বৃহস্পতিবার ৩ অক্টোবর, ২০২৪


সুখলতা রাও।

একটি আঁধার ঘর! সাদা একটি কাপড় টানানো আর বড় মোমবাতি জ্বলছে। বিচিত্র সব পুতুল আলোর সামনে ধরলেই কাপড়ে বায়োস্কোপের মতো ছায়া পড়ছে। গল্প বলছেন সুখলতা রাও। সঙ্গে ছোটরা সাবান জলের বুদবুদ ওড়াচ্ছে আর দিব্যি রামধনুকের রং হয়ে ঝলমলিয়ে উঠছে চারিপাশ। পরীর মতো সুখলতা ছোটদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন এক আলাদা স্বপ্নলোক। গুটি পোকা থেকে প্রজাপতি তৈরি করাতেন তিনি। কাপড় ঝুলত উপর থেকে এক একটা কাপড়ে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ছোটরা। তারপর প্রজাপতি হয়ে মেলে দিত ডানা। ওড়না চুড়ি আর সেফটিপিন — এই তো পাখনা তৈরির উপকরণ। ছোটদের কথা মন থেকে ভাবতে ভাবতে দিব্যি একরত্তি ছোটদের ভুবন তৈরি করে ফেললেন সুখলতা। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় মেয়ে সুখলতার গল্প বলি আজ!
কলকাতার রায়বাড়ির ছেলে মেয়েরা সেই উনিশ-বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে সোনা ফলাচ্ছেন। উপেন্দ্রকিশোরের শিশুমনটি যেমন সুকুমার রায় পেয়েছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন বড় মেয়ে সুখলতা। অভিভাবকদের প্রচেষ্টাও ছিল উল্লেখযোগ্য। লেখাপড়া, ছবি আঁকা, বাদ্যযন্ত্র— সবকিছু মিলিয়ে সুখলতা, সুকুমার ছিলেন দশজনের থেকে আলাদা। গল্পের মতো তাঁদের জীবন। তাঁদের তুলি ও কলম দুটিই কথা বলেছে। সাহিত্যের ভুবনে অমর হয়েছে। সুখলতা কিন্তু সেই সময়ের মেয়েদের মতো বাবা, ভাই, স্বামী বা সন্তানের পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন না। তিনি মনের ভিতর জ্ঞানের দীপ জ্বালিয়ে নিজের পৃথক অস্তিত্ব তৈরি করেছিলেন। এইখানেই লেখক হিসেবে তাঁর গুরুত্ব। নারী হিসেবেও!
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১১: স্বর্ণকুমারী দেবী— ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৬: সুন্দরবনের নদীবাঁধের হাল হকিকত

সুখলতা আর সুকুমার— উপেন্দ্রকিশোরের দুই সন্তান পর পর বছরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৮৬ আর ১৮৮৭ তে। ১৮৮৭ তে প্রকাশিত রাজর্ষি উপন্যাসের দুই শিশু চরিত্রের নামে দুই ভবিষ্যৎ সাহিত্যিকের ডাক নাম হল হাসি আর তাতা! রায়বাড়ি তখন কেউকেটা, নামডাকওয়ালা। ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি! বাড়ির সামনে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়! বাড়িতে সঙ্গীতচর্চা হচ্ছে, লেখাপড়ার আসর বসছে, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা— মন বিকশিত হচ্ছে নানা ভাবে। হাসিখেলার নানা আয়োজন হচ্ছে বাড়িতে। সুখলতা একটু অন্তর্মুখী ছিলেন। ছোটবেলায় সুখলতার এমন অসুখ করেছিল যে হাঁটতে আর কথা বলতে শিখেও ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর ভাই সুকুমারের সঙ্গে আবার সব শুরু হল। লীলা মজুমদার তাঁর তেজস্বিনী স্বভাবের কথা বলেছিলেন। বাবার আদরের মেয়ে সুখলতা। একবার বাবা বকুনি দিয়ে বলেছিলেন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। সুখলতা একটি নিরীহ প্রশ্ন করেছিলেন, বালা জোড়া রেখে যাবেন কীনা!
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫০: লক্ষ্মণ—ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় হয়ে বেথুন কলেজ থেকে বৃত্তি পেয়ে এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সুখলতা। কিন্তু তাঁর বিএ পরীক্ষা দেওয়া হয় না। কারণ তার আগেই তাঁর বিবাহ হয় বিখ্যাত ডাক্তার জয়ন্ত রায়ের সঙ্গে। সুখলতার শ্বশুরমশাই ছিলেন বিখ্যাত ওড়িয়া ভাষার লেখক মধুসূদন রাও, স্বামী সিভিল সার্জেন। সুখলতার জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। বাংলা ভাষা আর ওড়িয়া ভাষার মেশবন্ধন ঘটল তাঁর সাহিত্যে। সুখলতা অপূর্ব ছবিও আঁকতেন। পদক পেয়েছিলেন। ‘গল্পের বই’ সুখলতার লেখা প্রথম সাহিত্য। এখানে তিনি গল্প লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছবিও এঁকেছেন। সুখলতার লেখা ‘ছবিতে গল্প’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম কমিকস— এমনটা দাবি করা হয়। সুখলতার অনূদিত বেহুলা গল্পের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখারও অনুবাদ করেন সুখলতা। শিশুশিক্ষার জন্যও বই লিখেছিলেন সুখলতা। পড়াশুনা, স্বাস্থ্য, নূতন পড়া, নিজে পড়, নিজে শেখ, খেলার পড়া, নিউ স্টেপস ইত্যাদি তাঁর শিক্ষা চিন্তা বিষয়ক বই।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮০: ঠাকুরবাড়ির ফরাসি-পাচক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি

সুখলতা শিশুদের গল্প লেখার থিয়োরির কথা ভাবতেন। ছোটদের সাহিত্যে মূল্যবোধের কথা বলেছেন তিনি, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব, রূপকথায় নিষ্ঠুর ঘটনার উল্লেখ না থাকার প্রস্তাব — সবটাই শিশু মনস্তত্ত্ব মেনে! ছোটদের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত রাখার জন্য উদ্যোগ নিতেন। ছোটদের খেলার সঙ্গী ছিলেন তথাকথিত রাশভারি সুখলতা। ঘরের কাজ সব জানলেও সংসারী ছিলেন না। ডুবে থাকতেন সংসারের কাজে। সামাজিক নানা কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। কটকে শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র গড়ে তোলা,উড়িষ্যার নারী সেবা সংঘ তৈরি, রেড ক্রস সেবক বাহিনী তৈরি করার মতো অনেক সামাজিক কাজ করেছেন সুখলতা। পুরস্কৃত হয়েছেন। অপূর্ব রান্না করতেন, অতিথি সেবা করতেন, কিন্তু মন পড়ে থাকত লেখাপড়ায় ও শিল্পচর্চায়। লীলা মজুমদারকে খুব স্নেহ করতেন। অসমাপ্ত কাজগুলির কথা বলে মৃত্যুর ওপারে পাড়ি দেন।

সুখলতা রাও, ছোটদের জন্য এত কাজ করেছেন যে তাঁকে ছোটদের পরী- মা বললেও অত্যুক্তিহবে না। এইসব লেখকের কথা তুলনায় কম আলোচিত। তবু তাঁদের বিপুল কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ুক দিক থেকে দিগন্তরে। এক ক্ষুদ্র কলমচি হিসেবে এইটুকুই চাই।

গ্রন্থঋণ:
সুখলতা রাও রচনা সংগ্রহ
আর কোনোখানে, লীলা মজুমদার
সিংহীর মতো মন, আরশোলায় অজ্ঞান!: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content