রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীমা বলেছেন, ‘আমার চিরকালই গঙ্গাবাই’। তাই গঙ্গাতীরে তাঁর জন্য নতুন বাড়ি ‘উদ্বোধন’ তৈরি হয়। ঠাকুরের তিরোভাবের পর তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানেরা যখন অসহায় ও দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন শ্রীমাই ঠাকুরের সন্ন্যাসী ও গৃহী ভক্তদের সঙ্ঘবদ্ধ করে রক্ষা করেছেন। মা সারদা কলকাতা থেকে কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটিতে দুই বছর থাকেন। তারপর কলকাতায় ফিরে বোসপাড়া লেনের একটা ভাড়াবাড়িতে বাস করেন। এদিকে স্বামীজির আমেরিকায় বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে যাবার কথা। কারণ, ভারতবর্ষ থেকে তিনি নির্বাচিত অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন।

একদা ভারতের দক্ষিণপ্রান্তে কন্যাকুমারীর বেলাভূমিতে অস্তগামী সূর্যের অরুণাভায় সাগরের বিক্ষিপ্ত জলরাশির অপার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ বিবেকানন্দের মনে হঠাৎ আলোড়ন ওঠে। তাঁর অনুভূতির রেশ ছিন্ন করে এক তীব্র প্রশ্ন জাগে। ‘এই বিস্তীর্ণ জরাজীর্ণ মহাদেশ, কোটি কোটি দীন দুঃখী দেশবাসী। পরাধীন ভারতমাতা। তাহলে জন্মভূমির প্রতি কি আমার কোনও দায়বদ্ধতা নেই, নেই আমার কোনও কর্তব্য? আমি বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী, তপস্যা করে শুধু মোক্ষলাভই কি আমার লক্ষ্য? আমার গুরু পরমহংসদেবের শিক্ষা কি এই… না না আমি মোক্ষ চাই না, স্বর্গ চাই না। আমি মাতৃভূমি ভারতের দুঃখী দেশবাসীর সেবায় আত্মবলি দেব। আমার গুরুর শিক্ষা সার্থক করব। গুরুমহারাজের সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাবধারা বিশ্বে প্রচার করব।
স্বামীজির বিরাট শক্তির উন্মাদনা সেদিন তাঁকে অসীম শক্তিশালী করে তুলেছিল। কিন্তু তাঁর মনেও কতগুলি সংশয় দেখা দেয়। পাশ্চাত্যে যাওয়া তাঁর পক্ষে কতটা ঠিক। তিনি ভাবলেন যে, যদি মায়ের অনুমতি পান, তবেই যাবেন। মহাশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তখন মহাশক্তিস্বরূপা মা সারদার আশীর্বাদ ও অনুমতি চাইলেন। শ্রীমা তখন বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্জের বাড়িতে বাস করছেন। নরেনের চিঠি পেয়ে তিনি খুব চিন্তিত হয়ে উঠলেন। কারণ, নরেন যে পরম স্নেহের সন্তান। তাকে মা হয়ে কি করে অমন দূর-দূরান্তের পথে একা যাওয়ার অনুমতি দিতে পারেন। তাই শ্রীমা দারুণ ভাবনায় পড়লেন। তখন সব চিন্তার নিরসন করে ঠাকুর মা সারদার অস্থির মনকে শান্ত করে দিয়েছিলেন। শ্রীমা তখন বুঝেছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ঠাকুরের ভাবধারা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেবার হোতা হবেন নরেনই। আর তার গুরুভাইদের সাহায্যে সার্থক করে তুলবে সে এই বিশ্বকল্যাণযজ্ঞ। তাই জগতের কল্যাণ কামনায় মা সারদা সেদিন তাঁর প্রাণের সন্তানকে স্বীয় সংকল্প সার্থক করার জন্য আশীর্বাদ সহ আনন্দে সম্মতি জানিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩১: বীণাপাণির চরণ ছুঁয়ে…

এ বিষয়ে স্বামীজি লিখেছেন, ‘আহা, এতক্ষণে সব ঠিক হল। মায়েরও ইচ্ছা আমি যাই। আমেরিকা আসার আগে মাকে আশীর্বাদ করতে চিঠি লিখেছিলুম। তিনি আশীর্বাদ দিলেন, অমনি হুম করে পগার পার’। স্বামীজি মনে করতেন যে শ্রীমায়ের আশীর্বাদ তাঁর পাশ্চাত্যে সাফল্যের অন্যতম কারণ। তিনি স্বামী শিবানন্দকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘মায়ের কৃপা আমার উপর বাপের চাইতেও লক্ষগুণ বড়’। আমেরিকা থেকে মঠের ভাইদের উদ্দেশে চিঠিতে জানান স্বামীজি, ‘মা ঠাকুরন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেউ পারেনা, ক্রমে পারবে। .. রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মাঠাকুরানি গেলে সর্বনাশ’।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

স্বামী শিবানন্দও স্বীকার করেছেন, ‘আমরাও প্রথমটা তাঁকে বুঝতে পারিনি। তিনি যে কে ছিলেন, একমাত্র ঠাকুরই তা জানতেন। আর স্বামীজি কতকটা বুঝেছিলেন’। অক্ষয় সেন ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথি লিখতে শুরু করে স্বামীজিকে তা দেখতে দেন। বইয়ের শুরুতে শুধু ঠাকুরের বন্দনা ছিল। তা দেখে তিনি বইটি ফেরত পাঠান। বলেন, ‘শ্রীশ্রী মায়ের বন্দনা কোথায়? তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। তাঁর বন্দনা ছাড়া ঠাকুরের বন্দনা হয় না’। এরপর শ্রীমার বন্দনা এতে সংযোজিত হয়। তিনি বুঝেছিলেন বলেই বিনা বাক্যে শ্রীমাকে স্বীকার করেছিলেন। অথচ এই স্বামীজিই ঠাকুরকে নানাভাবে প্রশ্ন করে, পরীক্ষা করে তবে স্বীকার করেছিলেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাই বলেছেন যে, তাকে চেনা বড় শক্ত। ঘোমটা দিয়ে সাধারণ মেয়েদের মতন তিনি থাকতেন। অথচ মা সাক্ষাৎ জগদম্বা। ‘ঠাকুর না চিনিয়ে দিলে আমরাই কি মাকে চিনতাম’। স্বামীজি তাঁকে বলেন ‘জ্যান্ত দুর্গা’।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১১: স্বর্ণকুমারী দেবী— ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

স্বামী প্রেমানন্দ স্বামী শিবানন্দকে লিখেছেন, ‘এই জ্যান্ত দুর্গাকে জয়রামবাটিতে দেখছি, কুটনো কুটছেন, বাটনা বাটছেন, শাকপাতা তুলছেন ঘুরে ঘুরে, আটা-ময়দা ঠেসছেন, ঢেঁকি পাড় দিচ্ছেন, সুপারি কাটছেন,পান সাজছেন। আবার তাঁকেই দেখি জপ-ধ্যান, সমাধিতে মগ্ন’। তিনিই ভক্তদের গেরুয়া দান, দীক্ষাদান, মন্ত্রের অর্থ বিশ্লেষণ, ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন। অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত থেকে শাস্ত্রজ্ঞ, সাধক সন্তানেরা পর্যন্ত আসছেন নানা আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সমাধান করতে। আর তিনি অতি সহজ, সুন্দর উপমা দিয়ে সেসব নিরসন করেছেন। আবার এই সাধারণ স্ত্রীই বৈদান্তিক তত্ত্বের জটিল বিতর্কের সমাধান করেছেন। কিছু ভক্ত সন্ন্যাসী মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমে ঠাকুরের প্রতিকৃতি পুজোর ব্যবস্থা করেন। এতে স্বামীজি আপত্তি করেন। তাঁর কথা, ‘আমরা অদ্বৈতবাদী’।

অন্যদের বক্তব্য হল যে, ঠাকুর যখন কালীর উপাসক ছিলেন, তখন তিনি অদ্বৈতবাদী নন। তাহলে তারাও অদ্বৈতবাদী নন। শুরু হল দর্শনের চুলচেরা বিচার। মীমাংসা আর হতে চায়না। শেষে শ্রীমা হস্তক্ষেপ করে বললেন, ‘তোমাদের গুরু যিনি, তিনি তো অদ্বৈত। তোমরা সেই গুরুর শিষ্য, তখন তোমরাও অদ্বৈতবাদী’। মা সারদার কথায় সব বির্তকের অবসান হল। সকলেই নতমস্তকে তাঁর দার্শনিক মন্তব্য মেনে নিলেন। আপাত সরলতার মাঝেও এমনই গভীর জ্ঞান ছিল তাঁর।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content