রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


মৃণালিনীর কোলে মাধুরীলতা। পাশে রবীন্দ্রনাথ।

ঠাকুরবাড়িতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা ছিল, জ্যোতিষচর্চা কখনোই নয়। জ্যোতিষশাস্ত্র বুজরুকি ছাড়া কিছু নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান চন্দ্র-সূর্য-চাঁদ-তারা-গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে পর্যালোচনা করে। এটি বিজ্ঞান। জ্যোতিষশাস্ত্র অপবিজ্ঞান। যুক্তিহীন-ভিত্তিহীন, শুধুই গালগল্প ফেঁদে মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করে। ঠাকুরবাড়ির কারও কারও সংস্কারে বিশ্বাস ছিল, নানা ঘটনায়, বিভিন্ন বর্ণনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কোষ্ঠি-ঠিকুজি তৈরি হয়েছে, রবীন্দ্রনাথেরও তৈরি হয়েছিল। যৌবনে রবীন্দ্রনাথের প্রিয়বন্ধু ছিলেন প্রিয়নাথ সেন। কবিতা লিখতেন। কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধও লিখতেন। ‘ফলিত জ্যোতিষ’ নামে একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের জন্মকুণ্ডলী বিচার করেছিলেন। যে বাড়িটি ঘিরে এ দেশের নবজাগরণ, সেই ঠাকুরবাড়িতে ‘পাঁজি-পুঁথি হস্তে’ ‘দৈবজ্ঞ ঠাকুর’-এর আগমন মেনে নেওয়া যায় কি? দৈবজ্ঞ ঠাকুরের আগমন-বার্তা জানা যায় স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা থেকে। এক ‘আচার্যিনী’র পরামর্শে হাতের ক্ষততে সারদাসুন্দরী তেঁতুলপোড়া বেটে লাগিয়েছিলেন।
ঠাকুরবাড়ির বিজ্ঞানমনস্কতা কত গভীর ও বিস্তৃত, তা আমাদের অজানা নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই অন্ধবিশ্বাস অভাবনীয়। রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ-রুগ্ন রেণুকাকে আলমোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সুস্থ করে তোলার আকাঙ্ক্ষায়। কন্যার শয্যাপার্শ্বে বসে জ্যোতির্বিজ্ঞানের যে বইটি তিনি লিখেছিলেন, সে বইটির নাম ‘বিশ্বপরিচয়’। ‘পপুলার সায়েন্স’ বলতে যা বোঝায়, তার মডেল হতে পারে বইটি। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁর অগ্রজ হেমেন্দ্রনাথ ও অগ্ৰজা স্বর্ণকুমারী বিজ্ঞান নিয়ে আস্ত বই লিখেছেন। বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ কম-বেশি অনেকেই লিখেছেন। এই বিজ্ঞান-আবহতেও সারদাসুন্দরীর আহ্বানে জোড়াসাঁকোয় দৈবজ্ঞ ঠাকুরের পদার্পণ, না, এসব মেনে নেওয়া যায় না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৪: সুন্দরবনের মৃত ও মৃতপ্রায় নদী

ঠাকুরবাড়ির কারও কারও ভাবনায়, দিনযাপনে বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। পাঁজি-পুঁথি, দৈবজ্ঞ, সংস্কার সবই ছিল তাদের জীবনযাপনে। দৈনন্দিনজীবনে অস্থিরতা ছিল, ভাবনার দোলাচল ছিল। বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞানের সহাবস্থান কখনো কখনো প্রকট হয়ে উঠেছে। ঠাকুরবাড়ির বিভিন্নজনের বিশ্বাসের জগৎ নিয়ে ভাবনা এই সীমিত পরিসরে আপতত মুলতুবি থাক। আমাদের সব ভাবনাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, রবীন্দ্রনাথে আবর্তিত। তিনি যে পরলোকচর্চা করতেন, প্ল্যানচেটে তাঁর যে আগ্ৰহ ছিল, সেসব আমাদের অজানা নয়। প্ল্যানচেটে প্রয়াতজনের প্রিয়-সান্নিধ্য ফিরে পাওয়ার এক আনন্দময় অনুভূতি ঘিরে থাকত। সেই অনুভূতিটুকু হয়তো পেতে চাইছেন কবি। প্ল্যানচেটে বিজ্ঞান নেই, কল্পনা আছে। কোষ্ঠি-ঠিকুজিতে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল, তাঁর নিজেরই কোনও কোনও স্বীকারোক্তিতে এমন মনে হতে পারে। তিনি যে এ ব্যাপারে স্থির-অবিচল ছিলেন, তা নয়। কৌতুক করেছেন। এ সব কতখানি যুক্তিহীন-ভিত্তিহীন তাও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের চিঠি, মৃণালিনীকে।

রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে সবে পৌঁছেছেন। পত্নী মৃণালিনীকে লিখেছেন, ‘পথশ্রমে শ্রান্ত হয়ে যখন বাড়িতে এলুম তখন বাড়িতে কেউ সেবা করবার, খুসি হবার, আদর করবার লোক পেলুম না।’ কবির সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। ওই প্রতিকূলতার মধ্যেও পুত্রের কোষ্ঠি-বিচার সেরে রাখতে চেয়েছিলেন। এই বিচার কে করবেন, তা মৃণালিনীকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট না হলেও বোঝা যায়, ঘরের নয়, বাইরের কাউকে পুত্রের কোষ্ঠি-ঠিকুজি দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। তিনি কি কোনও জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়ার কথা বলেছেন, তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। পত্নীকে কবি লিখেছেন, ‘দুটো চাবি পেয়েছি — কিন্তু আমার কর্পূর কাঠের দেরাজের চাবিটা দরকার। তার মধ্যে রথীর ঠিকুজি আছে। সেইটের সঙ্গে মিলিয়ে রথীর কুষ্ঠি পরীক্ষা করতে দিতে হবে ।সেটা চিঠি পেয়েই পাঠিয়ো।’
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

গণৎকারের কোনও কোনও কথা রবীন্দ্রনাথকেও ভাবিয়েছে। প্রিয়জন বিপদে পড়বে, এমন আশঙ্কার কথা কেউ শোনালে দুশ্চিন্তা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কবি এক চিঠিতে পত্নীকে লিখেছেন, ‘এখানে কাল থেকে কেমন একটু ঝোড়ো রকমের হয়ে আসচে —এলোমেলো বাতাস বচ্চে, থেকে থেকে বৃষ্টি পড়চে, খুব মেঘ করে রয়েচে, গণৎকার যে বলচে ২৭ জুন অর্থাৎ কাল একটা প্রলয় ঝড় হবার কথা, সেটা মনে একটু একটু বিশ্বাস হচ্চে। আমার ইচ্ছে করচে কালকের দিনটা তোমরা তেতালা থেকে নেবে এসে দোতলায় হলের ঘরে যাপন কর —কিন্তু আমার এ চিঠিটা তোমরা পর্শু পাবে — আমার এ পরামর্শ কোন কাজে লাগবে না।’

কবিপত্নী মৃণালিনী।

রবীন্দ্রনাথের বিনা চেষ্টাতে নাকি যশ-লাভ হবে। আরও ‘দুই একটা জিনিস’ হবে। সেকথা কবিকে বলেছিল সাহাজাদপুরের এক গণৎকার। মৃণালিনী দেবীকে তা কবি এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোতেও রবীন্দ্রনাথের হাত দেখেছিল এক গণৎকার। অমিতা ঠাকুর জানিয়েছেন, সে গণৎকার একেবারে অচেনা ছিল না। শিল্পী নন্দলালের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রেই গণৎকার এসেছিল জোড়াসাঁকোয়।

রবীন্দ্রনাথ গণৎকারের মুখে প্রিয়জনের আসন্ন বিপদের কথা শুনে হয়তো কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত হয়েছেন, কিন্তু কখনোই বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখাননি। বরং কখনো-সখনো কৌতুকচ্ছলে যা বলেছেন, সে বলার মধ্যে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি কবির অনাস্থাই প্রকাশ পেয়েছে। কবির কথায় লক্ষ করা গিয়েছে ব্যঙ্গের প্রলেপ। তেমনই এক ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। বিজ্ঞানসচেতন রবীন্দ্রনাথ অন্তঃসারশূন্য জ্যোতিষশাস্ত্রে আস্থা-নির্ভরতা দেখাবেন, তা হয় নাকি!
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

রবীন্দ্রনাথ তখন সাহাজাদপুরে। হঠাৎই এক গণৎকারের আগমন ঘটে। সে আগমন কবির সুখের কারণ হয়ে ওঠেনি। নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা মৃণালিনী দেবীকে জানিয়েছেন কবি, ‘আজ সকালে এ অঞ্চলের একজন প্রধান গণৎকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সমস্ত সকাল বেলাটা সে আমাকে জ্বালিয়ে গেছে — বেশ গুছিয়ে লিখতে বসেছিলুম, বকে বকে আমাকে কিছুতেই লিখতে দিলে না।’ গণৎকারের খপ্পরে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সে দিনটাই বরবাদ হয়ে গিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের চিঠি, মৃণালিনীকে।

গণৎকার অনেক কথাই বলেছিল। অবিরাম বকবকাবক। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে তাঁর রূপ বর্ণনার মধ্যে আর যাই থাক, কোনও কেরামতি নেই। রবীন্দ্রনাথকে এ সব একটু বিস্মিতই করেছিল। কবি তাঁর পত্নীকে লিখেছেন, ‘আমার রাশি এবং লগ্ন শুনে কি গুণে বল্লে জান? আমি সুবেশী, সুরূপ, রংটা শাদায় মেশানো শ্যামবর্ণ, খুব ফুটফুটে গৌরবর্ণ নয়।’ প্রথমে রূপবর্ণনা, তারপর গুণবর্ণনা। গনৎকার বলেছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়ীবুদ্ধি’ আছে। সেই বুদ্ধি থাকলেও তিনি সঞ্চয় করতে পারবেন না। খরচ করবেন অনবরত, অথচ তাঁকে ‘কৃপণতার অপবাদ’ সবাই দেবে, সহ্য করতে হবে। কেমন মেজাজ রবীন্দ্রনাথের, তাও জানিয়েছিল গণৎকার। ‘মেজাজটা কিছু রাগী’ মনে হয়েছিল গণৎকারের।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

চণ্ডীগড়ের সেই ভাটুরা জংশন

গণৎকারের বলা সেই কথাটি মৃণালিনী দেবীকে জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে লিখেছেন, ‘এটা বোধ হয় আমার তখনকার মুখের ভাবখানা দেখে বলেছিল।’ এ সব না হয় হল, এরপর গণৎকার যা বলেছিল, তা রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জানিয়েছেন, আমরাও সেভাবে জ্ঞাপন করতে চাই। কবি পত্নীর উদ্দেশে লিখেছেন বেদনাবহ এক ভবিষ্যৎবাণী। সে ভবিষ্যৎবাণী পড়ে মৃণালিনী দেবী কতখানি বেদনাহত হয়েছিলেন, তা অবশ্য জানার উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘ষাট বাষট্টি বৎসরের বেশি বাঁচব না। যদি বা কোনও মতে সে বয়স কাটাতে পারি তবু সত্তর কিছুতেই পেরতে পারব না।’

রবীন্দ্রনাথ।

গণৎকারের মুখে এসব শুনে রবীন্দ্রনাথ যে ‘ভারি ভাবনা’য় পড়েছিলেন, তারও উল্লেখ রয়েছে চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১তে সাহজাদপুর থেকে এ চিঠি মৃণালিনীকে লিখেছিলেন। এত বছর পর সে চিঠি পড়ে আমরা অবশ্যই মজা পাচ্ছি। আমোদিত-আনন্দিত হচ্ছি। জ্যোতিষশাস্ত্র কতখানি ভিত্তিহীন, তা আবারও নতুন করে বুঝতে পারছি। ষাট-বাষট্টি, মেরেকেটে বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, তার বেশি কিছুতেই নয়। জ্যোতিষশাস্ত্র পুরোটাই যে বুজরুকি, দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যের ওপর, ওই গণৎকার সেদিন নতুন করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচেছিলেন। আরও একটু আয়ু পেলে, তাঁর সৃষ্টির ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হত। উপকৃত হতাম আমরা। মৃণালিনী দেবীকে লেখা কবির এই চিঠিটি আমাদের বোধোদয় ঘটাক। গণৎকারদের লোক-ঠকানোর ফাঁদে আর কিছুতে আমরা পা দেব না।

ছবি: লেখক।
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content