শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


প্রকৃতির সুন্দরী কন্যা অসমের কোলে লুকিয়ে আছে অনেক ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ। অসম নিয়ে কথা বলতে গেলে অসমের খনিজ পদার্থের কথাও তাই খুব সহজেই মনে পড়ে যায়। এই রাজ্যের অর্থনীতিতেও এই সব খনিজপদার্থের ভূমিকা যথেষ্ট। পেট্রোলিয়াম আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, সে রান্নার গ্যাসই হোক কিংবা গাড়ির তেলই হোক না কেন। পেট্রোলিয়ামকে এক দিনের জন্যও আমরা আমাদের জীবন থেকে ছুটি দিতে পারি না। এই তেল উত্তোলনের উদ্যোগ ভারতে সর্ব প্রথম অসমেই শুরু হয়েছিল। ভারতের প্রথম তেল শোধনাগার, পেট্রোকেমিকেল প্রকল্প অসমেই শুরু হয়। তিনশুকিয়া জেলার ডিগবয় শহরটিতেই তেলের ইতিহাস রচিত হয়েছিল। তেল উত্তোলনকে কেন্দ্র করে এখানে রয়েছে সেই সময়ের বড় বড় বাংলো, গল্ফ ক্লাব এবং আরও অনেক কিছু। সেই সব কিছুকে নিয়ে আজকের এই তৈল শহর ডিগবয়।
সবুজের অসমের তলোদেশে যে তেল রয়েছে আজ তা আমরা সবাই জানি। অনেকে মনে করেন মাটির তল দেশে একটি পুকুর থাকে সেই পুকুরে থাকে তেল। ভূগর্ভের ভিতরে থাকা প্রস্তর স্তরের রন্ধে এই তেল লুকিয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় মাটির নিচে এই মূল্যবান তেল পাওয়া যায়। আগে অনুমানের উপর নির্ভর করে একটি জায়গাকে খনন করা হত, তাতে কখনও তেলের সন্ধান পাওয়া যেত, কখনও বা কিছুই পাওয়া যেত না। বলা বহুল্য, ভারতের অসমেই সর্বপ্রথম ইংরেজরা তৈল খনির সন্ধান খুঁজে পায়। অনেকে বলেন, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় রেল লাইনের কাজ চলাকালীন সময় কাঠের প্রচুর প্রয়োজন পড়ে, তখন হাতির সহায়তায় দূর দূর থেকে কাঠ আনা হয়েছিল, সেই কাঠ বহনকারী হাতিদের পায়ের কাঁদা তৈলাক্ত ছিল এবং তাতে তেলের গন্ধও ছিল, সেই থেকে তেলের সন্ধান শুরু হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৮: ইংরেজদের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়েছিলেন চা বাগানের শ্রমিকরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

এই তেল ইংরেজদেরকে অসমের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। আসলে অতীতের বেশ কিছু ঘটনা পাশাপাশি ঘটে ছিল বলে খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি ঘটনার প্রভাব অন্যটিতে পড়েছে। ইয়ান্ডুবু সন্ধি একদিকে যেমন বার্মিজদের সঙ্গে যুদ্ধের অবসান ঘটাল, তেমনি অসমের উপর ইংরেজদের লোভী দৃষ্টিও পড়েছিল। তবে এ কথাও সত্যি যে, ইংরেজদের হাত ধরেই অসমে যেমন চায়ের উৎপাদন শুরু হয়েছিল, তেমনি তেলের ক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং বলা যায় উনিশ শতকে অসমে বেশ লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল। আর সে পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই ঘটেনি, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। প্রায় একইসঙ্গে অসমে চা উৎপাদন, তেল শোধনাগার এবং রেল পরিষেবা চালু হয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজ সাহেব কেপ্টিন, উইলকস, জেনকিন্স, ডাল্টন, মেডলিকোট এবং আরও কয়েকজন ইংরেজ অসমে তেলের খনির সন্ধান পান।

১৮২৫ সালে এক ইংরেজ সাহেব বুডিডিহিং নদীর তীরে বুদবুদ করে কিছু বেরোতে দেখেন। তিনি বিষয়টি উপর মহলে লিখিতভাবে জানান। তার পর থেকেই অসমে তেলের অনুসন্ধান শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে ভূগবেষক মি এইচবি মেডিকোট অসমের ভূগর্ভের পর্যবেক্ষণ করতে আসেন। তিনি ডিহিং নদী তীরের মাকুম এবং তার আশপাশের অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান মূলক কাজ শুরু করেন। মূলত এই পরীক্ষামূলক খননকার্যের হাত ধরে অসমে তেল উত্তোলন শুরু হয়। ১৮৬৬ সালে মেককিলপ স্টোবার্ট অ্যান্ড কোম্পানির মিঃ গুডএনাফে অসমে তেল উত্তোলনের অনুমতি পেয়েছিলেন। সংস্থাটি তিনটি তৈল খনির সন্ধান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি

এরপর ১৮৮২ সালে অসম রেলওয়েইজ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিও তেল অনুসন্ধানের অনুমতি পায়। ১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডিগবয়ে প্রথম খননকার্য শুরু হয়। সেই বছরই ১৯ অক্টোবর অসমের ভূগর্ভ থেকে তেল পাওয়া যায়। ১৮৯০ সালে খননকার্য সম্পূর্ণ করে তেল উত্তোলন প্রক্রিয়া চালু হয়। তবে বিষয়টি এত সহজ ছিল না। তেল উত্তোলন প্রক্রিয়াতেও বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হল। শেষমেশ ১৯২৭ সালে ডিগবয়ে সেই খনি থেকে তেল খনন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে হয়। ডিগবয়ের সেই খনিটি আজও সংরক্ষিত আছে। শুধু তাই নয়, ইতিহাসকে স্মরণ করে সেই খাদ থেকে মাঝে মধ্যেই তেল বুদবুদ করে বের হয়।

ডিগবয়ে বাণিজ্যিক পরিমাণে তেল উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তার পর অসম অয়েল সিন্ডিকেটকে তেল অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে মার্ঘেরিটাতে তেল শোধনাগার স্থাপন করা হয়। ১৮৯৯ সালে অসম রেলওয়েজ অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিয়ে ডিগবয়ে অসম ওয়েল কোম্পানি নামে একটি সংস্থা তৈরি করে। তার পর ১৯০১ সালে মার্ঘেরিটাতে গড়ে ওঠে তেল শোধনাগার। সেই সময় ব্রহ্মদেশে ইংরেজরাদের ‘বার্মা ওয়েল কোম্পানি’ নামের একটি সংস্থা তেলের অনুসন্ধানের কাজ করছিল। কোম্পানিটি ১৯২১ সালে অসম ওয়েল কোম্পানি কিনে পূর্ণোদ্যমে তেল অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

বর্তমান বরাক উপত্যকার বদরপুরে তেলের অনুসন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল না থাকায় সেখানে তেল উত্তোলন প্রক্রিয়া চালু রাখা সম্ভবপর হয়নি। স্বাধীনতার পূর্বে একমাত্র অসমেই তেল উত্তোলন শুরু হয়। অসমের ডিগবয়েও তৈরি হয় তেল শোধনাগার। স্বাধীনতার পর অসমের নাহারকটিয়তে প্রথম তেল খুঁজে পাওয়া যায়। তার পর আরও তেলের খনি খুঁজে পাওয়া যায়।

১৯৫৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ভারত সরকার এবং বার্মা ওয়েল কোম্পানি যৌথ ভাবে অসমের দুলিয়জানে ওয়েল ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি সংস্থা গঠন করে। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে ওয়েল ইন্ডিয়া কোম্পানিতে থাকা বার্মা ওয়েল কোম্পানির ৫০ শতাংশ অংশ কিনে নেয় ভারত সরকার। সেই থেকে ওয়েল ইন্ডিয়া ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য সংস্থা হয়ে ওঠে। ওয়েল ইন্ডিয়া দুলিয়জানে এলপিজি গ্যাস উত্তোলন করে। একে কেন্দ্র করে অসম পেট্রোকেমিকেল লিমিটেড পেট্রোলিয়াম থেকে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তৈরি করে। পেট্রোলিয়াম শোধনাগার এবং পেট্রকেমিকেল প্রকল্প দেশে সর্বপ্রথম বঙাইগাঁও-এ শুরু হয়।

অসমের তেলের কথা বললে খুব সহজেই কয়লার প্রসঙ্গও এসে যায়। কয়লা পৃথিবীর সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের বন্ধু হয়ে রয়েছে। অসমে পাওয়া খনিজ পদার্থগুলির মধ্যে কয়লা একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। উনিশ শতকের শুরুর দিকেই অসমে কয়লা খনির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে ১৮৮২ সালে ‘অসম রেলওয়েজ অ্যান্ড কোম্পানি’ খননকার্য এবং কয়লা উত্তোলন শুরু করে। প্রথমে কয়লা শুধু রেল গাড়ি চালানো এবং চা বাগানের কাজে লাগত। অসমে পাওয়া কয়লার জ্বলন ক্ষমতা খুব বেশি। এই কয়লা একাধিক কাজে ব্যবহৃত হয়। ভূগর্ভ থেকে কোনও খনিজকে বের করে আনা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও খনি থেকে যাঁরা খনিজ পদার্থ তুলে আনেন তাঁদের কুর্নিশ জানাতেই হয়।—চলবে।
* ড. শ্রাবণী দেবরায় গঙ্গোপাধ্যায় লেখক ও গবেষক।

Skip to content