেখতে দেখতে তা তাদের ভুলেও মনে হয়নি। মঞ্চ থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দিনেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী আর করি, দর্শকদের দিকেই ছুঁড়ে দিলাম!’ শুনে রবীন্দ্রনাথ হেসেছিলেন। সেই হাসিতে প্রশংসা মিশে ছিল। পরে পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যায়।
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা দেবী।
শেষের দিকে আনন্দযজ্ঞে দিনেন্দ্রনাথের আর নিমন্ত্রণ ছিল না। ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’ কবির সাতশোরও বেশি গানের স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দূরত্ব তৈরি হয়। মূলত বৈষয়িক কারণে এই দূরত্ব। শেষে ভালোবাসার শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেছিলেন তিনি।
‘রবিদাদা’-অন্ত যাঁর প্রাণ, শান্তিনিকেতনময় যাঁর জীবন, সেই দিনেন্দ্রনাথকে পরম বেদনায় শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল। ছাড়ার আগেই দিনেন্দ্রনাথের মধ্যে পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। গোপন থাকেনি তাঁর উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা। জানা যায়, সে সময় ‘আশ্রমের কর্মজীবনের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথের আর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল না।’ তাস খেলে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন। কর্মব্যস্ত জীবনে হঠাৎই যেন ছন্দপতন ঘটে যায়। শান্তিনিকেতনের আনন্দনিকেতন ছেড়ে দিনেন্দ্রনাথ চলে এসেছিলেন কলকাতায়, জোড়াসাঁকোয় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসবাস করতেন। কেন ভালোবাসার শান্তিনিকেতন ছেড়ে তাঁর কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, সে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তেমন যুক্তিনিষ্ঠ কৈফিয়ৎ দেননি। ‘দীর্ঘকালের সম্পর্ক দিনেন্দ্রনাথ কেন ছিন্ন’ করলেন, তা তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলেছেন ‘জটিল বৈষয়িক ঘটনা’।
ছবি: লেখক
‘রবিদাদা’-অন্ত যাঁর প্রাণ, শান্তিনিকেতনময় যাঁর জীবন, সেই দিনেন্দ্রনাথকে পরম বেদনায় শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল। ছাড়ার আগেই দিনেন্দ্রনাথের মধ্যে পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। গোপন থাকেনি তাঁর উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা। জানা যায়, সে সময় ‘আশ্রমের কর্মজীবনের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথের আর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল না।’ তাস খেলে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতেন। কর্মব্যস্ত জীবনে হঠাৎই যেন ছন্দপতন ঘটে যায়। শান্তিনিকেতনের আনন্দনিকেতন ছেড়ে দিনেন্দ্রনাথ চলে এসেছিলেন কলকাতায়, জোড়াসাঁকোয় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসবাস করতেন। কেন ভালোবাসার শান্তিনিকেতন ছেড়ে তাঁর কলকাতায় প্রত্যাবর্তন, সে প্রসঙ্গে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তেমন যুক্তিনিষ্ঠ কৈফিয়ৎ দেননি। ‘দীর্ঘকালের সম্পর্ক দিনেন্দ্রনাথ কেন ছিন্ন’ করলেন, তা তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে গিয়ে শুধু বলেছেন ‘জটিল বৈষয়িক ঘটনা’।
ছবি: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।