রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

কৌরবদের উত্তরসূরী জনমেজয় আচার্য বেদব্যাসের শিষ্য বৈশয়াম্পনের কাছে কুরুরাজাদের আদিপুরুষদের বৃত্তান্ত জানতে ইচ্ছুক। ইমন্তু ভূয় ইচ্ছামি কুরূণাং বংশমাদিতঃ।

ব্রহ্মার দশজনপুত্রের দশপুত্রের মধ্যে একজন হলেন দক্ষ। দক্ষের পঞ্চাশটি কন্যা। তাঁরা ছিলেন পুত্রিকাপুত্রের জননী (কন্যার পুত্রকে পুত্ররূপে গ্রহণ করা)। জ্যেষ্ঠকন্যার বংশানুক্রমে রাজা নহুষের পুত্র যযাতি। তিনি ছিলেন কুরুবংশের পূর্বপুরুষ। রাজা যযাতি, ছিলেন ইন্দ্রতুল্য প্রভাবশালী এবং কান্তিমান। তাঁকে জামাতারূপে বরণ করেছিলেন ব্রাহ্মণ ও দানবেরা।দেবদানবদের নিত্য শত্রুতা। উভয়ের ত্রিলোকে আধিপত্য বিস্তারের দ্বৈরথ চিরন্তন। দেবগুরু বৃহস্পতি। দানবদের গুরু শুক্রাচার্য। দুই ব্রাহ্মণ পরোক্ষভাবে দেবদানবের শত্রুতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন। দেবতারা যুদ্ধে দানবদের হত্যা করলেই, দানবগুরু শুক্রাচার্য সঞ্জীবনীবিদ্যার বলে তাদের জীবন দান করতেন। দেবগুরু বৃহস্পতির অজানা ছিল সেই সঞ্জীবনী বিদ্যা। হতাশ, বিপন্ন, ভীত, ত্রস্ত দেবতারা গুরু বৃহস্পতির জ্যেষ্ঠপুত্র কচের শরণাপন্ন হলেন, কচের সাহায্যপ্রার্থী তাঁরা। যা সা বিদ্যা নিবসতি ব্রাহ্মণেঽমিততেজসি।। শুক্রে তামাহর ক্ষিপ্রং ভাগভাঙ্ নো ভবিষ্যসি। সঞ্জীবনী বিদ্যা, সেই অমিততেজা দ্বিজ শুক্রাচার্যের আয়ত্তাধীন। তুমি শীঘ্রই সেই বিদ্যা শিক্ষা করে এসো, অধিগতবিদ্যার বলে যুদ্ধজয়ে আমাদের অংশীদার হও।তরুণ,অল্পবয়স্ক কচ কার্যোদ্ধারে সক্ষম হবেন— এ বিষয়ে দানবেরা নিশ্চিত। এই জীবনদায়ী সঞ্জীবনীবিদ্যাবলে শুক্রাচার্য, শুধুমাত্র দানবদেরই জীবনদান করেন, অদানবদের রক্ষা করেন না।

দেবতাদের কূটপরামর্শ হল— বৃহস্পতিপুত্র কচ তাঁর চরিত্রগত ঔদার্য, মাধুর্য, ইন্দ্রিয়সংযম প্রভৃতি গুণে, শুক্রাচার্যের প্রিয়কন্যা দেবযানীকে তুষ্ট করে নিশ্চয়ই সঞ্জীবনী বিদ্যা লাভ করতে পারবেন। কচ সম্মত হলেন। কচ অসুররাজভবনে পৌঁছে দানবগুরু শুক্রাচার্যকে আত্মপরিাচয় জানালেন, ঋষেরঙ্গিরসঃ পৌত্রং পুত্রং সাক্ষাদ্ বৃহস্পতেঃ। নাম্না কচ ইতি খ্যাতং শিষ্যং গৃহ্ণাতু মাং ভবান্।। আমি ঋষি অঙ্গিরার পৌত্র, সাক্ষাৎ বৃহস্পতির পুত্র। আমার নাম কচ। আমাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করুন।

শুক্রাচার্য সাদরে তাঁকে গ্রহণ করলেন। স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন। কচ! সুস্বাগতং তেঽস্তু প্রতিগৃহ্ণামি তে বচঃ। তিনি গুরুশিষ্যের পারস্পরিক সশ্রদ্ধসম্পর্কের বন্ধন স্বীকার করে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। শুরু হল কচের শিক্ষাজীবনের ব্রহ্মচর্য্যব্রত।শিষ্য কচ গুরুর আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে, যৌবনে উপনীতা গুরুকন্যা দেবযানীকেও নৃত্য, গীত বাদ্যের মাধ্যমে তুষ্ট করতে থাকলেন। প্রত্যহ ফলফুল আহরণ, আদেশপালন ইত্যাদি কোন কাজেই তাঁর আপত্তি নেই। গুরুকন্যা দেবযানীও কচের প্রতি মুগ্ধা। একান্তে গান গেয়ে ব্রহ্মচারী কচের সঙ্গসুখে সময় অতিবাহিত করতেই তাঁর আনন্দ। কারণ, সর্বদাই নারীদের প্রার্থিত হলেন— সুগায়ক, শুভ্রবেশধারী, দানশীল, প্রিয়ভাষী, রূপবান, মালায় সজ্জিত অর্থাৎ সালঙ্কার পুরুষ। গায়তঞ্চৈব শুক্লঞ্চ দাতারং প্রিয়বাদিনম্। নার্য্যো নরং কাময়ন্তে রূপিণং স্রগ্বিনং তথা।।
কচ তাঁর অভীষ্টসিদ্ধির লক্ষ্যে গুরুগৃহে একমনে ব্রতাচরণে মনোনিবেশ করলেন। বহুকাল অতিবাহিত হল। দানবেরা ক্রমে কচের অভিপ্রায় বুঝতে পারল। সঞ্জীবনীবিদ্যা হাতছাড়া হয়ে যাবে—এই চিন্তায়, দানবেরা দেবগুরু বৃহস্পতির প্রতি বিদ্বেষবশত তাঁর পুত্রকে হত্যা করতে উদ্যত হল। প্রথমবার তারা, গোচারণরত কচকে হত্যা করে, তাঁর শরীরটি টুকরো টুকরো করে কেটে নেকড়েদের ভোজ্যে পরিণত করল। অসহায় রক্ষকহীন গোরুগুলি দেখে দেবযানী অনুমান করলেন, নিশ্চয়ই কচ আর জীবিত নেই। তিনি, পিতাকে আশঙ্কার কথা জানালেন। ব্যক্তং হতো মৃতো বাপি কচস্তাত! ভবিষ্যতি। তং বিনা ন চ জীবেয়মিতি সত্যং ব্রবীমি তে।। পিতা, এটি নিশ্চিত যে, কচ হয় হত বা মৃত। আমি সত্যি বলছি, কচকে ছাড়া আমি বাঁচব না। দানবগুরু শুক্রাচার্য কন্যাকে অভয় দিলেন। সঞ্জীবনীবিদ্যাবলে, মৃত কচকে ডাক দিলেন। কচ সেই বিদ্যার প্রভাবে নেকড়েদের দেহ ভেদ করে প্রফুল্লমনে আবির্ভূত হলেন।

দেবযানীর প্রশ্নের উত্তরে তাঁর নিধনবৃত্তান্ত, দানবদের নৃশংস আক্রমণ ও হত্যার বিবরণ এবং গুরু শুক্রাচার্যের অনুগ্রহে পুনরুজ্জীবনের ঘটনা জানালেন। আরও একবার দানবদের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করলেন কচ। দেবযানীর অনুরোধে ফুল আনতে বনে গেলেন কচ। দানবেরা ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। তারা তাঁকে হত্যা করে খণ্ডবিখণ্ড দেহাংশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। দেবযানী তাঁর উদ্বেগের কথা পিতাকে জানালেন। আবারও শুক্রাচার্য সঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে তাঁকে পুনর্জীবিত করে তুললেন।

দানবেরা এ বার মরিয়া হয়ে উঠল। তৃতীয়বার কচের হত্যাপ্রচেষ্টা যেন বিফল না হয়।তারা কচকে হত্যা করে, দেহাংশ দগ্ধ করল। কচের দগ্ধ দেহের ভস্মাবশেষ সুরার সঙ্গে মিশিয়ে শুক্রাচার্যকে পানীয়রূপে নিবেদন করল। শুক্রাচার্য সেই ভস্মমিশ্রিত সুরা পান করলেন। কচকে চোখে হারান দেবযানী। রক্ষকহীন গোধন ফিরে এলো, কচ ফিরলেন না। ভীতা, ব্যাকুলা দেবযানীর উদ্বেগ প্রশমনের জন্যে শুক্রাচার্য তার সুরায় মিশ্রিত কচের ভস্মাবশেষের তথ্য না জেনেই কচকে পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানালেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫০: লক্ষ্মণ—ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

শোকাকুলা দেবযানীকে সান্ত্বনা দিয়ে শুক্রাচার্য বললেন, যতবার তিনি কচকে জীবনদান করেছেন ততবারই দানবদের হিংসার শিকার হচ্ছেন কচ। তাঁকে বাঁচিয়ে তোলা অসম্ভব। অশক্যোঽসৌ জীবয়িতুং দ্বিজাতিঃ সঞ্জীবিতো বধ্যতে চৈব ভূয়ঃ। দেবযানী কচকে ভালবেসেছেন। তার প্রতি বিমুগ্ধা দেবযানী দয়িতের প্রশংসায় অধীর হয়ে বললেন,ব্রহ্মচারী কচ একজন মহান তপোনিধি, উদ্যমী, কর্মকুশল। কচের পথ আমি অনুসরণ করব, সে পথ আমি ত্যাগ করব না। সেই প্রাজ্ঞ, অতি মনোহর কচ, আমার প্রিয় স ব্রহ্মচারী চ তপোধনশ্চ সদ্যোত্থিতঃ কর্ম্মসু চৈব দক্ষঃ। কচস্য মার্গং প্রতিপৎস্যে ন মোক্ষ্যে প্রিয়ো হি মে তাত।। শুক্রাচার্য জানেন, অসুররা তাঁকেও শ্রদ্ধা করেনা। তাই বিদ্বেষবশত তারা বারবার নিরপরাধ শিষ্যটিকে হত্যা করছে। তাদের উদ্দেশ্য হয়তো গুরুকেও দানব করে তোলা। তাই হয়তো এই বিরুদ্ধাচরণ। এই পাপের ফলে এবার এদের ধ্বংস আসন্ন।নাছোরবান্দা দেবযানীর অনুরোধে, আবারও শুক্রাচার্য, সঞ্জীবনীবিদ্যাবলে, কচকে পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানালেন।

সঞ্জীবনীবিদ্যার প্রভাবে গুরুর উদরের ভিতর থেকে আহ্বানে সাড়া দিলেন ভয়ার্ত কচ। প্রসীদ ভগবন্! মহ্যং কচোঽহমভিবাদয়ে। যথা বহুমতঃ পুত্রস্তথা মন্যতু মাং ভবান্।। হে ভগবন, প্রসন্ন হোন। আপনাকে আমি অভিবাদন জানাই। যেমন যে কোন মানুষের পুত্রটি তাঁর পরম আদরের, তেমনই আমাকে মনে করুন। শুক্রাচার্য কচকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন কচের এই দুর্গতির জন্যে দায়ী কারা? কীভাবে কচ গুরুর উদরে স্থান পেলেন? কচ জানালেন, গুরুর আশীর্বাদে তাঁর স্মৃতিশক্তি এখনও অক্ষয়। মৃত্যুর পরেও তাঁর তপঃশক্তিও অটুট রয়েছে। তিনি দানবদের দ্বারা বধবৃত্তান্ত, দগ্ধ হয়ে ভস্মে পরিণত হয়ে, ভস্মচূর্ণাবস্থায় সুরায় মিশ্রিত হয়ে গুরুর পানীয়রূপে উদরে স্থান ইত্যাদি সমস্তকাহিনি ব্যক্ত করলেন। শুক্রাচার্য পড়লেন মহাসঙ্কটে। কচ, গুরুর উদরয বিদীর্ণ করে পৃথিবীলোকে ফিরে এলে তাঁর নিজের প্রাণহানি হবে। কচ ও পিতা শুক্রাচার্য ―এই দুজনের মৃত্যুই কন্যা দেবযানীর কাঙ্খিত নয়। দু’জনের যে কোন একজনের মৃত্যু হলে দেবযানীর নিজের জীবনধারণ করা দুষ্কর হয়ে উঠবে। গুরু শুক্রাচার্য কচকে আশীর্বাদ করলেন, কচ তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেছেন। তোমার ভক্ত দেবযানী‌, তোমায় অত্যন্ত সম্মান করে। তাই তুমি যদি দেবরাজ ইন্দ্র না হও তবে তুমি এই সঞ্জীবনীবিদ্যা লাভ করো। সংসিদ্ধরূপোঽসি বৃহস্পতেঃ সুত! যত্ত্বাং ভক্তং ভজতে দেবযানী। বিদ্যামিমাং প্রাপ্নুহি জীবনীং ত্বং ন চেদিন্দ্রঃ কচরূপী ত্বমদ্য।।

উদারমনা শুক্রাচার্য কচকে জীবনদান করলেন। উপদেশ দিলেন, কচ যেন পুত্ররূপে তাঁর উদর ভেদ করে নির্গত হয়ে, গুরু শুক্রাচার্যকে ওই বিদ্যাবলে জীবনদান করেন। তাঁর এই বিদ্যালাভ যেন ধর্মসঙ্গত ও বিবেচনাপ্রসূত হয়। সমীক্ষেথা ধর্ম্মবতীমবেক্ষাং গুরোঃ সকাশাৎ প্রাপ্য বিদ্যাং সবিদ্যঃ। শুক্রাচার্যের উদর ভেদ করে নির্গত হলেন কচ। দেখলেন, জ্ঞানের আধার শুক্রাচার্যর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে পাশে। পুনর্জীবন লাভ করে সঞ্জীবনীবিদ্যাবলে মৃত শুক্রাচার্যকে বাঁচিয়ে তুললেন তিনি। কৃতজ্ঞ কচ, আনতবিনয়ে শুক্রাচার্যকে বললেন, এই বিদ্যাহীন শিষ্যকে অমৃততুল্য সঞ্জীবনীবিদ্যা দান করেছেন গুরু শুক্রাচার্য। তাই তিনি পিতা ও মাতৃতুল্য গুরুর এই উপকার তিনি মনে রাখবেন, কখনও গুরুর কোন অপকার করবেন না। তং মন্যেঽহং পিতরং মাতরঞ্চ তস্মৈ ন দ্রুহ্যে কৃতমস্য জানন্। তাঁর মতে, যে শিষ্য বিদ্যালাভ করেও সত্যজ্ঞানদাতা ও শ্রেষ্ঠবিদ্যাবিদ গুরুকে সমাদর করেননা তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন না এবং পাপলোকে অর্থাৎ নরকে প্রবেশ করেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮০: ঠাকুরবাড়ির ফরাসি-পাচক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

প্রজ্ঞাবান শুক্রাচার্য সুরাপানজনিত কারণে, সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন, পান করেছিলেন সুরার সঙ্গে শিষ্য কচের ভস্মাবশেষ। এই সব এই বিপত্তির কারণ হল সুরাপান। সেই থেকে ব্রাহ্মণদের সুরাপানহেতু বিভ্রম ― লোকনিন্দিত অধর্মা চরণ এবং ব্রহ্মহত্যাতুল্য পাপরূপে চিহ্নিত হল। শুক্রাচার্য এটি বিধিবদ্ধ নিয়মে বেঁধে দিলেন। দানবদের সম্মুখে শুক্রাচার্য ঘোষণা করলেন কচের সঞ্জীবনীবিদ্যালাভের সংবাদ। জানালেন, কচ এখন থেকে গুরুগৃহেই বসবাস করবেন।

বিদ্যাসমাপনান্তে কচের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় এ বার। দেবযানী সরাসরি্ কচের প্রণয়ভিক্ষা করলেন। স সমাবৃতবিদ্যো মাং ভক্তাং ভজিতুমর্হসি। গৃহাণ পাণিং বিধিবন্মম মন্ত্রপুরস্কৃতম্।। তোমার বিদ্যাশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। তোমার এই অনুরাগিনীর প্রতিদান হল প্রণয়। বিধিসম্মতভাবে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে আমার পাণিগ্রহণ করো। কচ দেবযানীকে শ্রদ্ধা করেন। দেবযানীর পিতা যেমন কচের পূজনীয় তেমনই সম্মানীয়া তাঁর কন্যাটিও। সেইহেতু তিনি গুরুকন্যারূপে পূজনীয়া।

দেবযানীর যুক্তি হল, কচ তাঁর পিতার গুরুপুত্রের পুত্র। তিনি কিন্তু পিতা শুক্রাচার্যের ঔরসজাত পুত্র নন। গুরুপুত্রস্য পুত্রো বৈ ন ত্বং পুত্রশ্চ মে পিতুঃ। তাই কচ দেবযানীর পূজ্য এবং সম্মানীয়। বারবার দানবদের দ্বারা হত কচের প্রতি দেবযানীর অনুরাগ কী কচের মনে পড়েনা? কচের প্রতি দেবযানীর দুর্বলতা এবং অনুরাগ বিষয়ে অবহিত আছেন কচ। এমন নিষ্পাপ নিশ্চিত আনুগত্যকে কচ অস্বীকার করতে পারেন না। সৌহার্দ্দে চানুরাগে চ বেত্থ মে ভক্তিমুত্তমাম্। ন মামহর্হসি ধর্মজ্ঞ!ত্যক্তুং ভক্তামনাগসম্।। কচ দেবযানীকে নিরস্ত করবার জন্য যে যুক্তিজাল বিস্তার করলেন সেটি হল, কচ এবং দেবযানী দুজনেই শুক্রাচার্যের উদরে বাস করেছেন। তাই তিনি কচের সহোদরা।

কচের অনুরোধ, ভগিনী ধর্ম্মতো মে ত্বং মৈবং বোচঃ সুমধ্যমে!। হে শোভনাঙ্গনা, তুমি ধর্মানুসারে আমার ভগিনী, এমন কথা আর বলবে না। কচ দেবযানীর অনুমতি প্রার্থনা করলেন। এ বার যাত্রাপথে, তোমার শুভ আশীর্বাদ দাও। আপৃচ্ছে ত্বাং গমিষ্যামি শিবমাশংস মে পথি। দেবযানীর সতর্ক করলেন, এই প্রত্যাখ্যানের ফল মোটেই ভালো হবেনা। তোমার এই সঞ্জীবনী বিদ্যা বিফল হবে। ন তে বিদ্যা সিদ্ধিমেষা গমিষ্যতি। কচ গুরুকন্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ বিষয়ে গুরুর অনুমতিও নেই। তথাপি দেবযানী নিজের ইচ্ছানুসারে এমন অভিশাপ দিয়েছেন। কচ অভিশাপের যোগ্য নন। তাই এই অভিসম্পাত কার্যকর হবে না। বিপরীতে কচ দেবযানীকে প্রত্যভিশাপ দিলেন, তস্মাদ্ভবত্যা যঃ কামো ন তথা স ভবিষ্যতি। ঋষিপুত্রো ন তে কশ্চিজ্জাতু পাণিং গ্রহীষ্যতি। তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে না। কোন ঋষি কুমার কখনও তোমার পাণিগ্রহণ করবেন না। কচ আরও জানালেন, দেবযানীর অভিশাপ নিষ্ফল হবে কারণ কচ সেই সঞ্জীবনীবিদ্যা অধ্যাপনার মাধ্যমে ছাত্রবৃন্দের মধ্যে ছড়িয়ে দেবেন।কাজেই সেই বিদ্যা বিফল হবে না। ইন্দ্রালয়ে পৌঁছলেন কচ। সেখানে, দেবতারা বৃহস্পতিসহ কচকে, বিপুল সম্বর্দ্ধনা জানালেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮৪: এখনই উদ্যোগ না নিলে ক্রমশ হারিয়ে যাবে কম ফ্যাট ও প্রোটিনে ভরপুর কালবোস মাছ

দেবাসুরের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জড়িয়ে গেল দুটি নাম, কচ ও দেবযানী। সঞ্জীবনীবিদ্যা অমরত্বলাভের হাতিয়ার। এ যেন বর্তমানের যুযুধান বৃহৎশক্তিদের সর্বোচ্চ শক্তিমত্তায় পৌঁছনোর অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। সঞ্জীবনীবিদ্যা, নিজেদের শক্তির সীমা অতিক্রম করে অসীমকে স্পর্শ করবার প্রয়াস। বুদ্ধিতে শান দিচ্ছেন দুই শিক্ষাগুরু বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য। বৃহৎশক্তি দেবতারা মাথা নত করছেন অসুরশক্তির গুরুর কাছে। যেমন হঠাৎ আগ্রাসী আসুরশক্তির বিধ্বংসী অশুভ শক্তিমত্তার কাছে হার স্বীকার করতে হয়, গর্বোদ্ধত বৃহৎশক্তির দম্ভকে, অনেকটা সেই রকম।

যেটি অনন্য, জীবনদায়ী তার অধিকার, ধনীনির্ধন, শক্তিমান, সামর্থ্যহীন, ভালো ও মন্দ সকলের। অশুভশক্তির হস্তগত শুভবিদ্যা সর্বদা ধ্বংসাত্মক কাজেই ব্যবহৃত হয়, এটি প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য। তাই দেবতাদের সঞ্জীবনীবিদ্যাদখলের লড়াই হয়তো অনৈতিক নয়।

আদর্শ শিক্ষাগুরুর দৃষ্টান্ত হলেন দানবগুরু শুক্রাচার্য, যিনি প্রতিপক্ষীয় দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্রকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেছেন নির্দ্বিধায়। বিদ্যাদানের ক্ষেত্রে শত্রু বা মিত্রের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। দেবতাদের কূট চক্রান্তের অন্যতম চাল হলেন কচ। তিনি মানবিক গুণরাশিদ্বারা শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর মন জয় করে সঞ্জীবনীবিদ্যা লাভ করেছেন। কচ তাঁর জীবন বাজি রেখে কার্যোদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন। শুক্রাচার্যের কন্যার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা মিথ্যা নয়। কচ বিভিন্ন নান্দনিক চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে দেবযানীর মন ভুলিয়েছেন। তিনি কিন্তু দানবদের মন জয় কর্তে পারেননি। তিনি গুরুর অনুগ্রহে বারবার প্রাণ হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছেন। দেবযানীর অকুণ্ঠ সহায়তায় জীবনোদ্ধার সম্ভব হয়েছে। গুরু শুক্রাচার্য দানবদের গুরু হয়েও তাঁর ঔদার্য বিসর্জন দেননি। শিষ্যের প্রাণরক্ষায় যত্নবান হয়েছেন। নিজের জীবন বিপন্ন করেও শিষ্যের প্রাণ বাঁচিয়ে তুলেছেন। কচ শুক্রাচার্যের যোগ্য শিষ্য। তিনি জীবন ফিরে পেয়ে অর্জিত বিদ্যাকে সৎকাজে অর্থাৎ গুরুর জীবনরক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এমনটাইতো কাঙ্খিত। গুরুর কাছে অধীতবিদ্যার সার্থক রূপায়ণ, শিষ্যের সাফল্যে নিহিত থাকে। সেই বিদ্যাদান কোন প্রত্যাশা বা প্রতিদানের অপেক্ষায় থাকে না। বিদ্যালাভের ক্ষেত্রে কিন্ত শিষ্যের কৃতজ্ঞমনটি প্রত্যুপকারে উন্মুখ হয়ে থাকে। এই আনত কৃতজ্ঞ মনটিই হয়তো শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা, শিক্ষাগুরু শুক্রাচার্যদের।

কচের প্রতি, দেবযানীর প্রেমোন্মাদনা অমূলক নয়। দেবতাদের দ্বারা উদ্দেশ্যপ্রসূতভাবে প্রেড়িত কচ, দানবদের শত্রু দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র।তাঁর অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে দানবরা। মহাত্মা শুক্রাচার্যের কন্যা সেই দুরভিসন্ধি লেশমাত্র টের পাননি। যৌবনের প্রেমোন্মাদনা এভাবেই হয়তো জ্ঞানদৃষ্টি অন্ধ করেম তোলে। কিংবা কচের প্রতি দেবযানীর সহধর্মিণী হওয়ার প্রত্যাশা কী সঞ্জীবনীবিদ্যাদানের বিনিময়মূল্যের সমতুল?

শুক্রাচার্য সুরাপানের ফলে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে যে গর্হিতকাজটি করেছিলেন, সেই কারণে তাঁর ঘোষণাটি প্রকারান্তরে যেন ক্ষমাপ্রার্থনার অনুরূপ। শিক্ষাগুরু ব্রাহ্মণদের, সুরাপান নিন্দিত ও অধার্মিক কাজ রূপে চিহ্নিত করেছেন।

দেবযানীকে কচের প্রত্যাখ্যান, নিঃসন্দেহে ধর্মসঙ্গত ও যৌক্তিক। দেবযানীর কচের প্রতি অভিসম্পাতটিতে তাঁর প্রেমানুভূতির প্রতি সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। মহৎ প্রেমে কী প্রত্যাখ্যানের জ্বালা প্রতিহিংসার দহন সৃষ্টি করে? কোনও বিদ্যাই অভিসম্পাত বা প্রতিহিংসার ফলে বিনষ্ট হয় না। বিদ্যা হল অমোঘ,নিটোল, জ্ঞান। গুরুশিষ্যপরম্পরায় সেই সঞ্জীবনীশক্তি, অমৃতরূপে প্রজন্মান্তরে সংক্রমিত হয়। বেঁচে থাকে। এ কথা যে সময়ই বলে দেয়।— চলবে
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content