চুনিলালবাবুর অনুরোধে গিরিশ মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান করতে ইতস্তত করলেন না।
ক্লাসিক থিয়েটারের বেতনাদি বাকি পড়ে যাওয়ার জন্য সেই সময়টা অমরেন্দ্রনাথ দত্তের বড়ই দুঃসময়। গিরিশচন্দ্র তাঁকে সেই সময় কয়েক হাজার টাকা ঋণদান করে দু’-দু’বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। সেই টাকা অবশ্য অমরেন্দ্রনাথবাবু ক্রমশ পরিশোধ করতে পেরেছিলেন। শেষে পরিশোধ হল বটে কিন্তু গিরিশচন্দ্রের তিন মাসের বেতন বাকি পড়ে গেল। বেতন পাওয়ার সম্ভাবনাও তখন অতি অল্প। এই অবস্থায় বিখ্যাত ব্যক্তি চুনিলালবাবুর বিশেষ অনুরোধে গিরিশচন্দ্র ঘোষ মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান করতে আর ইতস্তত করলেন না।
সামনে শিবরাত্রি থাকায় মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান করার পর গিরিশচন্দ্র বুঝলেন, একটি শিব ভক্তিমূলক গীতিনাট্যের খুব প্রয়োজন। তিনি দুই অঙ্কের সমাপ্ত গীতিনাট্যখানা লিখে ফেলেন। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ কাব্য অবলম্বনে এই নাটকটি রচিত হয়েছিল। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের নিজের কৃতিত্ব এর সর্বাংশেই প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫১: গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘সৎনাম’ নাটকটিকে নিয়ে এক সময় খুব বিতর্ক তৈরি হয়েছিল
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
প্রজাপতি জীব সৃষ্টি করেছেন। সতীর দেহত্যাগে মানব পতি পত্নীর সম্বন্ধে বুঝেছে। কিন্তু সৃষ্টির উদ্দেশ্য তখনো সম্পূর্ণভাবে সাধিত হয়নি। ধরণীর আদিমবাসীগণ তখনো ঘর বাঁধতে শেখেনি। বনে বনে শিকার করে ফেরে। বিজ্ঞানে একে মানবের শিকারবৃত্তির যুগ বলে নির্ধারণ করেছিল। এর সঙ্গে সঙ্গে বেদিয়া বৃত্তির যুগের প্রবর্তন। তারপরে অবশ্য কৃষিভিত্তিক যুগ। তারপরে শিল্পকলার ক্রমোন্নতি ঘটেছে। গিরিশচন্দ্র তাই ‘হরগৌরী’ নাটকে মানবজাতির ক্রমবিকাশের এই বৈজ্ঞানিক ধারা অতি দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত করেছেন। এর গল্পাংশ হাস্যরস প্রধান।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৮: সুলতানার স্বপ্ন
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল
‘হরগৌরী’ মিনার্ভা থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯০৫ সালের ৪ মার্চ । প্রথম অভিনয়ের রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন তারকনাথ পালিত (হর), ক্ষেত্র মোহন মিত্র (নারায়ণ), মন্মথনাথ পাল (নারদ) তারা সুন্দরী (গৌরী), মনোরমা (লক্ষ্মী), গোলাপ সুন্দরী (জয়া), সরোজিনী (বিজয়া)। এই নাটকের সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অমৃতলাল দত্ত। নৃত্য শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায়। মেকআপের দায়িত্বে ছিলেন শ্যামাচরণ কুণ্ডু।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান
এই গীতিনাট্য গিরিশচন্দ্র হর পার্বতীর দেব-ভাব পরিস্ফুটনা করে ভাষায় ও ভাবে একটা মধুর গার্হস্থ্য চিত্র অঙ্কিত করেছিলেন। কিন্তু কবির কৃতিত্বে এই গার্হস্হ্যচিত্রের ভেতর দিয়েই নায়ক নায়িকার দেবত্ব দেখা দিয়েছে। নিখুঁত স্বাভাবিক অভিনয়ে তারাসুন্দরী গৌরীর ভূমিকায় মূর্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু তারকনাথ পালিত মহাদেবের ভূমিকায় গোড়ার দিকে সুবিধা করতে পারছিলেন না। সেই জন্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ স্বয়ং কয়েক রাত্রি শিবের ভূমিকায় অভিনয় করে রঙ্গমঞ্চে সকলকে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। মেনকার ভূমিকার নগেন্দ্র বাংলার গাওয়া ‘এসেছিস তো থাক না’ এবং ‘জামাই নাকি শ্মশানবাসী শুনতে পাই’ এই দুটি গান একসময় দর্শক মন্ডলীকে অত্যন্ত মুগ্ধ করেছিল। পৌরাণিক নাটক রচনায় সেই সময় গিরিশচন্দ্র ঘোষের ধারে কাছে কেউ আসতে পারেননি। ফলে ‘হরগৌরী’ সেই সময় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।